X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

কোথাও কিছু হচ্ছে

পারিজাত মৈত্র
২০ জুলাই ২০২১, ১১:৩২আপডেট : ২০ জুলাই ২০২১, ১১:৩২

আমি ঠিক বলতে পারব না আমার পাশের ফ্ল্যাটের ঘাড় নিচু করে হাঁটা বৃদ্ধ-হই-হই লোকটা আছে কিনা। লিফট ধরতে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে যখন দেখতাম বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের ফেনা উপচে উঠছে, আমি মনে মনে গুনে নিতাম বিশ জোড়া সিঁড়ির মিনিমান দুইশত স্টেপ, ব্যাকপ্যাকের নিচের বেল্ট কোমরের সঙ্গে লাগিয়ে দিতাম দৌড়। হ্যাঁ দৌড়ই বলতে হবে, একটুও না থেমে আমি দশতলায় উঠে যেতাম। ততক্ষণে বৃদ্ধ-লিফট তারচেয়ে আরো বৃদ্ধদের যার ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিত।

আমি থাকি ছাদে। যেখানে আকাশটা ঈষৎ নীল হয়ে সাদা সাদা মেঘের ভাড়ে নুয়ে থাকে, সেখানে। দিনের বেলা গরম। পাতিলে চাল-ডাল রেখে দিলে আপনাআপনিই সেদ্ধ হয়ে যায়। তখন অবশ্য আমি প্রায়ই থাকি না।
কোভিডে আক্রান্ত হবার পর পালানো বয়ফ্রেন্ডকে আমি আর এই গরমের মধ্যে তিষ্টাতে দেইনি। তবে তার প্রতিবার সঙ্গে করে আনা এয়ার কুলারটি রয়ে গেছে। সেটার ঠান্ডা হাওয়া খেতে আমার ঘেন্না লাগে না মোটেও।

ফাঁকা ছাদটি এই অবসরে সবজি আর ফুলে ফুলে ভরে গেছে। সবজি বলতে বেগুন, মিষ্টি কুমড়া, ঢেঁড়শ আর বেটে একটা গাছভর্তি পেঁপে, ধেনোমরিচেরও আছে একটা। ফুল বলতে অপরাজিতা, যেটা গরম জলে ফুটিয়ে খাওয়ার অভ্যাস করেছি চায়ের বিকল্প হিসেবে।

ঊষার সময় ঘুম থেকে উঠে কৃষিকাজ করে এয়ার কুলার ছেড়ে আমি লিখতে বসি। একটি উপন্যাস ফাঁদছি। আমার ডেইলি লাইফ নিয়েই উপন্যাস। প্রতিদিন যা যা করি। এমনকি গোপন কর্মও বাদ যায় না; গোপন চিন্তাও না। আমার বয়ফ্রেন্ডকে সেই উপন্যাসের নায়ক বানিয়ে নিয়ে চলেছিলাম, কিন্তু আমি কোভিডে আক্রান্ত হাবার পর তার পিছটান আমাকে শিক্ষা দিয়েছে একলা চলার। হ্যাঁ, আমি তাকে জ্বালিয়েছি। জ্বালানো আমার স্বভাব। আমার সঙ্গ পেতে হলে তার খরচাও যেমন করতে হবে, তেমনি বাসার ধোয়ামোছার কাজও তাকে দিয়ে করাতাম। বেচারা দ্রুত ক্লান্ত হলে বিছানায় ঠেসে তার উপর লাফিয়ে উঠে বলতাম, এবার শুরু করি? সে সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে যেতো। যাক আমার উপন্যাসে সে নেই। তার নাম নীল হলেও, সেখানে গু-কালার মানে হলুদ রিপ্লেস অল করে দিয়েছি। যদিও তার তেমন দোষ নেই। দোষ না থাকাটাই দোষের। সে আমার বাসায় আমার সঙ্গে থেকে কোভিড বাধাতে পারত। আমরা দুজন একসঙ্গে গরম জলের ভাপ নিতাম।

যাক গুয়ের কথা বাদ, বা যদিও ফিরে আসে, আসবেই তো; প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে সে তো ফিরেই আসে। আসুক। কমোডের মধ্যেই তাকে দেখতে চাই, উপন্যাসে না।

আমার উপন্যাসে ঢুকে পড়েছে নিচতলার এক বৃদ্ধ-হই-হই-বৃদ্ধ, ঘাড় সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁটে, একদিন আমার খোলা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আমাকে ডাকে, নাম ধরে নয়, ‘এই ইয়াং লেডি’ বলে। আমি যথেষ্ট শালীন কাপড়ে ছিলাম না। বিছানা চাদরটি গায়ে পেঁচিয়ে দরজায় দাঁড়াই।

‘এটি বোধ হয় আপনার।’ একটি অন্তর্বাস সাপের লেজ ধরে ঘোরাবার মতো করে ঘুরিয়ে তিনি বললেন।

আমি অন্তর্বাস পরি না। শুধু তাই নয়, আমি অন্তর্বাসবিরোধী সোশ্যাল এক্টিভিস্ট। কিন্তু ব্যাপারটা এখানেই সমাপ্ত করতে হাত বাড়িয়ে নেই, ‘ধন্যবাদ, বাতাসে উড়ে গেছে বোধ হয়।’

তিনি হাসলেন ঘরের ভেতরে চোখদুটো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে।

আমি তাকে বসতে বললাম না।

না, বসতে বলেছি। ওইদিন আমার মেজাজ তেমন ভালো ছিলো না। কোভিড পজেটিভের ১১ তম দিনে ছিলাম। মালটা ঘরে ঢুকতেই আশ্চর্য একটি ঘ্রাণে আমার ঘর ভেসে গেল। ভীষণ জলের তোড় থেকে যেমন মাঝি-মাল্লারা নৌকা সামলে রাখে আমি নিজেকে সেভাবে সামলোতে গিয়েও ব্যর্থ হলাম।

তার মুখ আমার মনে নেই। লোকটি বৃদ্ধ-হই-হই হলেও তার ভেতরে এক দোর্দণ্ড তারুণ্য রয়েছে। বা মায়া। ওইসময় সে নিজেও তার বৃদ্ধ খোলশটি খুলে ফেলে তারুণ্যের রঙিন আভায় পুড়তে থাকে।

যাবার সময় আমি তার হাতে অন্তর্বাসটি তুলে দিয়ে বললাম, এটা আপনারই কাজে লাগবে, আমি উন্মুক্ত বক্ষের নারী।

তিনি উপহার পেয়েছেন মনে করে যত্নের সঙ্গে ভাঁজ করে পকেটে চালান করে দিলেন।

বৃদ্ধ-হই-হই লোকটির আর কোনো সাড়া ছিল না [সাড়া পেলে মন্দ হতো না]। একদিন তাকে দেখি গ্যারেজে, ঘাড় আরো বেশি গুজো করে হাঁটতে হাঁটতে লিফটের দিকে আসছেন। আমি সিঁড়ি-দৌড় না দিয়ে তার সঙ্গে লিফটে উঠি। আমি প্রথমে হাত নেড়ে তাকে হ্যালো বলি। তিনি প্রাগৈতিহাসিক কালের থেকে চোখ তুলে আমার দিকে তাকাতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু তার চোখগুলো খুলে লিফটের ভেতরে লাফাতে শুরু করল। আমি তা ধরে ধরে তার হাতে দিতে লাগলাম, কিন্তু তাও তিনি ধরে রাখতে পারলেন না।

লোকটা বোধহয় অন্ধই হয়ে গেল!

*

মাঝখানে এই বৃদ্ধনিবাসটি এম্বুলেন্সের হুইসেলে জেগে জেগে উঠে একেবারেই নীরব হয়ে গেছে। আমি ছাদে ফলানো সবজি খাই, আর ফুল দিয়ে সেজে তাহিতি দ্বীপের তরুণীদের মতো বেঁচে থাকি।

কিন্তু সকালে আমার ঘুম ভাঙে তীব্র পচা গন্ধে, প্রতিদিনই, যেন একটি কালো মাদি কুত্তা আমার খাটের নিচে মরে পচে আছে। আমি ঘর তছনছ করে ছাদের চারপাশে হেঁটে গন্ধের উৎস খোঁজার চেষ্টা করি আর ক্লান্ত হয়ে পড়ি। তারপর ট্রিপল থ্রি-তে ফোন। বাসার ঠিকানা বলতে না বলতেই আমার স্নায়ু অবশ হতে শুরু করে। যেন গন্ধটা আমাকে আবিষ্ট করে রেখেছে। তখন বহুবার আমার ফোন বেজে উঠতে পারে, কিন্তু আমার স্নায়ু আর অন্যকিছু গ্রহণের জন্য প্রস্তুত থাকে না

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
জাবির সিনেট ও সিন্ডিকেট প্রতিনিধি নির্বাচন: বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের নিরঙ্কুশ জয়
জাবির সিনেট ও সিন্ডিকেট প্রতিনিধি নির্বাচন: বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের নিরঙ্কুশ জয়
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক