X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

গ্রেফতার মানেই মদ কেন?

আমীন আল রশীদ
০২ আগস্ট ২০২১, ১৬:৪৫আপডেট : ০২ আগস্ট ২০২১, ১৬:৪৫

আমীন আল রশীদ গৃহকর্মীকে নির্যাতনের অভিযোগে একসময়ের চিত্রনায়িকা একাকে আটক করেছে হাতিরঝিল থানা পুলিশ। ৯৯৯-এ ফোন পেয়ে শনিবার (৩১ জুলাই) বিকালে তাকে রাজধানীর উলনের বাসা থেকে আটক করা হয়। হাতিরঝিল থানার ওসি জানান, একার বাসা থেকে পাঁচ পিস ইয়াবা, ৫০ গ্রাম গাঁজা ও মদ উদ্ধার করা হয়েছে।

এর ঠিক একদিন আগে রাজধানীর গুলশান থেকে গ্রেফতার করা হয় সমালোচনার মুখে আওয়ামী লীগের উপ-কমিটির সদস্য পদ হারানো ব্যবসায়ী হেলেনা জাহাঙ্গীরকে। অভিযান শেষে র‌্যাব জানায়, হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ মদ, বিয়ার, বিদেশি মুদ্রা, চাকু, মোবাইল সেট, ক্যাসিনো সরঞ্জাম, এটিএম কার্ড ও হরিণের চামড়া উদ্ধার করা হয়েছে।

একই সময়ে পিয়াসা ও মৌ নামে আরও দুই নারীকে আটক করা হয়, যাদের একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য বলে দাবি করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী—যারা রাতে বিভিন্ন পার্টিতে গিয়ে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের টার্গেট করে বাসায় ডেকে আনতেন। এরপর বাসায় গোপনে তাদের আপত্তিকর ছবি তুলতেন। সেই ছবি বাবা-মা বা পরিবারের সদস্যদের দেখানোর ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করতেন। পয়লা আগস্ট রাতে রাজধানীর বারিধারা ও মোহাম্মদপুরে অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়। পুলিশ বলছে, তাদের বাসায় বিদেশি মদ ও ইয়াবা পাওয়া গেছে।

স্মরণ করা যেতে পারে, প্রয়াত বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদসহ অনেক রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এমনকি যুবলীগ নেতা সম্রাটসহ আরও অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিকে আটক বা গ্রেফতারের সময় তাদের বাসা থেকে মদ উদ্ধারের কথা জানানো হয়েছে। অথচ তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই অন্য অনেক অভিযোগ ছিল। প্রশ্ন হলো, এত অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও বাসা থেকে মদ উদ্ধারের কথা কেন বলা হয়? বড় ব্যবসায়ী বা প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের বাসায় দুই চার বোতল মদ থাকা কি খুব অস্বাভাবিক?

গৃহকর্মীকে নির্যাতন করা হয়েছে—শুধু এই অভিযোগই কি সাবেক চিত্রনায়িকা একার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেত না? বাসা থেকে মদ ও গাঁজা উদ্ধারের কথা কেন বলতে হলো? আসলেই কি বাসায় মদ ছিল? পিয়াসা ও মৌ নামে যে দুই নারীকে আটক করা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে যদি ব্ল্যাকমেইলের অভিযোগ থাকে, তাহলে এই অভিযোগেই কি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না? নাকি আসলেই তাদের বাসা থেকে মাদক উদ্ধার করা হয়েছে?

বাস্তবতা হলো, যেহেতু বাংলাদেশ একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ এবং এ দেশের মানুষের বড় অংশই ধর্মভীরু—ফলে কাউকে গ্রেফতারের সময় যদি মদ উদ্ধারের কথা বলা হয়, সেটি সামাজিকভাবে ওই ব্যক্তির প্রতি মানুষের ক্ষোভ তৈরিতে সহায়তা করে। তাকে সামাজিকভাবে অসম্মানিত করে। যাতে মানুষ তার আসল অপরাধটি আমলে না নিয়ে বরং তার বাসায় যে মদ পাওয়া গেছে এবং তিনি যে মদপান করেন, এটিই মুখ্য হয়ে ওঠে।

সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বাসায় গণহারে তল্লাশি চালানো হলে সম্ভবত অধিকাংশের বাসায়ই দুই চার বোতল মদ পাওয়া যাবে। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী লাইসেন্স ছাড়া মদপান করা বেআইনি হলেও অসংখ্য মদের দোকান বা বার রয়েছে। প্রতিটি অভিজাত ক্লাবেই বার রয়েছে। এসব ক্লাব ও বারে গিয়ে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ মদপান করেন বা কিনে নিয়ে আসেন—যাদের অধিকাংশেরই মদপানের লাইসেন্স নেই। এসব বার ক্লাবে প্রতিদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালায় না। যদি চালাতো তাহলে লাইসেন্স ছাড়া মদপান ও মদ কেনার অপরাধে প্রতিদিন কয়েক হাজার লোককে গ্রেফতারের করতে হতো।

মদ উদ্ধারের বিষয়ে হেলেনা জাহাঙ্গীরের মেয়ে জেসিয়া আলম সাংবাদিকদের বলেছেন, তার ভাই মদ পান করেন। সেগুলোই বাসায় ছিল। তবে ভাইয়ের মদপানের লাইসেন্স রয়েছে। আর হরিণের চামড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, তার ভাইয়ের বিয়ের সময়ে তার মায়ের সঙ্গে রাজনীতি করা নেতানেত্রীরা মিলে ওই চামড়াটি উপহার দিয়েছিলেন। যেটি দেয়ালে ঝোলানো ছিল। ক্যাসিনোর সরঞ্জামের বিষয়ে তিনি বলেন, সময় কাটানোর জন্য তারাই ক্যাসিনো খেলতেন। জেসিয়া বলেন, এটা বাসায় বসে তাস খেলার মতো।

জেসিয়ার এই কথার কতটুকু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আমলে আর সাধারণ মানুষ কতটুকু বিশ্বাস করবে—তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, দেশের আইন কী বলছে? ঘরে বসে খেলার জন্য কেউ কি ক্যাসিনো সরঞ্জাম রাখতে পারেন? ক্যাসিনো মূলত জুয়া। দেশের অসংখ্য ক্লাবে প্রতিনিয়তই জুয়া খেলা হয়। বাংলাদেশের সংবিধানে জুয়া খেলা নিষিদ্ধে রাষ্ট্র ব্যবস্থা নেবে বলে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু কতগুলো ক্লাবে জুয়া বন্ধ করা সম্ভব? মূলত পয়সাওয়ালারাই জুয়া খেলেন। পৃথিবীর অনেক দেশেই ক্যাসিনো বৈধ। সারা পৃথিবীর ধনী লোকেরা যুক্তরাষ্ট্রের লাস ভেগাস শহর এবং ইউরোপের ক্ষুদ্র রাষ্ট্র মোনাকোয় যান ক্যাসিনো খেলতে।

দেশে বন্যপ্রাণী আইন অনুযায়ী হরিণ শিকার নিষিদ্ধ। সেই হিসেবে কারও বাসায় হরিণের চামড়া পাওয়া গেলে এটা অবৈধ। কিন্তু কেউ যদি বিদেশ থেকে হরিণের চামড়া কিনে আনেন বা কেউ যদি এরকম উপহার পান, সেটি কি অবৈধ? অসংখ্য বড়লোকের বাসার ড্রয়িংরুমের দেয়ালে হরিণের চামড়া আছে। সব বাসায় অভিযান চালিয়ে কি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হরিণের চামড়া আটক করে বন্যপ্রাণী আইনে ওই বাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করবে? হরিণ শিকার আর বাসার দেয়ালে শখের বশে হরিণের চামড়া ঝুলিয়ে রাখা কি এক? অনুসন্ধানের বিষয় হলো, ওই হরিণের চামড়ার উৎস কী? কেউ যদি হরিণ শিকার করে তার চামড়া ঝুলিয়ে রাখেন বা দেশের কোনও বাজার থেকে হরিণের কাঁচা চামড়া কিনে নেন, সেটি নিশ্চয়ই বেআইনি। হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাসার দেয়ালে ঝুলানো হরিণের চামড়াটি কি অবৈধ?

হেলেনা জাহাঙ্গীরকে ধরার জন্য বা তাকে আইনের মুখোমুখি করার জন্য তার বাসা থেকে মদ, ক্যাসিনো সরঞ্জাম বা হরিণের চামড়া উদ্ধার করতে হবে কেন? তার বিরুদ্ধে মূল যেসব অভিযোগ, তার একটি বড় অংশই ক্ষমতার অপব্যবহার করে চাঁদাবাজি ও প্রতারণার। সুতরাং এই অভিযোগেই তো তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যায়। নাকি দেশের প্রচলিত আইনে মদ উদ্ধারের বিষয়টি বেশি স্পর্শকাতর এবং এই ইস্যুতে আসামিকে ‘সাইজ’ করা সহজ হয়?

হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে আরেকটি বড় অভিযোগ, তিনি ‘জয়যাত্রা’ নামে যে আইপি টেলিভিশন চালাতেন, সেটি অবৈধ। যদিও সম্প্রচার চ্যানেল হিসেবে যেসব সেটআপ থাকা দরকার তার সবকিছুই রয়েছে। সুতরাং একটি অবৈধ গণমাধ্যম চালানোর অভিযোগেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতো। যদিও দেশে আরও অসংখ্য আইপি টিভি রয়েছে, যেগুলোর আইনি বৈধতা নেই। এসব আইপি টিভির মূল কাজ চাঁদাবাজি—এমন অভিযোগও নতুন নয়। সুতরাং, যে যুক্তিতে ‘জয়যাত্রা’র বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেই একই যুক্তিতে অন্য সব আইপি টিভিও বন্ধ করে দেওয়া দরকার। অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, অনেক আইপি টিভির পেছনেই কোনও না কোনও প্রভাবশালী ব্যক্তি রয়েছেন।
উল্লেখ্য, গ্রেফতারের সময় শুধু মদ নয়, কারও কারও ক্ষেত্রে নারী ইস্যুও সামনে আনা হয়। যেমন, সম্প্রতি অভিনেত্রী পরীমনির দায়ের করা মামলায় ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে তিন নারীকেও গ্রেফতার করা হয়— যাদের ‘রক্ষিতা’ বলে পরিচয় দেওয়া হয়। প্রথম কথা হচ্ছে, পুলিশ কোনও নারীকে ‘রক্ষিতা’ বলে গণমাধ্যমের সামনে পরিচয় দিতে পারে কিনা? রক্ষিতা মানে কী? রাষ্ট্রের কোন আইনে রক্ষিতা শব্দটি রয়েছে এবং কোন কোন মানদণ্ডে একজন নারীকে রক্ষিতা বলা যায়? তারও চেয়ে বড় প্রশ্ন, পরীমনির মামলা ব্যবসায়ী নাসিরের বিরুদ্ধে। তাহলে ওই তিন নারীকে কেন গ্রেফতার করা হলো? তাদের অপরাধ কী? ঘটনার সময় কি তারা নাসির উদ্দিনের সঙ্গে ছিলেন? কেন তাদের রিমান্ডে নেওয়া হলো?
সুতরাং, কোনও অপরাধীকে গ্রেফতার করা হলে আমরা খুশি হই এটা যেমন ঠিক, তেমনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোন শব্দ ব্যবহার করে, কী কী তথ্য দেয়, কোন প্রক্রিয়ায় কাকে গ্রেফতার বা আটক করে, সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয় কিনা, রিমান্ডের নামে আসলে কী হয়—এসব প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।  

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন। 

 
 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দিন দিন নাবিকদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করছে দস্যুরা
দিন দিন নাবিকদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করছে দস্যুরা
হলমার্কের দুর্নীতির এক মামলার রায় আজ
হলমার্কের দুর্নীতির এক মামলার রায় আজ
৫ ঘণ্টা পর ঢাকার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের ট্রেন চলাচল স্বাভা‌বিক
৫ ঘণ্টা পর ঢাকার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের ট্রেন চলাচল স্বাভা‌বিক
সুইডেনের বিপক্ষে পর্তুগাল দলে জায়গা হয়নি রোনালদোর
সুইডেনের বিপক্ষে পর্তুগাল দলে জায়গা হয়নি রোনালদোর
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ