X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

‘তুমি জানো আমি কে?’

প্রভাষ আমিন
২৯ জুলাই ২০২১, ১৬:৫০আপডেট : ২৯ জুলাই ২০২১, ১৬:৫০

প্রভাষ আমিন সময়টা ১৯৮৯-৯০ সালের দিকে। আমি তখন নতুন ঢাকায় এসেছি। টুকটাক লেখালেখির চেষ্টা করি। থাকি যাত্রাবাড়ির এক মেসে। সেখানে একদিন এক ভদ্রলোক অকারণে আমার সঙ্গে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া বাধাতে এলেন। তার আচরণে আমি অবাক। একদম অচেনা একজন মানুষের সঙ্গে কেউ এমন আচরণ করতে পারেন, এটা আমার ভাবনাতেই ছিল না। আমি খুব ঠান্ডামাথায় তাকে বললাম, ভাই আমি আপনাকে চিনি না।

আপনিও তো আমাকে চেনেন না। এমন করছেন কেন? তিনি এটাকে নিলেন হুমকি হিসেবে। তিনি আরও রেগে গেলেন, আপনাকে চিনতে হবে কেন, আপনি কে? আমি অনেক কষ্টে তাকে বোঝাতে পারলাম– আমি মোটেই কেউ নই। আমাকে চেনারও কোনও কারণ নেই। কিন্তু অচেনা কোনও মানুষের সঙ্গে এমন আচরণ করা উচিত নয়, এমন আচরণ করা যায় না। তিনি পরে তার ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। তবে তাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই।

আমাদের অনেকেই নিজেকে চেনানোর চেষ্টা করি, হুমকি দেই। ইদানীং টিভিতে একটি চায়ের বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়। এয়ারপোর্টে এক এয়ারলাইন্সের কাউন্টারে এক ভদ্রলোক তাড়াহুড়ো করে গেলেন। কাউন্টারের ভদ্র মহিলাকে তিনি হুমকি দেন, ‘তুমি জানো আমি কে?’ প্রাথমিকভাবে ভদ্র মহিলার মন খারাপ হলেও সেই চা খেয়ে তার সাহস অনেক বেড়ে যায়। তিনি লাউড স্পিকারে ঘোষণা দেন, এই ভদ্রলোক জানেন না উনি কে। কেউ যদি তার পরিচয় জানেন, কাউন্টারে যোগাযোগ করুন। আমাদের চারপাশে এখন এই ভদ্রলোকের মতো নিজেকে না জানা লোকের ভিড়। আমরা নিজেকেই চিনি না, তাই নানান পরিচয়ে চেনানোর আকুল চেষ্টা। সত্য-মিথ্যা জানি না, ফেসবুকে একটা সাইনবোর্ড দেখেছি, ‘এই জমির মালিক বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ শহীদুল ইসলামের শ্যালক অমুকের।’ আহারে নিজের জমি রক্ষার কী আকুল চেষ্টা। জমি প্রসঙ্গে একটা পুরনো কৌতুক মনে পড়লো। কৌতুক হলেও ঘটনা সত্য। তখন স্বৈরাচার এরশাদের আমল। তখন জমিতে বেশিরভাগ সাইনবোর্ড দেখা যেত সেনা কর্মকর্তাদের। আমরা তখন বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে আড্ডা মারি। কেন্দ্রের চার কুতুব ছিলেন আহমেদ মাযহার, লুৎফর রহমান রিটন, আমীরুল ইসলাম ও আসলাম সানী। আমরা তাদের পেছনে ঘুর ঘুর করি। বকাঝকা খাই। আমাদের সবারই নুন আনতে পান্তা ফুরায় দশা। তো একদিন সানী ভাই খুব গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ভাবছি সাভারে একটা জমি কিনবো। সেখানে সাইনবোর্ডে লিখবো, ‘এই জমির মালিক লে. ক. আসলাম সানী টিএসসি।’ আমরা তো অবাক সানী ভাই জমি কেনার টাকা পাবেন কোথায়। তারচেয়ে বড় কথা, তিনি সাইনবোর্ডে মিথ্যা কথা লিখবেন। আমাদের বিস্ময়ের জবাবে সানী ভাই বললেন, এখানে কোনও মিথ্যা নেই, লে. ক. মানে হলো লেখক, কবি; আর টিএসসি মানে সারাদিন টিএসসিতে আড্ডা মারে। তবে পাবলিক মনে করবে লেফটেন্যান্ট কর্নেল; আর টিএসসিকে মনে করবে পিএসসির চেয়ে বড় কোনও ডিগ্রি। সানী ভাইয়ের কৌতুকে আমরা সবাই খুব মজা পেলাম। তবে তিন দশকেও এই পরিস্থিতি বদলায়নি, বরং আরও বেড়েছে।

আমরা সবাই ক্ষমতাশালী হতে চাই। ক্ষমতার ভয় দেখিয়ে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করতে চাই। অথচ চাইলে ভালোবেসে এরচেয়ে কম কষ্টে মানুষের হৃদয় জয় করা সম্ভব। ভালোবাসার কষ্ট আমরা করতে চাই না। ক্ষমতার দাপটে সব লন্ডভন্ড করে ফেলতে চাই। ভিকারুননিসা কলেজের প্রিন্সিপালের একটি টেলিফোন কথোপকথন ফাঁস হয়েছে। তাতে তিনি প্রতিপক্ষকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করছেন। নিজে একসময় পিস্তল নিয়ে ঘুরতেন, বালিশের নিচে পিস্তল রেখে ঘুমাতেন, সেই রেফারেন্স দিচ্ছেন। ছাত্রলীগ, যুগলীগ, যুব মহিলা লীগের হুমকি দিয়েছেন। নিজেকে ক্ষমতাশালী প্রমাণের চেষ্টা করছেন। কী অবস্থায় তিনি এমন কথা বলছেন, তাকে কারা উসকানি দিচ্ছেন; সে প্রসঙ্গ ভিন্ন। তিনি একজন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা, দেশের সবচেয়ে নামি কলেজের প্রিন্সিপাল; অন্যায়ের মোকাবিলা করার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। কিন্তু নিজের ক্ষমতার ওপর আস্থা রাখতে না পেরে তিনি রাজনীতি টেনে এনেছেন। অবশ্য বাংলাদেশের বাস্তবতায় ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাই সব ক্ষমতার উৎস। তাই তো সবাই আওয়ামী লীগ হতে চায়। গত এক যুগে বাংলাদেশে প্রায় সবাই আওয়ামী লীগ বনে গেছেন। বিপদের দিনে যাদের টিকিটিও দেখা যায়নি, তারাই এখন আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় শুভাকাঙ্ক্ষী। চকচকে মুজিব কোট পরে তারা ঘুরে বেড়ান। গোপালগঞ্জের আশপাশের জেলায় বাড়ি হলেও সবাই বলেন বাড়ি গোপালগঞ্জে। অন্য জেলার মানুষ গোপালগঞ্জে গিয়ে একটু জমি কিনে স্থায়ী ঠিকানা গোপালগঞ্জ বানিয়ে ফেলেছেন, এমন উদাহরণও কম নয়। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে এরা নিজেদের বগুড়া বা ফেনীর মানুষ বানানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন।

কোনও অপকর্ম করে কেউ ধরা পড়লেই দেখা যায়, তিনি আওয়ামী লীগের কোনও উপ-কমিটির সদস্য বা কোনও আওয়ামী দোকানের নেতা। ক্ষমতাবান লোকজনের সঙ্গে তারও ছবি আছে। রিজেন্ট কেলেঙ্কারির  সাহেদও আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক উপ-কমিটির সদস্য ছিলেন। ক্ষমতাবানদের সঙ্গে তার ছবির কোনও অন্ত নেই। ‘আওয়ামী চাকরিজীবী লীগে’র সভাপতির পরিচয় দিয়ে বিপাকে পড়া হেলেনা জাহাঙ্গীরও আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য ছিলেন। বিপাকে পড়ে তিনিও সরকারের মন্ত্রী আর আওয়ামী লীগ নেতাদের কথা বলছেন।

সবার হাতে হাতে ক্যামেরা থাকায় ক্ষমতা দেখানোর আরেক পন্থা হয়েছে ক্ষমতাবানদের সঙ্গে সেলফি। কোনও সামাজিক বা রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে গিয়ে এক ফাঁকে হয়তো ওবায়দুল কাদের বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা অন্য কোনও মন্ত্রী-এমপির সঙ্গে একটা সেলফি তুলে নিয়েছেন। ব্যস সেটা ফেসবুকে ব্যাপক প্রচার, বাসার ড্রইং রুমে বড় করে বাঁধাই করে রাখাই হলো ক্ষমতা দেখানোর আরেক কৌশল। নেতাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। একজন রাজনৈতিক নেতা কেউ ছবি তুলতে চাইলে মুখের ওপর না করতে পারেন না।

ক্ষমতা দেখানোর প্রবণতা সর্বত্র। কোনও কাজ বাগাতে, টেন্ডার পেতে, সুবিধা পেতে তিনি কাকে কাকে চেনেন তার ফিরিস্তি দিতে থাকেন। গাড়িতে ‘সাংবাদিক, ডাক্তার, পুলিশ, র‌্যাব, উকিল’ নানা সাইনবোর্ড লেখা থাকে। সবাই এই পরিচয়ে রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশকে ক্ষমতা দেখাতে চান। কয়েক দিন আগে লকডাউনের সময় পুলিশ এক ডাক্তারকে আটকালে তিনি এক মন্ত্রীকে ফোন করেছিলেন। ট্রাফিক পুলিশও এসবে অভ্যস্ত। একাধিকবার আমার গাড়িকে নানা কারণে আটকে মামলা দেওয়া হয়েছে, জরিমানা করা হয়েছে। আমি দ্রুত তা পরিশোধ করেছি। পরে পরিচয় জানতে পেরে তিনি বলেন, আগে বলবেন না আপনি সাংবাদিক। আমি তাকে বলি, যেটা অপরাধ সেটা সবার জন্যই অপরাধ। সাংবাদিকদের জন্য তো আলাদা আইন নেই। অনেকে এসে আমাকে বলেন, অমুককে একটু ফোন করে দেন। এই হলো নম্বর। আমি বলি, ভাই আমি তো তাকে চিনি না। কীভাবে ফোন করবো। তিনি বলেন, চিনতে হবে  না। ফোন করে আপনার পরিচয় দিলেই হবে। আমি তাকে বিনয়ের সঙ্গে ফিরিয়ে দিয়ে বলি, এটা সম্ভব নয়। তিনি মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে ফিরে যান। একজন অপরিচিত মানুষকে ফোন করে নিজের পরিচয় দিয়ে কীভাবে কোনও তদবির করা যায়, আমার মাথায়ই ঢোকে না। কিন্তু নিশ্চয়ই এমনটি ঘটে। নইলে তিনি সেটা বলবেন কেন।

শুরুতে যে টিভি বিজ্ঞাপনের সংলাপের কথা বলা হয়েছে, ‘তুমি জানো আমি কে’, এটি আসলে ভদ্রতা করে বানানো। বাস্তবে সবাই মনে মনে বলে, ‘তুই চিনস আমি কে’। যার সত্যি সত্যি দেওয়ার মতো পরিচয় আছে, তিনি কখনও বলেন না, তুমি চেন আমি কে। তার হয়ে অনেক মানুষ পরিচয় বলে দেবে। সূর্যের চেয়ে বালি বেশি গরম হয়। তাই যাদের দেওয়ার মতো পরিচয় নেই, তারাই বেশি হম্বিতম্বি করে। মানুষকে চেনানোর চেষ্টা না করে, আমরা যদি নিজেই আগে নিজেকে চেষ্টা করি, তাহলেই বরং লাভ বেশি, মর্যাদা বেশি। আমরা যেন এমন কর্ম করি, যাতে সবাই বলে, ওই দেখো অমুক যায়; তাহলেই মাথা উঁচু করে থাকা যায়, মর্যাদার সঙ্গে বাঁচা যায়।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

 
 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বৈধপথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধপথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
জয়পুরহাটে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও চট্টগ্রামে কাস্টমসে দুদকের অভিযান
জয়পুরহাটে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও চট্টগ্রামে কাস্টমসে দুদকের অভিযান
বাংলাদেশ ও আর্জেন্টিনা যেসব খেলায় সহযোগিতা প্রত্যাশী
বাংলাদেশ ও আর্জেন্টিনা যেসব খেলায় সহযোগিতা প্রত্যাশী
জনসচেতনতাই টেকসই উন্নয়নের পথ সুগম করতে পারে: স্পিকার
জনসচেতনতাই টেকসই উন্নয়নের পথ সুগম করতে পারে: স্পিকার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ