ভরা মৌসুমে বরিশাল নগরীর ‘ইলিশ মোকাম’ হিসেবে পরিচিত পোর্ট রোডে ইলিশ নেই। সাগরে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে জেলেরা নদীতে নামলেও খালি হাতে ফিরছেন। ইলিশ না পাওয়ায় দাদনের টাকা পরিশোধ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন জেলেরা।
নদীতে ইলিশ না পাওয়ায় আবহাওয়াকে দায়ী করছেন জেলেরা। একই কথা বলছেন পোর্ট রোডের আড়তদাররা। তবে মৎস্য (ইলিশ) কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আগামী তিন-চার দিনের মধ্যে নদীতে প্রচুর ইলিশ মিলবে।
এদিকে বাজারে ইলিশের দাম চড়া। বরিশাল মোকামে এক কেজি ২০০ গ্রাম সাইজের প্রতি মণ ইলিশ পাইকারি ৪৬ হাজার টাকা, কেজি সাইজের প্রতি মণ ৪১ হাজার, রফতানিযোগ্য এলসি সাইজ (৬০০-৯০০ গ্রাম) প্রতি মণ ৩৮ হাজার, ৪০০ থেকে সাড়ে ৫০০ গ্রাম সাইজের প্রতি মণ ২১ হাজার এবং গোটলা সাইজ (আড়াইশ থেকে ৩৫০ গ্রাম) প্রতি মণ ১৭ হাজার টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।
গত ২৩ জুলাই মাছ শিকারের নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর ইলিশ ধরতে নদীতে যান জেলেরা। গত মৌসুমে এই সময়ে যেখানে জাল ভরে ইলিশ উঠেছে সেখানে এবার দেখাই মিলছে না। যে ইলিশ জালে উঠছে তা নিয়ে মোকামে এসে জ্বালানির খরচও উঠছে না। এ কারণে অনেক জেলে ট্রলার নিয়ে মোকামে আসেননি বলেও জানান একাধিক আড়তদার।
আড়তদার জহির সিকদার বলেন, গত বছর এই সময়ে পোর্ট রোডে কমপক্ষে এক হাজার মণ ইলিশ এসেছে। আমাদের ধারণা ছিল, এ বছর আগের চেয়ে বেশি আসবে। কিন্তু গত বছরের অর্ধেক ইলিশও আসেনি এবার। সোমবার পোর্ট রোডে ইলিশ এসেছে ২০০ মণ। রবিবার এসেছিল মাত্র দেড়শ মণ। অল্প ইলিশ আসায় দামও বেশি। যে ইলিশ এসেছে তার সাইজও তেমন ভালো নয়। বেশিরভাগ ইলিশের ওজন ৪০০ গ্রামের মধ্যে। কেজি সাইজের ইলিশ এসেছে হাতেগোনা।
তিনি আরও বলেন, এখন যে পরিমাণ ইলিশ আসছে; তাতে ব্যবসা করে কর্মচারী চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে। আমাদের ধারণা, আবহাওয়ার কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তারপরও আশা করছি, কিছু দিনের মধ্যে জেলেদের জাল ভরে ইলিশ উঠবে। আবারও সরগরম হয়ে উঠবে ইলিশের মোকাম হিসেবে পরিচিত নগরীর পোর্ট রোড।
জেলেনেতা খোরশেদ আলম জানান, গত বছরের সঙ্গে এ বছরের কোনও মিল পাওয়া যাচ্ছে না। গত বছর ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার পর যে পরিমাণ ইলিশ উঠেছিল, তাতে জেলে ও আড়তদার সবাই খুশি ছিলেন। কিন্তু এ বছর জেলেদের খালি হাতেই ফিরতে হচ্ছে। এজন্য মোকামে ইলিশ নেই।
তার মতে, কিছু দিন ধরে পানি বৃদ্ধির কারণে ইলিশ গভীর পানিতে চলে গেছে। তাই ইলিশ মিলছে না। তবে পানি কমা শুরু হয়েছে। পানি কমে গেলে নদীতেও ইলিশ পাওয়া যাবে।
পোর্ট রোডে আসা একাধিক জেলে বলেন, ইলিশ ধরা না পড়লে আড়তদারদের চেয়ে বেশি সমস্যা তাদের। কারণ, প্রতি বছর আড়তদারদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের দাদন নিয়ে চলেন তারা। মৌসুম এলে দাদন পরিশোধ করতে হয়। দাদন পরিশোধ নির্ভর করে জালে ইলিশ ওঠার ওপর। প্রথম দিন তারা আশা করেছিলেন, জাল ভরে ইলিশ উঠবে। এজন্য আড়তদাররাও বারবার ফোন করে ইলিশের খবর জানতে চাচ্ছিলেন। যখন দেখলেন ইলিশ নেই, এটা জানার পর তারা মনে করেছিলেন জেলেরা মিথ্যা বলছেন। কিন্তু এরপর বিভিন্ন মাধ্যমে খবর নিয়ে তারাও সত্যটা জানতে পেরেছেন। অল্প ইলিশ ওঠায় দাদনের পরিমাণ কমছে না।
দাদন নিঃস্ব করে দিচ্ছে জানিয়ে জেলেরা বলেন, ‘বিপদের সময় কেউ আমাদের পাশে থাকে না। এ সময় আড়তদার থেকে শুরু করে যারা এই পেশায় জড়িত তারাই পাশে দাঁড়ায়। তাদের কাছ থেকেই নগদ অর্থ পাওয়া যায়। কষ্টের সময় পাওয়া অর্থের যে কী মূল্য তা বলে বোঝাতে পারবো না। এতে আমাদের ক্ষতিও হয়, আবার লাভও আছে।’
সাগরদী বাজারের ইলিশের খুচরা বিক্রেতা বায়েজীদ সিকদার বলেন, ‘আমরা ছোট ব্যবসায়ী। পোর্ট রোড থেকে ইলিশ নিয়ে বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করি। কিন্তু ইলিশের দাম বেশি হওয়ায় খুচরা বিক্রেতাদের পক্ষে ইলিশ কেনা এখন সম্ভব হচ্ছে না।’
পোর্ট রোডে আসা ক্রেতা জসিম উদ্দিন বলেন, ‘টিভি চ্যানেলে দেশের বিভিন্ন স্থানে ইলিশের সয়লাব হওয়ার খবর প্রচার করা হচ্ছে। তা দেখে আমার মনে হলো, পোর্ট রোডেও একই অবস্থা। কিন্তু এখানে এসে ইলিশ চোখে পড়লো না। আলাপ করে জানতে পারলাম নদীতে ইলিশ মিলছে না। এ কারণে পোর্ট রোডেও ইলিশ নেই। কিছু ইলিশ থাকলেও দাম চড়া হওয়ায় এখন খালি হাতে বাসায় ফিরে যাচ্ছি।’
মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ) বিমল চন্দ্র দাস বলেন, নিষেধাজ্ঞার পর থেকে উপকূলীয় দুবলার চর, হাতিয়া, মনপুরা, চাঁদপুরে বিপুল পরিমাণ ইলিশ মিলছে। আগামী তিন থেকে চার দিনের মধ্যে নদীতেও ইলিশ মিলবে।