X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

মানবপাচার ও জোরপূর্বক শ্রম বন্ধে কঠোর অবস্থানে মালয়েশিয়া

আহমাদুল কবির, মালয়েশিয়া
১৪ জুলাই ২০২১, ২৩:১৯আপডেট : ১৫ জুলাই ২০২১, ১৯:৪৪

মালয়েশিয়ায় জোরপূর্বক শ্রম ও মানবপাচার বন্ধে গাইডলাইন তৈরি করেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং মালয়েশিয়া সরকার। এর ফলে মালয়েশিয়ায় যেকোনও দেশি বা বিদেশি শ্রমিক বা কর্মীকে নিয়োগকর্তা বা কোনও ব্যক্তি জোরপূর্বক শ্রম দিতে বাধ্য করলে বা এ উদ্দেশ্যে পাচারের শিকার হলে তারা মালয়েশিয়ার পুলিশ,  শ্রম দফতর, মানবপাচার প্রতিরোধ কাউন্সিল, ট্রেড ইউনিয়ন এবং নির্ধারিত বেসরকারি সংস্থায় রিপোর্ট করতে পারবেন। সংস্থাগুলো কর্মীর বিষয়ে কীভাবে কাজ করবে এবং তথ্য ও কর্মীর সুরক্ষা নিশ্চিত করবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া আছে গাইডলাইনে।

ফ্রন্টলাইন পরিষেবা সরবরাহকারী গাইডলাইন অনুযায়ী ৫টি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে। এগুলো হলো—সম্ভাব্য মামলার প্রতিবেদন করা; সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির কাছ থেকে অধিকতর তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই; ভুক্তভোগীর চাহিদা মূল্যায়ন;  মামলার রেফারেল তৈরি; এবং উল্লিখিত মামলার বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া। প্রতিটি অপরাধ সম্পর্কে সুস্পষ্ট গাইডলাইন দেওয়া হয়েছে।

গাইডলাইনে মানবপাচার সম্পর্কে মালয়েশিয়ার অ্যান্টি ট্রাফিকিং ইন পারসন অ্যান্ড অ্যান্টি স্মাগলিং অব মাইগ্রেন্ট আইন ২০০৭ উল্লেখ করা হয়েছে যে এই আইন অনুযায়ী কোনও ব্যক্তিকে জোর করে নিয়োগ, পৌঁছে দেওয়া, স্থানান্তর বা পরিবহন করা, আশ্রয় দেওয়া বা কোথাও রেখে দেওয়া এবং গ্রহণ করা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এছাড়াও বল প্রয়োগ করা বা হুমকি দেওয়া, জোর করা, অপহরণ করা, প্রতারণা করা, ভুল তথ্য দিয়ে প্রলুব্ধ করা, দুর্বলতার সুযোগ নেওয়া, এ থেকে আয় করে এবং তাদের শোষণ করা মানবপাচার এবং অভিবাসী পাচার অপরাধ হিসেবে সংঘটিত হবে।

জবরদস্তিমূলক শ্রমের বিষয়টি সম্পর্কে গাইড লাইনে  উল্লেখ করা হয়েছে, যেসব কাজ বা পরিষেবা/সার্ভিস কোনও ব্যক্তির কাছ থেকে কোনও শাস্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা ভয় দেখিয়ে বা ঝুঁকির মধ্যে ফেলে জোর করে নেওয়া হয় এবং যার জন্য ওই ব্যক্তি স্বেচ্ছায় সম্মতি জ্ঞাপন করেনি এমন ঘটনা ফোর্সড লেবার হিসেবে চিহ্নিত হবে।

মানবপাচার ও জোরপূর্বক শ্রম বন্ধে কঠোর অবস্থানে মালয়েশিয়া

যে কেউ গাইড লাইনে উল্লিখিত ২২টির মধ্যে যেকোনও একটি ঘটনার শিকার হলে কোড স্ক্যান করে তথ্য দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। তথ্যদাতার তথ্য গোপন রাখার শর্ত রয়েছে।

২২টি তথ্য হলো:  কর্মক্ষেত্রের প্রকৃতি ( কাজ, বেতন, আবাসন,  নিরাপত্তা) এবং শর্ত সম্পর্কে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছিল; পাসপোর্ট, আইনি বা অন্যান্য মূল্যবান কাগজপত্র আটকে রাখা;  শারীরিক বা যৌন নির্যাতন/ সহিংসতা; সংবেদনশীল শব্দ বা মৌখিক/কথার দ্বারা নির্যাতন; নিজ পরিবারের সদস্যদের প্রতি সহিংসতার হুমকি; কাগজপত্রের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কর্তৃপক্ষকে (পুলিশ বা ইমিগ্রেশন ) জানাতে বা ধরিয়ে দিতে হুমকি দেওয়া; বাড়িতে ফেরত পাঠানোর হুমকি দেওয়া;  কাজের অনুমতি বা ওয়ার্ক পারমিট নবায়ন না করার হুমকি দেওয়া, ঋণ বা ধারদেনা করলে তা বৃদ্ধির হুমকি দেওয়া, কালো তালিকাভুক্ত করার  হুমকি দেওয়া, অনুপযুক্ত শর্তাদির জন্য রিক্রুটিং এজেন্সি বা নিয়োগকারীদের অর্থ প্রদান, অতিরিক্ত রিক্রুটিং ফিস প্রদান, বেতন আটকানো, অন্যায়ভাবে বেতন থেকে টাকা কাটা, অবরুদ্ধ থাকা, পরিবারের সদস্য বা বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না দেওয়া, অতিরিক্ত কাজ করানো,  ছুটির দিন উপভোগ করতে না দেওয়া বা ছুটি নেওয়ার অনুমতি নেই, জীবনযাত্রার/ বসবাসের অবনতি ঘটছে এবং পর্যাপ্ত খাবার দেওয়া হয়নি।

উল্লেখ্য, মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রী নিজেই এবং অন্যান্য কর্মকর্তা বিভিন্ন কারখানা পরিদর্শন করে ওপরের বিষয়গুলো অনেক আগে থেকেই যাচাই করছেন।

মানবপাচার ও জোরপূর্বক শ্রম বন্ধে কঠোর অবস্থানে মালয়েশিয়া

উল্লিখিত ২২টি পয়েন্টের মধ্যে অতিরিক্ত শ্রম, বেতন কম, ওভারটাইম না পাওয়া, ছুটির দিনেও কাজ করা, ঋণ করে মালয়েশিয়ায় কাজ করতে আসা, অতিরিক্ত রিক্রুটিং খরচ দেওয়া, দেশে রিক্রুটমেন্ট সময়ে যে কাজের ও বেতনের কথা বলা হয়েছিল তার সঙ্গে মিল না থাকা, দালাল, এবং বাসস্থানের খারাপ অবস্থার তথ্য আমেরিকা কর্তৃক এবং ইউকের ইউনিভার্সিটি নিউ ক্যাসলের গবেষণায় উঠে এসেছে।

ফলে আমেরিকা পণ্য প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে, যা পরবর্তীতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্যও অনুসরণ করে। এর ফলে মালয়েশিয়ার প্ল্যান্টেশন ও ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরের উৎপাদক ও বিনিয়োগকারীরা চরম সংকট মোকাবিলা করছে।

সম্প্রতি জহুর প্রদেশের আমেরিকার পণ্য উৎপাদনকারী একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মীর বাসস্থান এবং অতিরিক্ত রিক্রুটমেন্ট খরচ নিয়ে আপত্তি তুলে আমেরিকায় পণ্য প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

উল্লেখ্য, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় মালয়েশিয়াকে টায়ার-৩-এ নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ থেকে উত্তরণে মালয়েশিয়া সরকারের দ্রুত পদক্ষেপের অংশ হিসেবে এ গাইডলাইন প্রদান করা হয়েছে। ইতোমধ্যে মানবসম্পদ মন্ত্রণালয় ওয়ার্ক ফর ওয়ার্কার্স নামে একটি অনলাইন অ্যাপ চালু করেছে। যার মাধ্যমে দেশি-বিদেশি যেকোনও কর্মী যেকোনও সময় কর্মক্ষেত্রের অসুবিধা, বঞ্চনা এবং নির্যাতন  সম্পর্কে জানাতে পারছে।

মালয়েশিয়ার মানবাধিকার কমিশন ও বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা ফরটিফাই রাইটস মানবপাচার সম্পর্কে ‘মাছের মতো মানুষ বিক্রি’  শিরোনামে ১২১ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তারা ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মানবপাচারের ঘটনাবলি পর্যালোচনা করে ‘পাচারের ফলে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়’বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন। এতে বলা হয়, ভালো আয় আর আশ্রয়ের প্রলোভনে পাচারকারীরা এসব মানুষকে সমুদ্রপথে পাচার করে। তখনকার মানবাধিকার কমিশনার জেরাল্ড জোসেফ সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘মানবপাচার ঘটনার শিকার ব্যক্তি ও তাদের পরিবার যে ভয়ানক ও জঘন্য অপরাধের শিকার হয়েছে, সেটা যাতে ভবিষ্যতে মালয়েশিয়া বা পৃথিবীর কোথাও না ঘটে, তার জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার সময় এসেছে।’

সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য,  আমেরিকায় পণ্য প্রবেশে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা, কোম্পানি কর্তৃক রিক্রুটমেন্টের অতিরিক্ত অর্থ ফেরত প্রদান, মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অভিযান, মালয়েশিয়ার টায়ার ৩-এ অবনমন এবং আইএলও’র গাইডলাইন অনুযায়ী শ্রম প্রেরণকারী দেশ বা মালয়েশিয়ার জন্য শ্রম উৎসের দেশগুলোর করণীয় রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মত দিয়েছেন।

অন্যতম উৎস দেশ হিসেবে বাংলাদেশ প্রান্তে রিক্রুটমেন্ট প্রক্রিয়ায় একজন যুবক যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে আইএলওর গাইডলাইনে উল্লেখিত কী কী অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে সে বিষয়ে সেন্টার ফর এনআরবির চেয়ারম্যান এম এস সেকিল চৌধুরী বলেন, বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ‘ডিসেপশন অ্যান্ড ডেবট বন্ডেজ’ বাংলাদেশে সংঘটিত হয়। প্রথমটা কাজ, বেতন, সুযোগ সুবিধা, ভিসা, সে দেশে অবস্থান ইত্যাদি সম্পর্কে তাদের মিথ্যা, বিকৃত, ভুয়া এবং অসত্য আশ্বাস দিয়ে প্রলুব্ধ করা হয়। যার সঙ্গে বাস্তবতার মিল থাকে না। ফলে কোম্পানি থেকে পালিয়ে যায়। দ্বিতীয়টি দেশ ত্যাগের আগেই বাধ্য হয়ে করতে হয় এ জন্য যে, অতিরিক্ত অর্থ খরচ না করলে সে চাকরি নিয়ে বিদেশ যেতে পারবে না। তাই ঋণ করে অতিরিক্ত অর্থ দিতে বাধ্য হয়। এর ফলে ডেস্টিনেশন দেশে গিয়ে বিপদে পড়ছে। এই চিত্র শুধু মালয়েশিয়া নয়, অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও আছে।

অভিবাসন বিষয়ক সাংবাদিক মিরাজ হোসেন গাজী বলেন, নিরাপদ ও যৌক্তিক অভিবাসনে সরকার খুবই আন্তরিক, ফলে বেশ কিছু আইন করে অভিবাসী ও পরিবারের সুরক্ষা দিয়েছে। নানান নিয়ম-কানুন , প্রশিক্ষণ ও প্রচারের মাধ্যমে  সতর্ক করছে। মালয়েশিয়া সরকার কর্মীর অধিকার সুরক্ষার যে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে, এতে মালয়েশিয়ায় সুনাম বৃদ্ধি পাবে এবং কর্মীরাও ব্যাপকভাবে উপকৃত হবে বলে আশা করি। তবে এই উপকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দূতাবাসের ভূমিকা যেমন আছে তেমনি সচেতনতা বৃদ্ধি করতে গণমাধ্যমেরও সচেষ্ট হওয়ার দরকার আছে।

তিনি বলেন,  প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে যারা কর্মরত বা বিদেশে কর্মী প্রেরণে যেসব সংগঠন (রিক্রুটিং এজেন্সি) আছে তাদের আমি এইটুকু অনুরোধ করবো যে আপনাদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ, দায়িত্বটা আপনাদের ওপরে বর্তায়। তাই শুধু মালয়েশিয়া এককভাবে নয় বাংলাদেশ প্রান্তেও মানবপাচার ও জবরদস্তির শ্রম বন্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মনিরুস সালেহীন বলেন, আইএলও এবং মালয়েশিয়া সরকার বিদেশি কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিতে যে উদ্যোগ নিয়েছে তাকে আমরা স্বাগত জানাই। পাশাপাশি কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিতে আইএলও এবং মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশও একসঙ্গে কাজ করবে।

/এমআর/এমওএফ/
সম্পর্কিত
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
কানাডায় দ্বিতীয়বার ‘ডিরেক্টরস ক্লাব অ্যাওয়ার্ড’ পেলেন মাহবুব ওসমানী
বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীতে ম্যানিলায় শিশু-কিশোরদের মিলনমেলা 
সর্বশেষ খবর
নাগরিক জীবনের সব ক্ষেত্রে পুলিশের অবস্থান রয়েছে: ডিএমপি কমিশনার
নাগরিক জীবনের সব ক্ষেত্রে পুলিশের অবস্থান রয়েছে: ডিএমপি কমিশনার
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি প্রসঙ্গে যা বললেন রাষ্ট্রদূত
মহাকাশে অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধে জাতিসংঘের ভোটে রাশিয়ার ভেটো
মহাকাশে অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধে জাতিসংঘের ভোটে রাশিয়ার ভেটো
তামাক কর বাস্তবায়নে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ তরুণের অকালমৃত্যু প্রতিরোধ সম্ভব
তামাক কর বাস্তবায়নে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ তরুণের অকালমৃত্যু প্রতিরোধ সম্ভব
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না