শ্বাসকষ্টে ভোগা বাবাকে নিয়ে বুধবার চট্টগ্রাম শহরে আসেন বাঁশখালীর বাসিন্দা ২১ বছর বয়সী যুবক নিশাত। করোনার উপসর্গ নিয়ে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাই ফ্লো অক্সিজেনের খোঁজে শহরে এসেও শেষ পর্যন্ত তা জোটেনি। কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে অনেক চেষ্টায় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি হলেও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ছাড়াই পরদিন মারা যান এই বৃদ্ধ।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে নিশাত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বুধবার রাতে হঠাৎ বাবার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। আমরা তাকে বাঁশখালীর একটা ক্লিনিকে নিয়ে যাই। সেখান থেকে আমাদের বলা হয় তাকে হাই ফ্লো অক্সিজেন দিতে হবে। তাই তাকে দ্রুত শহরে নিয়ে আসতে পরামর্শ দেওয়া হয়। এরপর আমরা দ্রুত শহরে নিয়ে আসি।’
দুরবস্থার বর্ণনা দিয়ে আরও বলেন, ‘শহরে এসেই বাবাকে নিয়ে আমরা প্রথমেই ন্যাশনাল হাসপাতালে যাই। সেখানে সিট খালি না থাকায় হলি ক্রিসেন্টের দিকে যাচ্ছিলাম। পথে এক আত্মীয় জানালেন, হলি ক্রিসেন্ট মূলত জেনারেল হাসপাতালেরই একটি ইউনিট। জেনারেল হাসপাতাল থেকেই সেখানে রোগী রেফার করা হয়। এজন্য আমরা জেনারেল হাসপাতালের দিকে অ্যাম্বুলেন্স ঘোরাতে বলি। এরপর জেনারেল হাসপাতালে না গিয়ে আমরা তাকে চমেক হাসপাতালে ভর্তি করাই। কিন্তু প্রথমে সেখানে কোনও সিট পাইনি। পরে হাসপাতালের বারান্দায় ছোট একটা জায়গায় বসার ব্যবস্থা করে সেখানেই একটা লাইনে অক্সিজেন দেওয়া হলো। এরপর সকাল ১০টার দিকে ন্যাশনাল থেকে জানানো হয় সেখানে একটা আইসিইউ বেড খালি হয়েছে। এটা শুনেই আমরা বাবাকে নিয়ে হাসপাতালের দিকে রওনা দিই। ন্যাশনাল হাসপাতালে পৌঁছার আগেই তিনি মারা যান।’
একইভাবে প্রথমে অক্সিজেন না পেয়ে বৃহস্পতিবার ভোরে নগরীর সার্জিস্কোপ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী তানজিদা মোরশেদ। বুধবার তার শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে তাকে প্রথমে মা ও শিশু হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে সিট খালি না থাকায় তাকে ডায়াবেটিস হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু অবস্থার অবনতি হওয়ায় রাতে তাকে সার্জিস্কোপ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার ভোরে তিনি মারা যান।
শুধু ৬০ বছর বয়সী এই বৃদ্ধ কিংবা শিক্ষার্থী তানজিদা মোরশেদ নয়, তাদের মতো অনেকেরই সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন না পেয়ে মৃত্যু হচ্ছে। করোনা চিকিৎসায় চট্টগ্রামে কোনও আইসিইউ খালি নেই। নেই কোনও সাধারণ বেডও। হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটছেন মানুষ। শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরেও একটু আশ্রয় পাচ্ছেন না চট্টগ্রামের অসংখ্য মানুষ। সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালে শয্যা বাড়িয়েও কোনও কূলকিনারা হচ্ছে না। প্রতিটি হাসপাতালেই ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত রোগী চিকিৎসাধীন। খালি নেই কোনও আইসিইউ বেড।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, চট্টগ্রামের সরকারি হাসপাতালগুলোতে কোভিড ডেডিকেটেড আইসিইউ রয়েছে ৪৩টি। এর মধ্যে সচল আছে ৩৫টি। এর প্রায় সব ক’টিইতেই রোগীতে পূর্ণ। পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে কোভিড ডেডিকেটেড আইসিইউ রয়েছে ১৩১টি। বেসরকারি হাসপাতালের ওইসব আইসিইউ বেডগুলো সব সময় রোগীতে পরিপূর্ণ থাকছে। আইসিইউ বেড পেতে রোগীর মৃত্যু অথবা সুস্থ হওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে।
একই অবস্থা সাধারণ বেডের ক্ষেত্রেও। করোনাভাইরাসের চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে সাধারণ ও আইসিইউ মিলিয়ে বেড রয়েছে ১৫৮টি। এই হাসপাতালের ধারণক্ষমতা সাধারণ বেড ১৪০ এবং আইসিইউ ১৮টি। শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত আইসিউ ১৮টিতেই এবং সাধারণ বেডে দেড় শতাধিক রোগী ভর্তি ছিলেন। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বিআইটিআইডিসহ সরকারি সব হাসপাতালের একই অবস্থা। এসব হাসপাতালের কোভিড ইউনিটে সাধারণ বেড এবং আইসিইউ বেড খালি নেই। জেনারেল হাসপাতালের ব্যবস্থাপনায় হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতালে কোভিড বিশেষায়িত হাসপাতাল করা হয়েছে। সেখানেও কোনও বেড ফাঁকা নেই।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে সিভিল সার্জন শেখ ফজলে রাব্বি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঈদের পর চট্টগ্রামে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালগুলোতে বেড সংকট দেখা দিয়েছে। সরকারি সব হাসপাতালে এখন ধারণক্ষমতার বেশি রোগী ভর্তি আছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে কিছু সিট খালি আছে। তবে ওইসব হাসপাতালে তো সবাই চিকিৎসা নিতে পারে না।’
এই মুহূর্তে চট্টগ্রামে আইসিইউ বেডের খুব সংকট জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘এই সংকট শুধু আমাদের না। সবখানে আইসিইউ বেড সংকট আছে। যে পরিমাণ রোগী, তত আইসিইউ বেড রাখা তো সম্ভব না। তবে আমরা নরমাল বেড বাড়ানোর জন্য চেষ্টা করছি। ইতোমধ্যে এটি বৈঠক হয়েছে। কয়েকটি হাসপাতালে বাড়ানো হচ্ছে। শুধু হাসপাতালে বেড বাড়িয়ে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যাবে না। আমদের স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।’