X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

রবীন্দ্রনাথের পারস্য মুগ্ধতা

মোস্তফা তারিকুল আহসান
০৬ আগস্ট ২০২১, ০০:২৯আপডেট : ০৬ আগস্ট ২০২১, ০০:২৯

পৃথিবীর সেরা পর্যটকের তালিকা করলে রবীন্দ্রনাথের নাম তাতে যুক্ত হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভ্রমণ করেছিলেন বলা যায়। এবং একজন কবির চোখে সে ভ্রমণের নানা বর্ণনার কথাও আমরা জানি। পৃথিবীকে, পৃথিবীর মানুষ ও জনপদ দেখা এবং তাকে উপলব্ধির আলোয় বর্ণনা করার ক্ষমতা ছিল কবি রবীন্দ্রনাথের। প্রতিটি ভ্রমণের আগে তিনি প্রস্তুতি নিতেন, ইতিহাস থেকে জেনে নিতেন সেই সব অঞ্চলের নানান তথ্য। আর পরে লিখতেন সেই ভ্রমণবৃত্তান্ত। নানা রঙে, বর্ণে, বিভায় ইতিহাস-রাজনীতি-ধর্ম-পুরাণ আর নিজের আততি নিয়ে সেই হয়ে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ। পাঠক হিসেবে রবীন্দ্রনাথের এই জাতীয় রচনা খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় বিশেষত কবির অনুভবঋদ্ধ বর্ণনা আমাকে গভীরভাবে আলোড়িত করে। জহিরউদ্দীন মুহম্মদ বাবুর, ইবনে বতুতা, হিউয়েন সাং প্রমুখ প্রাচীন পর্যটক ও তাদের লেখাপত্রও আমাদের চিন্তাজগতে আলোড়ন তোলে। প্রাচীন জীবনযাপন, সংস্কৃতি সভ্যতা আচরণ ইত্যাদি বিষয়ে এসব লেখা আমাদের প্রাণিত করে। রাজা বা সম্রাটগণ যেসব বর্ণনা দিয়েছেন তার সামান্য অংশই আমাদের স্পর্শ করে, সেখানে রাজ্যবিস্তার, উত্তরাধিকার, সংঘাত নিয়ে বেশিরভাগ কথাবার্তা লক্ষ করা যায়। তবে মাঝে কারোর লেখায় আমরা গভীর কিছু অনুভব পেয়ে যাই যা নতুন এবং আমাদের চোখে আবিষ্কারের নেশা ধরিয়ে দেয়। যেমন, বাবুরনামায় বাবুর লিখেছেন : ‘শাবান মাসে সূর্য যখন কুম্ভ রাশিতে আমি তখন কাবুল থেকে হিন্দুস্থান পানে যাত্রা করলাম। বাদাম চশমা ও জাগদালিকের পথ ধরে ছদিনের দিন আমরা আদিনাপুর এসে পৌঁছলাম। এর পূর্বে কোনো উষ্ণ দেশ বা হিন্দুস্থান দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। আদিনাপুর এসে যখন পৌঁছলাম তখন সম্পূর্ণ অভিনব জগতের দৃশ্য আমার চোখের সম্মুখে ভেসে উঠল। আমি দেখলাম, এ জগতের ঘাস পৃথক; এখানকার বনজন্তু আলাদা, এর পাখি আলাদা। এমনকি এ নতুন জগতের যাযাবর জাতি ইল এবং উলুসদের আচার-আচারণ আলাদা। আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম।’ নিজের জন্মস্থান ফরগনার বর্ণনা তিনি দিয়েছেন একজন কবির মতো করে। প্রতিটি জেলার স্বতন্ত্র নৈসর্গিক পরিচয় দিয়েছেন, দিয়েছেন প্রাকৃতিক অবস্থানের বৈচিত্র্যপূর্ণ বর্ণনা; তার সাথে মিলিয়ে দেখেছেন পৃথিবীর অন্য জনপদকে। রবীন্দ্রনাথ ও বাবুরনামা পড়েছিলেন এবং বাবুরের অনেক মন্তব্য তিনি উদ্ধৃত করেছেন তাঁর লেখায়।
রবীন্দ্রনাথ যখন পারস্যে ভ্রমণে যান তিনিও বিস্মিত হয়ে দেখেছিলেন পারস্যের জীবন সংস্কৃতি প্রকৃতি ও মানুষের আচার-আচরণ, তাদের ধর্ম দর্শন মতাদর্শ ও জীবনযাপনপদ্ধতি। পারস্য প্রাচীন সভ্যতা সাহিত্য সংস্কৃতির অন্যতম পীঠস্থান। ফার্সি সাহিত্যের কবিরা পৃথিবীকে নতুন চিন্তার জগতে নিয়ে গেছেন। রুমি, ইবনে সিনা, ওমর খৈয়ম, সানায়ি, হাফিজ, সাদী, আত্তার থেকে অজস্র কবিরা যে কবিতা লিখেছেন তা আমাদের মানসিক জগৎকে প্রসারিত করে, আমাদেরকে চিন্ময় অনুভূতির জগতে নিয়ে যায়। ব্যাবিলনীয়, আকামেনীয়, সাসানীয় সভ্যতার অন্যতম পাদপীঠ পারস্য বহুদিন ধরে কবির মনে স্থান করে নিয়েছিল। পারস্যের রাজা রেজা শাহ পাহলভি কবিকে সে দেশ ভ্রমণের আমন্ত্রণ করলে তিনি আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন যদিও তার বয়স হয়েছিল তখন সত্তর বছর। পারস্য তার মনে কতটা স্থান জুড়ে ছিল তার উদাহরণ পারস্যে লেখার প্রতি ছত্রে ছত্রে রয়েছে। মুসলমান সমাজ সভ্যতা, বাহাই, জরথুস্ত্রু সম্প্রদায় ও তাদের ইতিহাস, যাযাবরদের জীবনযাত্রা এবং পারস্যের অতীত ইতিহাস বিশেষত ফার্সি কবিতার গভীর ভুবন কবিতে মথিত করেছিল। ১১ এপ্রিল, ১৯৩২ তিনি যাত্রা শুরু করেন। তিনি আমন্ত্রণ পবার পর লিখেছেন।‘ দেশ থেকে বেরবার বয়স গেছে এইটেই স্থির করে বসেছিলাম। এমন সময় পারস্যরাজের কাছ থেকে নিমন্ত্রণ এল। মনে হল এ নিমন্ত্রণ অস্বীকার অকর্তব্য হবে। তবু সত্তর বছরের ক্লান্ত শরীরের পক্ষ থেকে দ্বিধা ঘোচে নি। বোম্বাই আমার পারসী বন্ধু দিনশা ইরানী ভরসা দিয়ে লিখে পাঠালেন যে, পারস্যের বুশেয়ারা বন্দর থেকে তিনিও হবেন আমার সঙ্গী। তা ছাড়া খবর দিলেন যে, বোম্বাইয়ের পারসিক কনসাল কেহান সাহেব পারসিক সরকারের পক্ষ থেকে আমার যাত্রার সাহচর্য ও ব্যবস্থার ভার পেয়েছেন।’
কবি অত্যন্ত অনুপুঙ্খভাবে তার যাত্রার প্রতিটি পদক্ষেপের বর্ণনা দিয়েছেন, সাথে দিয়েছেন প্রয়োজনীয় তথ্য-ইতিহাস, জনমানুষের ব্যবহারজনিত পরিচয়, প্রকৃতির নানা উপাচার এবং নিজের মন্তব্য-প্রতিক্রিয়া। কোনো কিছু তাঁর চোখে বাদ পড়েনি। কবির সূক্ষ্ম রসবোধ, ভারতবর্ষের সাথে পারস্যের সংযোগ, পারস্যের ঐতিহ্য-গৌরবগাথার কথা আমরা খুব সবিস্তারে এখানে পাই। কবি রবীন্দ্রনাথের মনন রুচি বৈদগ্ধচেতনা এখানে প্রকাশিত হয়েছে সুন্দরভাবে। পারস্য নিয়ে কবির সার্বিক মনোভাব এখানে রয়েছে, রয়েছে তার মুগ্ধতা যা অফুরান মনে হয় কখনো কখনো। এ ক্ষুদ্র লেখায় আমরা কবির এই লেখায় পারস্য মুগ্ধতার কিছু উদাহরণ দেবার চেষ্টা করব, পাশাপাশি পারস্য সম্পর্কিত তাঁর কিছু বিশ্লেষণ পর্যালোচনা করব।
ইরানের প্রায় সব শহর ও ইরাকের বাগদাদ (কবি লিখেছের বোগদাদ) কবি এই সফরে ঘুরে দেখেছিলেন। প্রথমে ঢুকেছিলেন বুশেয়ার (১৩ই এপ্রিল) শহরে বায়ুতরিতে করে। এর আগে তিনি যেতেন সমুদ্রপথে। শরীর সায় দেবে না ভেবে বিমানে করে গিয়েছিলেন পারস্যে। তবে ভেতরের ভ্রমণ ছিলো নানা উপায়ে। কবি পুত্রবধু, কবির সচিব অমিয় চক্রবর্তী সাথে ছিলেন। কবি উড়োজাহাজ প্রসঙ্গে বাল্যের স্মৃতি জুড়ে দিয়েছেন। এই জুড়ে দেওয়া কথমালাগুলো এই রচনার মুক্তমালা যা আমাদের গভীরভাবে আকর্ষণ করে। যেমন বুশেয়ার থেকে আবার বায়ুযানে ওঠার আগে কবি লিখেছেন : মনে পড়ে ছাদের ঘর থেকে দুপুর-রৌদ্রে চিলের ওড়া চেয়ে চেয়ে দেখতাম; মনে হত দরকার আছে বলে উড়ছে না। বাতাসে যেন তার অবাধ গতির অধিকার আনন্দবিস্তার করে চলেছে। সেই আনন্দের প্রকাশ কেবল গতিসৌন্দর্যে তা নয়, তার রূপসৌন্দর্যে। নৌকার পালটাকে বাতাসের মেজাজের সঙ্গে মানান করে রেখে চলতে হয়, সেই ছন্দ রাখবার খাতিরে পাল দেখতে সুন্দর হয়েছে। পাখির পাখাও বাতাসের সাথে মিল করে চলে, তাই এমন তার সুষমা। আবার সেই পাখায় রঙের সামঞ্জস্যও কত। এই তো প্রাণীর কথা, তার পরে মেঘের লীলা—সূর্যের আলো থেকে কত রকম রঙ ছেঁকে নিয়ে আকাশে বানায় খেয়ালের খেলাঘর। মাটির পৃথিবীতে চলায় ফেরায় দ্বন্দ্বের চেহারা, সেখানে ভারের রাজত্ব, সকল কাজের বোঝা ঠেলতে হয়। বায়ুলোকে এতকাল যা আমাদের মন ভুলিয়েছে সে হচ্ছে ভারের অভাব, সুন্দরের সহজ সঞ্চরণ।’ কবি আত্মার ছবি ভেসে ওঠে এ কথামালায়। এরপর তিনি আরো গভীর করে তুলনা করেন বায়ুযানের সাথে প্রকৃতির গতিসৌন্দর্যযানের। তিনি অনুভব করেন পাখি বা নৌকার যে গতি বাতাসের সাথে মিতালি করে আধুনিক বিমান তা করতে পারে না। সেখানে প্রকৃতির সরসতা নেই আছে জোর বা অহমিকা। তিনি লিখেছেন : এতদিন পরে মানুষ পৃথিবী থেকে ভারটাকে নিয়ে গেল আকাশে। তাই তার ওড়ার যে চেহারা বেরল সে জোরের চেহারা। তার চলা বাতাসের সঙ্গে মিল করে নয় বাতাসকে পীড়িত করে; এই পীড়া আজ ভূলোক থেকে গেল দ্যুলোকে। এই পীড়ায় পাখির গান নেই, জন্তুর গর্জন আছে। ভূমিতল আকাশকে জয় করে আজ করছে।’ এই অসাধারণ তুলনা দেবার পর কবি যখন বায়ুযানে আবার উঠলেন তখন মনে এল নতুন ভাবনা। বিজ্ঞানের উন্নতিতে আকাশ দখল করে চলার যে অধিকার মানুষ পেল তা তাকে মানবতার বাইরে নিয়ে গেল, সুবিধে খানিকটা হল বটে তবে মানুষের গর্ব ও অহংকার প্রচুর পরিমাণে বেড়ে গেল। এই বেগ তাকে অমানবিকতার দিকে নিয়ে গেল। কবির এই ব্যাখ্যা সত্যি গভীর অনুসন্ধানমূলক এবং আধুনিক পৃথিবীর জন্য খুবই কার্যকরী ভাবনা। কবির মুখে তাঁর অনুভূতি শোনা যাক : বায়ুতরী যতই উপরে উঠল ততই ধরণীর সঙ্গে আমাদের পঞ্চইন্দ্রয়ের যোগ সংকীর্ণ হয়ে একটা মাত্র ইন্দ্রিয়ে এসে ঠেকল, দর্শন ইন্দ্রিয়ে, তাও ঘনিষ্ঠভাবে নয়। নানা সাক্ষ্য মিলিয়ে যে পৃথিবীকে বিচিত্র ও নিশ্চিত করে জেনেছিলুম সে ক্রমে এল ক্ষীণ হয়ে, যা ছিল তিন আয়তনের বাস্তব তা হয়ে এল দুই আয়তনের ছবি ... মনে হল, এমন অবস্থায় আকাশযানের থেকে মানুষ যখন শতঘ্নী বর্ষণ করতে বেরয় তখন সে নির্মমভাবে ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে; যাদের মারে তাদের অপরাধের হিসাববোধ উদ্যত বাহুকে দ্বিধাগ্রস্ত করে না, কেননা হিসেবের অঙ্কটা অদৃশ্য হয়ে যায়। যে বাস্তবের ‘পরে মানুষের স্বাভাবিক মমতা, সে যখন ঝাপসা হয়ে আসে তখন মমতারও আধার যায় লুপ্ত হয়ে।’
পারস্যের রাজা তাকে আমন্ত্রণ করেছিলেন বলেই নয় কবির পারস্যমুগ্ধতা ছিল বাল্যকাল থেকে। পারস্যের রাজা কবিকে অভিবাদন দেবার পর কবি যে জবাব দিয়েছিলেন তা থেকে কবির পারস্যমুগ্ধতা প্রকাশ পায়। কবি লিখেছেন : একদিন দূর থেকে পারস্যেও আমার কাছে পৌঁচেছিল। তখন আমি বালক। সে পারস্য ভাবরসের পারস্য, কবির পারস্য। তার ভাষা যদিও পারসিক, তার বাণী সকল মানুষের। আমার পিতা ছিলেন হাফেজের অনুরাগী ভক্ত। তাঁর মুখ থেকে হাফেজের কবিতার আবৃত্তি ও তার অনুবাদ অনেক শুনেছি। সেই কবিতার মাধুর্য দিয়ে পারস্যের হৃদয় আমাদের হৃদয়ে প্রবেশ করেছিল। আজ পারস্যের রাজা আমাকে আমন্ত্রণ করেছেন, সেই সঙ্গে সেই কবিদের আমন্ত্রণও মিলিত। আমি তাঁদের উদ্দেশে আমার সকৃতজ্ঞ অভিবাদন অর্পণ করতে চাই যাঁদের কাব্যসুধা জীবনকাল পর্যন্ত আমার পিতাকে এত সান্ত্বনা এত আনন্দ দিয়েছে।’ কবির আফসোস ছিল তিনি যে ভাষায় কথা বলছেন তা তারা জানেন না এবং তরজমার মাধ্যমে কবির বক্তব্য তাদেও কাছে সম্পূর্ণভাবে পৌঁছাবে না। কবি মাতৃভাষায় না বলার কারণে তাঁর বক্তব্যে কিছু আড়ষ্ঠতা ছিল সেটাও তিনি উল্লেখ করেছেন। কবি হাফিজের সমাধি দেখার সময় বলেছেন : বেরলুম. পিতার তীর্থস্থানে আমার মানস-অর্ঘ্য নিবেদন করতে। রাজাকে কবি বলেছেন তাদের অর্জন সম্পর্কে। রাজা যে সম্প্রদায়বিরোধিতার অসভ্য হিংস্রতাকে উনমূলিত করতে পেরেছেন তা জেনে কবি প্রীত হয়েছেন। কবির কিছু বই রেশমের কাপড়ে বাধাই করে রাজাকে উপহার দেওয়া হল। তাতে ছিল কবির রচিত একটি চিত্রপটে বাংলা কবিতা ও তার ইংরেজি তরজমা। বাংলায় লেখাটি এরকম : আমার হৃদয়ে অতীত স্মৃতির/ সোনার প্রদীপ এ যে/ মরিচা—ধরানো কালের পরশ/ বাঁচয়ে রেখেছি মেজে।/ তোমরা জ্বেলেছ, নতুন কালের/ উদার প্রাণের আলো—/ এসেছি, হে ভাই, আমার প্রদীপে/ তোমার শিখাটি জ্বালো।’
এশিয়ার এই রাজ্য তার শৌর্য ও উদারনৈতিক চরিত্র ছড়িয়ে দিচ্ছে সবদিকে। কবি রাজার কার্যক্রমের পর্যালোচনা করেছেন অনেক স্থানে, মূল্যায়ন করেছেন : ‘বর্তমান পারস্যরাজের চরিতকথা আমার আপন দেশের প্রান্তে বসেও শুনেছি এবং সেই সঙ্গে দেখতে পেয়েছি দূরে দিকসীমায় নবপ্রভাতের সূচনা। বুঝেছি, এশিয়ার কোনোস্থানে যথার্থ একজন লোকনেতারূপে স্বজাতির ভাগ্যনেতার অভ্যুদয় হয়েছে—তিনি জানেন কী করে বর্তমান যুগের আত্মরক্ষণ-উপযোগী শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে, কী করে প্রতিকূল শক্তিকে নিরস্ত করতে হবে, বিদেশ থেকে যে সর্বগ্রাসী লোভের চক্রবাত্যা নিষ্ঠুর বলে এশিয়াকে চারি দিকে আঘাত করতে উদ্যত কী করে তাকে প্রতিহত করা সম্ভব।’ রবীন্দ্রনাথ পারস্যকে ভালবাসতেন তার অজস্র উদাহরণ এই ভ্রমণবৃত্তান্তে রয়েছে। তিনি যে প্রস্তুতি নিয়ে এ রচনা শুরু করেছিলেন সেটা তো স্পষ্ট তবে তার পারস্যঅনুরাগ পূর্ব থেকেই ছিলো। ইরানে থাকতেই কবির জন্মদিন এসে যায় এবং তা সাড়ম্বরে পালিত হয়, বহু মানুষ কবিকে অভিনন্দন জানাতে আসেন, উপহার দেন। সবাইকে অভিবাদনের জবাবে তিনি একটি কবিতা রচনা করেন। এই কবিতার ইংরেজি তরজমাই তিনি পারস্যবাসীকে শোনান তবে কবিতাটি বাংলায়ও লিখিত হয়েছিল। কবির পারস্যমুগ্ধতার কিছু উদাহরণ এখানে স্পষ্ট হয় : ইরান, তোমার বীর সন্তান/ প্রণয়-অর্ঘ্য করিয়াছে দান/ আজি এ বিদেশী কবির জন্মদিনে,/ আপনারে বলি নিয়েছে তাহারে চিনে।’

ইরান থেকে ফেরার সময় কবি ইরানের জনগণ ও রাজার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান, তাদের অভিবাদনের উত্তর দেন। সেই উত্তরের মধ্যে কবি পারস্যদেশের প্রতি, জনগণের প্রতি কবির অকুণ্ঠ ভালোবাসা কৃতজ্ঞতা ও পক্ষপাতের কথা আবেগের সঙ্গে উচ্চারণ করেন : আজ শেষ পর্যন্ত তোমাদের কাছে বিদায় নেবার সময় এসেছে, কৃতজ্ঞতায় ভরা আমার এই হৃদয়খানি তোমাদের দেশে রেখে গেলাম... অবশেষে দেখা গেল নবজাগরণের আলোকরশ্মি। এই মহাদেশের অন্তরের মধ্যে একটা স্পন্দমান জীবনের কম্পন ক্রমেই যেন নিবিড় আত্মোপলব্ধির মধ্যে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। এই পূর্ণ মুহূর্তে আজ আমি কবি তোমাদের কাছে এসেছি নবযুগের শুভপ্রভাত ঘোষণা করতে, তোমাদের দিগন্তের অন্ধককার ভেদ করে যে আলোক ফুটে উঠেছে সেই আলোককে অভিনন্দন করতে—আমার জীবনের মহৎ সৌভাগ্য আজ তোমাদের কাছে এলাম। জয় হোক ইরানের।’
পারস্য ভ্রমণবৃত্তান্ত লিখতে গিয়ে তিনি পৃথিবীতে মানবসভ্যতার নানা পর্ব ও উত্থানের কারণ ও উৎস সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। এশিয়াকে কীভাবে ইউরোপ দখল করল, কীভাবে প্রাচ্য জেগে উঠতে চেয়েছিল, তার ওপর কীভাবে অত্যাচার হয়েছে, জাপান ইউরোপের শৌর্যকে গ্রহণ কী ভুল করেছিল, তুর্কী তাতারদের কাণ্ড, পারস্য কীভাবে জেগে ওঠল সভ্যতার সোপান ধরে ইত্যকার নানা বিষয়ে তিনি গভীর তাৎপর্যময় কথা বলেছেন। কবির ইতিহাস পাঠ যে কত গভীর ও সমসাময়িক তা বোঝা যায় এ রচনায়। এর পাশাপাশি তিনি ভারতবর্ষ, আর্যজাতি, পারস্য সভ্যতা সম্পর্কে যে মূল্যায়ন করেছেন তা অভাবনীয়। ভ্রমণবৃত্তান্ত যে কত গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে তা পারস্যে বোঝা যাবে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর টালমাটাল পৃথিবী নিয়ে কবি অনেক মন্তব্য করেছেন। ইউরোপ যে শক্তি দেখিয়েছে তার বিরুদ্ধে তিনি কথা বলেছেন যুক্তি দিয়ে। এশিয়ার জাগরণ যেভাবে হওয়ার কথা সেভাবে হয়নি বা হতে পারেনি। তিনি লিখেছেন : আমি এই কথা বলি, এশিয়া যদি সম্পূর্ণ না জাগতে পারে তা হলে য়ুরোপের পরিত্রাণ নেই। এশিয়ার দুর্বলতার মধ্যেই ইউরোপের মৃত্যুবাণ। এই এশিয়ার ভাগবাটোয়ার নিয়ে যত তার চোখ-রাঙারাঙি, তার মিথ্যে কলঙ্কিত কূটকৌশলের গুপ্তচরবৃত্তি। ক্রমে বেড়ে উঠেছে সমরসজ্জার ভার, পণ্যের হাট বহুবিস্তৃত করে অবশেষে আজ অগাধ ধনসমুদ্রের মধ্যে দুঃসহ করে তুলেছে দারিদ্র্যতৃষ্ণা।’ পারস্যের গৌরব নিয়ে তিনি বিস্তারিতভাবে বলেছেন, বলেছেন শেকড়ের কথা, আর্যসংস্রবের কথা, বীরদের কথা, ধর্মপালনের কথা, মুসলিম হওয়ার পরও তাদেও পুরনো সংস্কৃতিকে লালন করার কথা। পারস্যের সাথে ভারত বর্ষের কোথায় যোগ কোথায় অন্বয় সে কথাও কবি বলেছেন স্পষ্ট করে। পারস্য সভ্যতার গোড়ার কথা বলতে গিয়ে কবি লিখেছেন : পারস্যের ইতিহাস যখন শাহনামার পুরাণকথা থেকে বেরিয়ে এসে স্পষ্ট হয়ে উঠল তখন পারস্যে আর্যদের আগমনের হাজার বছর পেরিয়ে গেছে। তখন দেখি আর্যজাতির দুই শাখা পারস্য-ইতিহাসের আরম্ভকালকে অতিক্রম করে আছে, মীদিয় এবং পারসিক। মীদিয়রা প্রথমে এসে উপনিবেশ স্থাপন করে, তারপর পারসিক। এই পারসিকদের দলপতি ছিলেন হখমানিশ। তাঁরই নাম অনুসারে এই জাতি আকামেনিড আখ্যা পায়। খ্রিষ্টজন্মের সাড়ে-পাঁচশ পূর্বে আকামেনীয় পারসিকেরা মীদিয়দের শাসন থেকে সমস্ত পারস্যকে মুক্ত করে নিজেদের অধীনে একচ্ছত্র করে। সমগ্র পারস্যেও সেই প্রথম অদ্বিতীয় সম্রাট ছিলেন বিখ্যাত সাইরাস, তাঁর প্রকৃত নাম খোরাস। তিনি শুধু যে সমস্ত পারস্যকে এক করলেন তা নয়, সেই পারস্যকে এমন এক বৃহৎ সাম্রাজ্যের চূড়ায় অধিষ্ঠিত করলেন সে যুগে তার তুলনা ছিল না।’
বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথে পারস্যমুগ্ধতার কারণের পেছনে যুক্তিও তিনি তুলে ধরেছেন নানা উদাহরণ দিয়ে। হত্যা লুণ্ঠনের ইতিহাস তো অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই তবে পারস্য মানবতা ও সভ্যতাকে গ্রহণ করেছিল সেটাও মনে রাখা প্রয়োজন। ভারতবর্ষের মুসলমানদের নিয়ে কবি প্রবন্ধ লিখেছিলেন, গল্প লিখেছিলেন সেখানে কবি মুসলিমসম্প্রদায় নিয়ে তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করেছিলেন। পারস্যে এসে তিনি পারসিক মুসলমানদের আচার-আচরণ, বা রাজাদের অসাম্প্রদায়িক আচরণ, যাযাবরদের চেতনা নিয়ে প্রশংসাসূচক মন্তব্য করেছেন। এমনকি ভারতবর্ষে যে হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব তার উদাহরণ পারস্যের প্রসঙ্গে তাদের মুখের কথায় ব্যাখ্যা করেছেন। যে বোধ যাযাবরদের মধ্যে আছে তা ভারতীয়দের নেই সেটা কবি উপলব্ধি করেছেন। পারস্যের অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় কবির নজরে এসেছে। পারস্যবাসীর প্রকৃতি প্রেমের কথা কবি অনেকবার বলেছেন। একটা ছোট বর্ণনা পড়া যাক : আজ সকালে নির্মল আকাশ, স্নিগ্ধ রৌদ্র। দোতলায় একটি কোণের বারান্দায় বসেছি। নীচের বাগানে এল্ম পপলার উইলো গাছে বেষ্ঠিত ছোট জলাশয় ও ফোয়ারা। দূরে গাছপালার মধ্যে একটি মসজিদের চূড়া দেখা যাচ্ছে, যেন নীল পদ্মের কুঁড়ি, সুচিক্কণ নীল পারসিক টালি দিয়ে তৈরি, এই সকাল বেলাকার পাতলা মেঘে-ছোঁওয়া আকাশের চেয়ে ঘনতর নীল।’ এই বর্ণনার পাশে আর একটি বর্ণনা রাখা যায় যেখানে কবি স্বীকার করেছেন ধর্মীয় আচারের দিক দিয়ে মুসলমানরা বেশ উদার। তিনি মসজিদে ঢুকেছেন অনেকস্থানে। একটি স্থানের কথা বলেছেন এভাবে : এই মসজিদের প্রাঙ্গনে যাদের দেখলেম তাদের মোল্লার বেশ। নিরুৎসুক দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখলেম হয়তো মনে প্রসন্ন হয়নি। শুনলুম আর দশ বছর আগে এখানে আমাদের প্রবেশ সম্ভবপর হত না। শুনে আমি যে বিস্মিত হব সে রাস্তা আমার নেই। কারণ, আর বিশ বছর পরেও পুরীতে জগন্নাথের মন্দিরে আমার মত কোনো ব্রাত্য যে প্রবেশ করতে পারবে সে আশা করা বিড়ম্বনা।’
এই সব মোল্লারা কবির কাছে অন্য সময় নানাবিধ দার্শনিকসুলভ প্রশ্ন করেছেন। একজন মোল্লা কবিকে বললেন, নানা জাতির নানা ধর্মগ্রন্থে নানা পথ নির্দেশ করে, তার মধ্যে সত্যপথ নির্ণয় করা যায় কী উপায়ে? কবি বলেছেন : ঘরের দরজা জানালা সব বন্ধ করে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে। আলো পাবো কী উপায়ে’ তাকে কেউ উত্তর দেয় চকমকি ঠুকে—কেউ বলে তেলের প্রদীপ, কেউ বলে মোমের বাতি, কেউ বলে ইলেকট্রিক আলো জ্বেলে। সেই-সব উপকরণ ও প্রণালী নানাবিধ, তার ব্যয় যথেষ্ট, তার ফল সমান নয়। যারা পুঁথি সামনে রেখে কথা কয় না, যাদেও সহজ বুদ্ধি, তারা বলে, দরজা খুলে দাও। ভালো হও, ভালোবাসো, ভালো করো, এইটেই পথ। যেখানে শাস্ত্র এবং তত্ত্ব এবং আচারবিচারের কড়াকড়ি সেখানে ধার্মিকদের অধ্যবসায় কথা-কাটাকাটি থেকে শুরু করে গলা-কাটাকাটিতে গিয়ে পৌঁছয়।’ পারস্য যেভাবে তাদের ধর্ম সংস্কৃতির বোধকে পাকাপোক্ত করেছে মানবিক বিবেচনায় তা কবিকে প্রাণিত করেছিল। কবি নিজেই যে মানবিক অসাম্প্রদায়িক সমাজের স্বপ্ন দেখতেন অথচ ধর্মকে অস্বীকার করতেন না সেরকম পরিবেশ তিনি পারস্যে দেখেছেন। তাদের সুফি মতাদর্শের বিকাশই প্রমাণ করে যে তারা ধর্ম দিয়ে চিন্তা বিকাশে বাধা দিতে চাননি। সুফি কবিদের এই চিন্তার স্বাধীনতা সুযোগ ছিল বলে তারা বড় কবি হতে পেরেছেন। আমরা সেটা পারিনি।
কবি এক অভিবাদনের জবাবে আরব সংস্কৃতির গৌরব ও ঐশ্বর্য নিয়ে তাঁর পক্ষপাতের কথা বলেছেন। পারস্যে গিয়েই তিনি বললেন সবার সামনে তবে একথা তাঁর মনে ছিল আগে থেকেই : একদা আরবের পরম গৌরবের দিনে পূর্বে পশ্চিমে পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক ভূভাগ আরব্যের প্রভাব-অধীনে এসেছিল। ভারতবর্ষে সেই প্রভাব যদিও আজ রাষ্ট্রশাসনের আকারে নেই, তবু সেখানকার বৃহৎ মুসলমানসম্প্রদায়কে অধিকার করে বিদ্যার আকারে, ধর্মের আকারে আছে। সেই দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিয়ে আমি আপনাদের বলছি, আরবসাগর পার করে আরবের নববাণী আর একবার ভারতবর্ষে পাঠান—যাঁরা আপনাদের স্বধর্মী তাঁদের কাছে—আপনাদের মহৎ ধর্মগুরুর কাছে পূজানামে, আপনাদের পবিত্রধর্মের সুনামী রক্ষার জন্য। দুঃসহ আমাদের দুঃখ, আমাদের মুক্তির অধ্যবসায় পদে পদে ব্যর্থ; আপনাদের নবজাগ্রত প্রাণের উদার আহ্বান সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা থেকে অমানুষিক অসহিষ্ণুতা থেকে, উদার ধর্মের অবমাননা থেকে, মানুষে মানুষে মিলনের পথে, মুক্তির পথে নিয়ে যাক হতভাগ্য ভারতবর্ষকে। এক দেশের কোলে যাদের জন্ম অন্তরে বাহিরে তারা এক হোক।’
পারস্যের পথে পথে ঘুরে, শহরে গ্রামে প্রাসাদে যাপন করে, মানুষের সাথে মিশে, তাদের আচার আচরণ পর্যবেক্ষণ করে, তাদের কথা শুনে, প্রকৃতির সান্নিধ্যে থেকে তিনি পারস্যকে চিনেছিলেন; রাজা থেকে সাধারণ মানুষ, মোল্লা, নারী, শিল্পী-কবি, বেদুইন সবার সাথে মিলে, কথা বলে তিনি পারস্যের প্রকৃত রূপ চিনতে চেয়েছেন। ইতিহাসের পাঠ কবিকে সাহায্য করেছে সন্দেহ নেই তবে তাঁর উপলব্ধির আলোকে পারস্যের রূপ মুখরিত হয়ে উঠেছে। এই মুগ্ধতার ছবি তাঁর মনে আমৃত্যু ছিল। এই মুগ্ধতা অকৃত্রিম, তুলনাহীন।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
রাফাহ শহরে আবারও অভিযান চালাবে  ইসরায়েল?
রাফাহ শহরে আবারও অভিযান চালাবে ইসরায়েল?
রাজনীতিক পঙ্কজ ভট্টাচার্যকে স্মরণ
রাজনীতিক পঙ্কজ ভট্টাচার্যকে স্মরণ
কক্সবাজার জেলার রোহিঙ্গা ভোটারদের তালিকা চেয়েছেন হাইকোর্ট
কক্সবাজার জেলার রোহিঙ্গা ভোটারদের তালিকা চেয়েছেন হাইকোর্ট
চুক্তিতে না থাকলেও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলার আশা স্টয়নিসের
চুক্তিতে না থাকলেও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলার আশা স্টয়নিসের
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
হংকং ও সিঙ্গাপুরে নিষিদ্ধ হলো ভারতের কয়েকটি মসলা
হংকং ও সিঙ্গাপুরে নিষিদ্ধ হলো ভারতের কয়েকটি মসলা