X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

‘প্রমোদ ভ্রমণসঙ্গীদের’ তালিকা বিতর্ক

আমীন আল রশীদ
১১ আগস্ট ২০২১, ১৬:৫৫আপডেট : ১১ আগস্ট ২০২১, ১৬:৫৫
আমীন আল রশীদ ‘মডেলদের ‘প্রমোদ ভ্রমণসঙ্গীদের’ তালিকা করছে পুলিশ’; ‘পরীমণিদের ব্ল্যাকমেইলকাণ্ডে জড়িত অনেকের নাম পেয়েছে সিআইডি’; ‘পরীমণি ও পিয়াসার সঙ্গে ২১ প্রভাবশালীর সখ্য’—এরকম বেশ কিছু সংবাদ নিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলেও ৯ আগস্ট ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার শফিকুল ইসলাম স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, পরীমণির বাসায় যাতায়াত ছিল এমন কারও তালিকা হচ্ছে না। ফলে প্রশ্ন হলো, এর আগে কেন তালিকা করা কিংবা ২০ জনের বেশি মানুষের নাম পাওয়া গেছে— এ রকম সংবাদ প্রকাশিত হলো?

এসব সংবাদ তো আইনশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনীর বরাতেই প্রকাশিত হয়েছে। তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, পরীমণি বা এরকম চিত্রনায়িকা ও মডেলদের সঙ্গে সখ্য রয়েছে, তাদের সঙ্গে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন হোটেল ও রিসোর্টে সময় কাটান—এরকম লোকদের তালিকা করা হলে সেটি কত বড় হবে? আবার যদি সেই তালিকাটি সত্যিই বস্তুনিষ্ঠ হয়, তাহলে সেখানে নিশ্চয়ই এমন অনেকের নাম আসবে, যাদের নাম আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও হয়তো প্রকাশ করবে না কিংবা সাংবাদিকরা জানলেও তাদের অনেকে নাম প্রকাশে বিব্রত হবে, অনেকের নাম প্রকাশে ভয় পাবে। সুতরাং, ডিএমপি কমিশনার যে বলেছেন পরীমণির বাসায় যাতায়াত ছিল এমন কারও তালিকা হচ্ছে না—এটিই বাস্তবতা।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর বলছে, সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদে থাকা কথিত প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজ, চিত্রনায়িকা পরীমণি, মডেল ফারিয়া মাহাবুব পিয়াসা ও মরিয়ম আক্তার মৌয়ের ব্ল্যাকমেইল কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন পেশার অনেকের নামই পেয়েছে সংস্থাটি। এ অবস্থায় ‘মডেলদের বিদেশে প্রমোদ ভ্রমণসঙ্গীদের তালিকা হচ্ছে’—এরকম সংবাদও প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, অসৎ উদ্দেশ্যে প্রভাবশালী একটি মহল দীর্ঘদিন ধরেই অনেক মডেলকে দুবাই-মালয়েশিয়া নিয়ে যেতেন। সেখানে তারকা হোটেলে থাকা-খাওয়া ও কেনাকাটার সব খরচ বহন করতো ওই মহলটি। অভিনেত্রী পরীমণিও একাধিক শিল্পপতি ও প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে অন্তত ৩০ বার বিদেশে গেছেন। চলতি বছরের শুরুর দিকেও দুবাইয়ে একটি বিলাসবহুল হোটেলে পরীমণিকে নিয়ে যান একজন বিশিষ্ট শিল্পপতি। সেখানে পরীমণির সব খরচ বহন করেছিলেন তিনি।

সৌদি কিংবা আরব আমিরাত অথবা কুয়েতের মতো তেল বিক্রি করে ধনীয় হওয়া দেশগুলোর রাজপুত্রদের বিলাসী জীবনযাপনের খবর ইন্টারনেটে সার্চ করলেই পাওয়া যাবে। কথিত আছে, তাদের টাকার একটি বিরাট অংশই খরচ হয়ে যায় ফ্রান্স, মোনাকো, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বড় বড় শহরের দামি হোটেল ও ক্যাসিনোতে। নারী ও জুয়ার পেছনে। সুতরাং, বাংলাদেশেও যারা জনগণের পয়সা লুট করে; জনগণকে ব্ল্যাকমেইল করে; জনগণকে ঠকিয়ে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন, তারা এই বিপুল অর্থ কোথায় খরচ করবেন? দেশেই একাধিক বাড়ি কেনা, বিদেশে সেকেন্ড হোম বানানো, কানাডায় বেগমপাড়া গড়ে তোলার পরও তো অর্থ ফুরায় না। তাছাড়া খুব ব্যতিক্রম ছাড়া সব পুরুষের মনের ভেতরেই বিনোদন জগতের সুন্দরীদের একান্ত সান্নিধ্য পাওয়ার বাসনা ক্রিয়াশীল থাকে। ফলে যখন তাদের হাতে বিপুল অর্থবিত্ত আসে, তখন তারা সেই টাকা খরচ করে ওই কাঙ্ক্ষিত নারীদের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন রিসোর্ট, দামি হোটেল, এমনকি অধিকতর নিরাপত্তার কথা ভেবে বিদেশের হোটেলে গিয়ে তাদের সঙ্গে সময় কাটান। সুতরাং তাদের তালিকা করা হলে সেটি বেশ দীর্ঘ হয়ে যাবে। সেই তালিকায় কি বিরাট ব্যবসায়ী, সমাজসেবক, প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ আরও অনেকের নাম আসবে না?

সব নাম কি আইনশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনী প্রকাশ করবে বা করতে পারবে? সাংবাদিকরা জানলেও কি সব নাম প্রকাশ করতে পারবেন? প্রকাশিত হওয়ার আগেই কী করে তথ্যের মৃত্যু ঘটাতে হয়, তা কি এই দেশের প্রভাবশালীরা জানেন না?

অতএব, তালিকা যদি কখনও প্রকাশিত হয়ও, সেখানে বড়জোর দ্বিতীয় তৃতীয় স্তরের লোকদের নাম মানুষ জানবে। প্রথম টায়ারের নামগুলো গণমাধ্যমে আসবে না। মাঝখান দিয়ে বরং তালিকা তৈরির সঙ্গে যুক্তদের ভালো উপার্জন হবে। কারণ, যারা মডেলদের নিয়ে বিদেশে প্রমোদ ভ্রমণে গিয়েছেন, তালিকায় বাদ থাকার শর্তে তারা নিশ্চয়ই মোটা অংকের পয়সা ঢালবেন। সেই পয়সা কোথায় কোথায় যাবে, রাষ্ট্রের কোন পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছাবে, তা সাধারণ মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। যদিও ডিএমপি কমিশনার এখন বলছেন যে তালিকা হবে না। কিন্তু তালিকা হচ্ছে—এই খবর প্রকাশিত হওয়ার পরেই কত লোকের ঘুম হারাম হয়ে গেছে; কত লোক কত জায়গায় ছোটাছুটি করেছেন; কতজনকে ধরেছেন—তারও ইয়ত্তা নেই। ডিএমপি কমিশনারের ঘোষণার পরে নিশ্চয়ই তারা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। স্বস্তি পেয়েছেন।

প্রসঙ্গত, তালিকা নিয়ে রাজনীতি বা বিতর্ক দেশে নতুন নয়। আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে সম্মানিত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়েও বিতর্ক হয়েছে। কারণ, এই তালিকায় অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন। তাদের বাদ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা ঘোষণা করেছে সরকার। কিন্তু এই সংশোধিত তালিকাও ভবিষ্যতে সংশোধিত হবে কিনা বা এই আমলে বাদ পড়া অনেকে ভবিষ্যতে ক্ষমতার পালাবদল হলে আবার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবেন কিনা— তা এখনই বলা মুশকিল।

মুক্তিযোদ্ধাদের মতো একাত্তরে পাক হানাদারদের এ দেশীয় সহযোগী রাজাকারের তালিকা নিয়েও ভয়াবহ কাণ্ড ঘটে যায়। ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর ১০ হাজার ৭৮৯ জন রাজাকারের তালিকা প্রকাশের পরে সারা দেশে তোলপাড় শুরু হয়। অনেক মুক্তিযোদ্ধার নামও ওই তালিকায় ঢুকে পড়ে। ফলে বিতর্কের মুখে সরকার ওই তালিকাটি প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। এরকমও অভিযোগ আছে যে ২০১০-১২ সালে বিভিন্ন জেলায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ স্থানীয়ভাবে রাজাকারদের একটি তালিকা করেছিল। যেখানে রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় তালিকায় অনেক লোকের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

সবশেষ কথিত বুদ্ধিজীবীদের একটি তালিকা নিয়েও সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক বিতর্ক হয়। ষাট বছরের কম বয়স, এরকম ৬১ জনের একটি তালিকা ফেসবুকে শেয়ার করে তাদের ‘বুদ্ধিজীবী’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে  লেখক ও সাংবাদিক মাহবুব মোর্শেদ—যা নিয়ে ফেসবুকে তোলপাড় শুরু হয়।

অস্বীকার করা যাবে না, যেকোনও তালিকার পেছনেই একটা রাজনীতি থাকে। বাংলাদেশে প্রথম বুদ্ধিজীবীর তালিকা করা হয়েছিল একটি অসৎ উদ্দেশ্যে, ১৯৭১ সালে। পাক হানাদাররা সেই তালিকা করেছিল বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার জন্য। এর বহু বছর পরে ব্লগারদের তালিকা করা হয়েছিল। আবার সরকারবিরোধী বুদ্ধিজীবী হিসেবে বেশ কয়েকজনের ছবিসহ একটি ব্যানার টানিয়ে তাদের প্রতিহত করার কথাও বলা হয়েছিল। তার মানে এরকম প্রত্যেকটির তালিকার পেছনে একটি উদ্দেশ্য থাকে। সুতরাং বিনোদন জগতের অনেক নারীর প্রমোদ ভ্রমণসঙ্গীদের তালিকা করা হচ্ছে—এমন কথার পেছনেও নিশ্চয়ই কোনও বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল।

তবে এই তালিকা প্রকাশিত হবে কী হবে না—তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, তালিকাটা কারা করবেন? তারা নায়িকা ও মডেলদের প্রমোদ ভ্রমণসঙ্গী সবার নাম পরিচয় জানতে পারবেন? এই তালিকা করতে গিয়ে তারা কতটা নিরপেক্ষ ও চাপমুক্ত থাকতে পারবেন?

পরীমণির ইস্যুটা যে শুধুই বাসায় কয়েক বোতল মদ পাওয়া বা তার বাসায় মিনি বার আছে কিংবা তার আয়-ব্যয়ে অসামঞ্জস্য আছে বলেই তাকে ধরা হয়েছে—বিষয়টা নিশ্চয়ই এত সহজ নয়। কারণ, এরকম মদের বোতল কিংবা মিনি বার আরও অসংখ্য মানুষের বাসায় আছে। তাহলে পরীমণি কি সমাজের প্রভাবশালী মহলের রোষানলে পড়েছেন কিংবা প্রভাবশালী মহলের মধ্যে বিবাদে পরীমণিকে নিছকই দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে? অর্থাৎ প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত এমন কোনও মহল, যাদের পৃষ্ঠপোষকতায় পরীমণি-পিয়াসা কিংবা মৌ আক্তাররা বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন, তাদের মধ্যে বিরোধ কি এর নেপথ্যে রয়েছে?

তবে এরকম অভিযানের উদ্দেশ্য যদি হয় দেশকে অপরাধ ও মাদকমুক্ত করা, তাহলে সেটি সাধুবাদযোগ্য। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা বলে, এসব অভিযান সাময়িক কিছু চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে; গণমাধ্যমে কিছু ব্রেকিং ও টেলিভিশনের কিছু লাইভ সংবাদ ও টকশোতে ঝাঁঝালো আলোচনার জন্ম দেয় বটে, দীর্ঘমেয়াদে দেশ অপরাধ ও মাদকমুক্ত হয় না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে অসংখ্য মাদক ব্যবসায়ী নিহত হওয়ার পরেও দেশে মাদকের বিক্রি কমেনি। বরং নিত্য নতুন মাদক দেশে ঢুকছে। এসব অভিযান যদি সত্যিই দেশকে অপরাধমুক্ত করতো, তাহলে বছরের পর বছর ক্রসফায়ারে অসংখ্য শীর্ষ অপরাধী নিহত হওয়ার পরেও দেশ কেন অপরাধমুক্ত হচ্ছে না? তার মানে এ রকম অভিযান কখনোই সমস্যার গোড়ায় আঘাত হানতে পারে না। একটি জায়গায় গিয়ে সবকিছু স্থবির হয়ে যায়। সুতরাং, সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে পরীমণি কিংবা পিয়াসা অথবা মৌ আক্তারের পরিণতি যাই হোক না কেন, সমাজ ও রাষ্ট্রে কালো টাকা আয়ের সুযোগ এবং লাগামহীন ও দুর্নীতি লুটপাটের মাধ্যমে একটি গোষ্ঠী কোটি কোটি টাকা কামানোর সুযোগ যতদিন পাবে, ততদিন তাদের ভোগবিলাসের জন্য এই চিত্রনায়িকা ও মডেলরাও ব্যবহৃত হতে থাকবেন।

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ দমনে পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ করছে পুলিশ: আইজিপি
জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ দমনে পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ করছে পুলিশ: আইজিপি
তামাকপণ্যের দাম বাড়ানোর দাবি
তামাকপণ্যের দাম বাড়ানোর দাবি
ভারত সফর স্থগিত করলেন ইলন মাস্ক
ভারত সফর স্থগিত করলেন ইলন মাস্ক
বাঘ ছাড়া হবে জঙ্গলে, তাই শেষবার ভোট দিলেন বাসিন্দারা!
বাঘ ছাড়া হবে জঙ্গলে, তাই শেষবার ভোট দিলেন বাসিন্দারা!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ