X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

ইভ্যালি, সেজান জুস ফ্যাক্টরি আর ‘রেফারি’দের কথা

ডা. জাহেদ উর রহমান
২৯ জুলাই ২০২১, ১৬:২৩আপডেট : ২৯ জুলাই ২০২১, ১৬:২৩

ডা. জাহেদ উর রহমান ২০১৫ সালে বিশ্ববিখ্যাত জার্মান গাড়ি নির্মাতা ফোক্স ওয়াগনের এক ভয়ংকর জালিয়াতি প্রকাশিত হয়, যা ‘ডিজেলগেট’ বা ‘ইমিশনগেট’ কেলেঙ্কারি হিসেবে পরিচিত পায়। কোম্পানিটি তাদের তৈরি ডিজেলচালিত গাড়িগুলোর পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নাইট্রিক অক্সাইড এবং নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড কমিয়ে দেখানোর জন্য জালিয়াতির আশ্রয় নেয়। তারা তাদের গাড়িতে এমন একটি সফটওয়্যার ব্যবহার করে, যেটি শুধু পরীক্ষার সময় গ্রহণযোগ্য মাত্রায় ওই দুটি গ্যাসের নিঃসরণ দেখায়। বাস্তবে যখন রাস্তায় গাড়িগুলো চলে তখন এই গ্যাসগুলোর নিঃসরণ বহুগুণ বেশি হয়। বিশ্বের অতি বিখ্যাত কোম্পানিটির এই জালিয়াতি নিয়ে আবারও আসবো কলামের শেষ অংশে।

ইভ্যালি নামের ই-কমার্স সাইটটি সাম্প্রতিক সময়ে তুমুল আলোচনার বিষয় হয়েছে। শেষ খবরে দেখা যায় দেশের একটি বড় ব্যবসায়িক গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠানটিতে বেশ বড় বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে। এর প্রভাব শেষ পর্যন্ত কী হবে সেটা বলার সময় এখনও আসেনি। তবে প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক সংকটের সুরাহা হয়েছে। এখন এই কোম্পানিটি কীভাবে ব্যবসা করবে জানি না, কিন্তু তার আগের ব্যবসার ধরনে নিশ্চিতভাবেই সমস্যা ছিল।

আমরা এই আলোচনায় আলোচিত বিনিয়োগটির আগের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলি। ইভ্যালির  মালিক চাইতেই পারেন ব্যবসায়িক রীতি-নীতি, রাষ্ট্রীয় আইন না মেনে, এমনকি লুটপাট করে হলেও টাকা বানাতে। এই কোম্পানিটিকে দেখে গজিয়ে ওঠা আলেশামার্ট-সহ অন্যান্য কোম্পানিগুলোর মালিকও সেটা চাইতে পারেন। তারা চাইতে পারেন যেকোনও মূল্যে তাদের প্রফিটকে ‘ম্যাক্সিমাইজ’ করতে।

‘ম্যাক্সিমাইজিং প্রফিট’ বা ‘মুনাফার সর্বোচ্চকরণ’ বাজার অর্থনীতিতে ব্যবসায় খুব আলোচিত একটি কথা। প্রতিটি ব্যবসায়ীর মূল প্রবণতা থাকে তার মুনাফাকে যত বেশি সম্ভব বাড়ানো। যেহেতু এখানে সর্বোচ্চকরণ শব্দটি আছে তাতে এটা বোঝা যায় এর কোনও সীমা নেই। এক টাকা বিনিয়োগে কেউ যদি ১০০ টাকা মুনাফাও করে তবু সেটাকে আরও বাড়ানোর চেষ্টা করবে। এই বাড়ানোর জন্য ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো করতে পারে যাচ্ছেতাই।

কিছু দিন আগেই বহু মানুষ পুড়ে আক্ষরিক অর্থেই অঙ্গার হয়েছিল সেজান জুস ফ্যাক্টরিতে ঘটা অগ্নিকাণ্ডে। দেখা গেছে সেই ভবনটি অগ্নিকাণ্ড এবং অন্যান্য জরুরি অবস্থার ঝুঁকি মোকাবিলার মতো ন্যূনতম পদক্ষেপও নেয়নি। এমনকি সেই কোম্পানিতে ছিল অনেক শিশু শ্রমিকও। কোম্পানিটির মালিক চাইতে পারেন নিয়ম-নীতি, আইন পালন না করে সেই খাতে ব্যয় অনেক কমিয়ে এবং অনেক কম ব্যয়ে শিশুশ্রমিক রেখে তার ‘প্রফিট ম্যাক্সিমাইজ’ করতে।

ইভ্যালি এবং তার অনুকরণে প্রতিষ্ঠিত আলেশামার্টসহ আরও বেশ কিছু ই-কমার্স সাইট যা করছিল তাতে শুরু থেকেই খুব স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছিল এই কোম্পানিগুলো আসলে কী করতে যাচ্ছে। মূল দামের দুই-তৃতীয়াংশ অর্ধেক কিংবা তারও কম দামে মানুষ যখন নানা মূল্যবান পণ্য পেতে শুরু করলো তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই অনেকেই এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়লো। সাম্প্রতিক অতীতে যুবক, ইউনিপে টু ইউ, ডেসটিনির মতো প্রতিষ্ঠানের কাণ্ড দেখার পরও মানুষ আবার এই কোম্পানিগুলোর ফাঁদে পা দিলো।

সামাজিক মাধ্যমে দেখেছেন অনেকেই ‘লোভী’ মানুষদের ভীষণ গালমন্দ করছেন। সাম্প্রতিক অতীতের উদাহরণগুলো দিয়ে করা এই গালমন্দকে আপাতদৃষ্টিতে যৌক্তিকও মনে হয়। কিন্তু আমরা অনেকেই তলিয়ে দেখি না আলোচিত এই ই-কমার্স সাইটগুলো আদৌ এমন ব্যবসা করতে পারে কিনা। বিশেষ করে ইভ্যালি সারাদেশে যে পরিমাণ বিজ্ঞাপন দিয়ে এই ব্যবসায় নেমেছে, মাসের পর মাস চালিয়ে গেছে, তাতে এটা মনে করার কোনও কারণ নেই এই রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক এবং রেগুলেটররা এদের সম্পর্কে জানতেন না। এরা কেউ ‘জিনের বাদশা’ পরিচয় দিয়ে মানুষকে ফোন করে প্রতারণা করে টাকা নেয়নি।

ধরে নেওয়া যাক আলোচিত এই ই-কমার্স সাইটগুলো ইভ্যালির চেয়ারম্যানের ভাষ্য মতো তাদের ব্যবসা শুরুর জন্য বেশ কিছু দিন এরকম অফার করেছে। ধরে নেওয়া যাক এই খাতে তারা কয়েকশ’ কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারপর তারা ক্রমান্বয়ে ভর্তুকি কমিয়ে একটা সাধারণ ই-কমার্স সাইটে পরিণত হবে। এবং এটাও মনে করে নেওয়া যাক ক্রেতাদের পণ্য প্রাপ্তিতে কিংবা পণ্য না পেলে টাকা ফেরত পাওয়াতে কোনও রকম সমস্যা হচ্ছে না। মজার ব্যাপার, এই ইউটোপিয়ান পরিস্থিতিতেও এটা একেবারেই বেআইনি, এটা কোনোভাবেই চলতে দেওয়ার কথা ছিল না।

পশ্চিমের অ্যান্টি-ট্রাস্ট ল'-এর আদলে বাংলাদেশেও আইন আছে- প্রতিযোগিতা আইন, ২০১২। আইনটি নিয়ে বিস্তারিত আলাপের জায়গা এই কলাম না। তবে আইনের নামটি নিশ্চয়ই স্পষ্ট করে এই আইনের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাজারে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা। এই আইনে একটি প্রতিযোগিতা কমিশন গঠন করার কথা এবং সেটা বাংলাদেশে আছে। আইনে সেই কমিশনের কার্যাবলি যা হবে তাতে প্রথম কথাটি হচ্ছে এটা -

৮.১(ক) বাজারে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব বিস্তারকারী অনুশীলনসমূহকে নির্মূল করা, প্রতিযোগিতাকে উৎসাহিত করা ও বজায় রাখা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করা।

হঠাৎ মানুষের টাকা মেরে না দিলেও শত শত কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে বাজারে এমন একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা ইভ্যালি এবং অন্য ই-কমার্স সাইটগুলো কোনোভাবেই তৈরি করতে পারে না। এমন অফার শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কথা ছিল প্রতিযোগিতা কমিশন সেটিকে বন্ধ করবে। কিন্তু না, এটা চললো এবং চলতেই থাকলো।

এরপর আরও কয়েক মাস আগেই যখন জানা যাচ্ছিল ইভ্যালি মানুষের পণ্য দিতে পারছে না এবং পণ্য না পাওয়া মানুষের টাকাও ফেরত দিচ্ছে না, তখন তো এই কোম্পানির চরিত্র সম্পর্কে দ্বিধার আর কিছুই ছিল না। কিন্তু তখনও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সেই ব্যবসা আরও চলতে দিয়ে বহু মানুষের ভয়ংকর ক্ষতির কারণ হতে দেওয়া হয়েছে; যত দিন গেছে তত বেশি মানুষ এই জালে জড়িয়েছে।

সেজান জুস ফ্যাক্টরিতে নানারকম অনিয়ম ছিল। দুর্ঘটনার পর ফায়ার ব্রিগেডের পক্ষ থেকে অন-রেকর্ড বলা হয়েছে সেই ভবনে এমনকি একটি অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রও ছিল না। সব কারখানায় সব আইন ঠিকঠাক মতো মেনে চলছে কিনা সেটা তদারক করার জন্য পরিদর্শক আছেন। বছর দশেক আগে এদের সংখ্যা খুব কম থাকলেও রানা প্লাজার ঘটনার পর এদের সংখ্যা এখন পর্যাপ্ত। দুর্ভাগ্য আমাদের, রানা প্লাজার ঘটনার পর আমদানিকারকদের চাপে গার্মেন্ট কারখানাগুলোকে কমপ্লায়েন্স রক্ষা করার জন্য ঠিক হতে হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য সেক্টরের বেশিরভাগ কারখানা প্রয়োজনীয় মানের আশপাশেও নেই। এমন দেশে আমরা বসবাস করি যেখানে অনেক ক্ষেত্রেই নাগরিকদের স্বার্থ দেখা হয় না, নাগরিকদের স্বার্থ যতটুকু নিশ্চিত হয়, ততটুকু হয় বিদেশের চাপে।

শুরুর প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। ফোক্স ওয়াগন-এর মতো বিখ্যাত কোম্পানিও তাদের গাড়িতে জালিয়াতি করছিল। মজার ব্যাপার, এই কোম্পানি তাদের গাড়িগুলো যখন আমেরিকায় পাঠায় তখন ‘ইউনাইটেড স্টেইটস এনভায়রমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সি’ শেষ পর্যন্ত এই জালিয়াতি ধরতে সক্ষম হয়। এতে নিশ্চিত হয় আমেরিকার নাগরিকদের স্বার্থ। এরপর নেওয়া হয়েছে নানা রকম শাস্তিমূলক পদক্ষেপ।

ফোক্স ওয়াগন কেলেঙ্কারি প্রমাণ করে উন্নত পুঁজিতান্ত্রিক পশ্চিমা দেশগুলোতেও এমনকি অতি স্বনামধন্য ব্র্যান্ডগুলোও তাদের প্রোফিট ম্যাক্সিমাইজেশনের জন্য অন্যায় পদক্ষেপ এমনকি জালিয়াতির আশ্রয় নিতে পারে। কিন্তু সেসব দেশে রেগুলেটররা থাকে, যারা জনগণ আর এই কোম্পানিগুলোর মধ্যে থেকে রেফারির দায়িত্ব পালন করে। তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে উভয়ের মধ্যে যাতে বেআইনি অন্যায় কিছু না ঘটে। সেই রেফারিকে কদাচিৎ কিনে ফেলার ঘটনা সেখানে দেখা যায় না, তা নয়। কিন্তু সেই প্রবণতা খুব কম, আর অন্যায় যোগসাজশের জন্য দায়ী রেগুলেটরদের শাস্তি নিশ্চিত করা হয়।

ইভ্যালি বা সেজান জুসের মালিক কিংবা এই দেশের আর সব ব্যবসায়ী ন্যায়ানুগ ব্যবসা করলে সেটা খুব ভালো। কিন্তু একটা রাষ্ট্রের সরকার থাকতে হয় এটা ধরে নিয়ে যে বহু মানুষ বেআইনি কাজ করবে, নিয়ম ভাঙবে। বহু ‘হায় হায় কোম্পানি’ জনগণকে পথে বসিয়ে নিজে ফুলে-ফেঁপে উঠতে চাইবে। জনগণের টাকায় পরিচালিত সরকারের তখনকার কাজ হবে রেফারির ভূমিকা নেমে ‘ফাউল’ বন্ধ করে জনগণের স্বার্থ রক্ষা করা। সত্যিকার অর্থে সরকার দরকার এজন্যই; সব মানুষ নিজ থেকে ভালো আচরণ করলে, অন্যের প্রতি অন্যায় না করলে তো সরকারেরই দরকার নেই।

এই রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে, সরকার চালানোর ব্যয় সংস্থান করার একজন করদাতা হিসেবে আমার ক্ষোভ-উষ্মার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে সরকারের দায়িত্বশীল মানুষ। এই ক্ষেত্রে রেফারির ভূমিকা পালন করার কথা ছিল। তাদের দায়িত্ব হচ্ছে আমাদের স্বার্থ দেখার জন্য। সেই অনেক রেফারি যখন ব্যবসায়ীদের টাকার কাছে বিক্রি হয়ে আপামর জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, তখন সেই মানুষদের শাস্তি হওয়া উচিত ব্যবসার মালিকদের চাইতে বেশি।

এই দেশে একের পর এক ভয়ংকর শিল্প দুর্ঘটনা হয়েছে, রাসায়নিক গুদামে অগ্নিকাণ্ড হয়েছে, মানুষ সর্বস্ব খুইয়েছে শেয়ার বাজারে কিংবা ভুঁইফোড় ‘হায় হায় কোম্পানি’র হাতে। একটি ঘটনার ক্ষেত্রেও আমরা কি দেখেছি দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থার কারও উল্লেখযোগ্য শাস্তি হয়েছে?

মূল অপরাধীদের আইনের আওতার বাইরে রেখে আর সব পদক্ষেপ আইওয়াশের বেশি কিছু হবে না। আমাদের হয়তো অপেক্ষা করতে হবে কোনও দিন বিদেশি কোনও চাপের...।

লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ