X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

পরীমণির মামলা আর বিচারাঙ্গনে ‘পপুলিজম’

ডা. জাহেদ উর রহমান
১২ আগস্ট ২০২১, ১৯:২৭আপডেট : ১২ আগস্ট ২০২১, ১৯:২৭

ডা. জাহেদ উর রহমান ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসের শেষের দিক। নারায়ণগঞ্জে ৭ জন মানুষকে তুলে নিয়ে হত্যা করার ঘটনায় দেশে তোলপাড় ঘটে যায়। আমরা হতবাক হয়ে জানতে পারি ঘটনাটি ঘটিয়েছিল পুলিশের এলিট ফোর্স র‍্যাবের বেশ কিছু সদস্য। সেই সময়ে আরেকটি ঘটনা ঘটে, যেটা আমাদের চোখে পড়েনি কিংবা যাদের পড়েছে, তাদের অনেকের কাছে খুব প্রশংসনীয় মনে হয়েছে। সাত খুনের মামলায় অভিযুক্তদের পক্ষে দাঁড়াতে রাজি হয়নি নারায়ণগঞ্জ বারের কোনও আইনজীবী। পরে অভিযুক্তদের পক্ষে মামলা করার জন্য ঢাকা বার থেকে আইনজীবী যেতে হয়েছিল।

বছর দুয়েক আগে বরগুনায় রিফাত হত্যা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। সেই হত্যাকাণ্ডের নৃশংস ভিডিও আমাদের সামনে আসে, তাই আর সব নৃশংস হত্যাকাণ্ডের চাইতে এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে অনেক বেশি আলোচনা হয়। আমরা মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করতে থাকি প্রতিটি ঘটনা। প্রথম ভিডিওতে স্বামীকে বাঁচানোর জন্য চেষ্টারত দেখা যায় রিফাতের স্ত্রী মিন্নিকে। কিন্তু একটা পর্যায়ে তার বিরুদ্ধেও এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ আসে এবং মিন্নি গ্রেফতার হয়। মিন্নিকে যখন আদালতে নেওয়া হয় তখন প্রথম দিন তার পক্ষে বরগুনা বারের তালিকাভুক্ত কোনও আইনজীবী দাঁড়াতে রাজি হননি।

ফেনীতে নুসরাত হত্যা আরেক চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী হত্যাকাণ্ড। নানা ডামাডোলের মধ্যে আমরা সম্ভবত এখনও ভুলে যাইনি মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ করার প্রতিশোধ হিসেবে নুসরাতকে গায়ে আগুন লাগিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। তখনও ফেনীর কোনও আইনজীবী নুসরাত হত্যায় অভিযুক্তদের পক্ষে মামলা পরিচালনায় অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।

অভিযুক্তদের পক্ষে আইনজীবীদের মামলা পরিচালনা করতে না চাওয়ার এই তিনটি ঘটনার মিন্নির ঘটনাটি বাদে বাকি দুটি ঘটনার মধ্যে আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে, সেই প্রসঙ্গে আসছি কলামের পরের দিকে।

পরীমণি গ্রেফতার হওয়া এবং তার পরবর্তী ঘটনাগুলো বেশ লম্বা সময় ধরে মূলধারার মিডিয়া এবং সামাজিক মাধ্যম মাতিয়ে রেখেছে। যেহেতু বিষয়টির প্রতি মানুষের সীমাহীন আগ্রহ আছে, তাই প্রত্যেকটি মিডিয়া এই ঘটনার নানারকম খুঁটিনাটি বিবরণ দিয়ে রিপোর্ট করছে। এরমধ্যে একটা রিপোর্ট নিয়ে আমরা খুব বেশি উচ্চবাচ্য করিনি, কারণ এটা আসলে এই ঘটনার ‘গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ’-এর অংশ নয়।

পরীমণিকে আদালতে হাজির করার পর তার পক্ষে আদালতে লড়তে রীতিমতো   ‘মল্লযুদ্ধ’ হয়ে যায় আদালতে। ওকালতনামায় স্বাক্ষর করা নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন আইনজীবীরা। এরইমধ্যে এজলাসে এসে বিচারক আইনজীবীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আগে আপনারা ঠিক করেন, কে আসামি পরীমণির আইনজীবী হবেন। তারপর শুনানি হবে।’

তারপরও হট্টগোল বন্ধ না হলে ঢাকা মহানগর হাকিম এজলাস ছেড়ে চলে যান। পরীমণি এ সময় এজলাসেই ছিলেন। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলে বিচারক আবার আদালতে আসেন।

 পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ও আইনজীবী নিয়োগে শেষ পর্যন্ত বিচারককে হস্তক্ষেপ করতে হয়। তিনি আইনজীবীদের তালিকা পরীমণিকে দিলে তিনি সেখান থেকে ছয় জনের নাম চূড়ান্ত করলে মামলার শুনানি শুরু হয়।

হ্যাঁ, পরীমণির ঘটনাটি ওপরে উল্লেখ করা তিনটি ঘটনার চাইতে একেবারে আলাদা। সবক্ষেত্রে অভিযুক্তরা যখন আইনজীবী খুঁজে বেড়াচ্ছেন, পরীমণির পক্ষে মামলায় লড়তে এত বেশি আইনজীবী উদগ্রীব ছিলেন যে বিচার কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়েছে। খুব সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান বলে এক বিরাট সেলেব্রিটির একটি মামলা যে আইনজীবী করবেন তার প্রোফাইল নিশ্চিতভাবেই অনেক সমৃদ্ধ হবে। পরীমণির মামলার কারণেই তিনি মিডিয়ার সামনে আসতে পারবেন বহুবার, যাতে তার পরিচিতি বৃদ্ধি পাবে উত্তরোত্তর।

আসা যাক শুরুতে আলোচিত ঘটনাগুলোর কথায়। মিন্নির মামলার ক্ষেত্রে আইনজীবী না পাওয়া যাওয়ার কারণ হিসেবে দুটো বিষয় সামনে এসেছে। কিছু আইনজীবী এটাকে ইমেজের জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করেছেন, আবার কেউ কেউ করতে চাইলেও নাকি কোনও প্রভাবশালী মহলের চাপে সেটা থেকে সরে এসেছেন। মিন্নির ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তগুলো আইনজীবীরা স্বতন্ত্রভাবে নিয়েছেন।

একটু আগেই বলছিলাম নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলা এবং ফেনীর নুসরাত হত্যাকাণ্ডের মামলার মধ্যে মিন্নির মামলার চাইতেও আরেকটু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে। নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার ক্ষেত্রে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়াদের একজন নারায়ণগঞ্জ বারের আইনজীবী- এই ‘অজুহাতে’ নারায়ণগঞ্জের বার কেন্দ্রীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কোনও আইনজীবী অভিযুক্তদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করবেন না।

নুসরাত হত্যাকাণ্ড নিয়ে যখন সারা দেশে তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়ে যায়, তখন ঢাকার প্রেসক্লাবের সামনে বেশ কিছু রাজনৈতিক এবং নাগরিক সংগঠন প্রতিবাদ সমাবেশ এবং মানববন্ধনের আয়োজন করে। সেসব আয়োজন থেকে ফেনীর আইনজীবীদের প্রতি স্পষ্টভাবে আহ্বান জানানো হয় তারা যেন নুসরাত হত্যা মামলায় অভিযুক্তদের পক্ষে মামলা পরিচালনা না করেন।

 
আমাদের দেশের ‘সচেতন’ নাগরিকদের একটা অংশ মনে করেন, কেউ যদি ভয়ংকর কোনও অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত হন তার পক্ষে আদালতে আইনজীবীদের না দাঁড়ানো উচিত। নিশ্চিতভাবেই সমাজের জন্য এটা কোনও শুভ লক্ষণ নয়। এটা যদি শুভ লক্ষণ না হয়ে থাকে, তাহলে ভীষণ অশুভ লক্ষণ হচ্ছে যখন একটা জেলার আইনজীবীদের পুরো সমিতি কেন্দ্রীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে অভিযুক্তের পক্ষে না দাঁড়ান। একটা রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডার আইনজীবীদের এ রকম চিন্তা অকল্পনীয়।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, এখন আইনজীবীদের অনেকেই পরীমণির মামলায় উকিল হওয়ার জন্য রীতিমতো যুদ্ধ করছেন। মিন্নির মামলায় আইনজীবী হতে না চাওয়া কোনও কোনও আইনজীবী সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তার পক্ষে মামলা লড়তে গিয়ে তারা বিতর্কিত হবেন। নারায়ণগঞ্জের সাত খুন কিংবা নুসরাতের ক্ষেত্রেও ঘটনাটা একই হয়েছিল। এটা যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে পরীমণির বর্তমান মামলা সম্পর্কে আইনজীবীরা ভেবেছেন, এতে তারা হয়তো বিতর্কিত হবেন না।

পরীমণির ফেসবুকে সোয়া কোটির বেশি ফলোয়ার। ফলোয়ার হলেও পরীমণির প্রতি সহানুভূতিশীল মানুষের সংখ্যা আসলে খুব বেশি না। বোট ক্লাবের ঘটনার পর যখন তিনি প্রথম ফেসবুক স্ট্যাটাস দেন তখনকার মতোই সাম্প্রতিক লাইভটিতেও বিদ্রূপের রিঅ্যাকশন (কথ্য ভাষায় ‘হা হা’)-এর সংখ্যা অন্য সব রিঅ্যাকশনের তুলনায় বহুগুণ বেশি। আর এসব ক্ষেত্রে মন্তব্য পড়লেও দেখা যাবে এই নারীর প্রতি বীভৎস রকম বিদ্বেষ পোষণ করেন অসংখ্য মানুষ। এছাড়াও পুলিশ মিডিয়ার কাছে প্রকাশ্যে পরীমণিকে নিয়ে যেসব অভিযোগ করেছে সেগুলো আমাদের সমাজে একজন নারীর জন্য ভয়ংকর অবমাননাকর। তাহলেও তো মনে হওয়ার কথা যে এই ‘ধিকৃত’ পরীমণির পক্ষে দাঁড়ালেও তো আইনজীবীদের বিতর্কিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাহলে তারা তার পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য এত হুড়োহুড়ি করছেন কেন?

আসলে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগটি অপরাধ হিসেবে ততটা গুরুতর নয়। অসংখ্য মানুষ পরীমণির বিপক্ষে থাকলেও অনেক মানুষ তার পক্ষেও আছেন। তাই আইনজীবীরা মনে করছেন, এতে কিছুটা বিতর্ক হলেও তার প্রাপ্তি হবে অনেক বেশি। তাহলে এই প্রশ্ন করি, যদি পরীমণি বীভৎস কোনও খুনের মামলার প্রধান আসামি হতেন দেশব্যাপী তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ, ক্ষোভ শুরু হয়ে যেত, তার ফাঁসি চাওয়া হতো দেশের সব প্রান্ত থেকে, তাহলেও কি তার পক্ষে লড়ার জন্য এজলাসে আইনজীবীদের মধ্যে রীতিমতো মল্লযুদ্ধ হয়ে যেত? পরিস্থিতি যে তখন মোটামুটিভাবে শুরুতে উল্লেখ করা ঘটনাগুলোর মতো হতো সেটা বুঝতে রকেট বিজ্ঞানী হতে হয় না।

একটা রাষ্ট্র তখনই ‘রাষ্ট্র’ হয়ে ওঠে যখন তার তিনটি অঙ্গ (শাসন, আইন এবং বিচার) স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। এদের মধ্যে বিচার বিভাগের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। কারণ, শাসন এবং আইন বিভাগ একে অপরের সঙ্গে অনেক বেশি সংযুক্ত বলে নাগরিকের স্বার্থরক্ষায় বিচার বিভাগের ভূমিকা অনেক বেশি।

একটা রাষ্ট্রের নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষায় বিচার বিভাগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই দেশের প্রতিটি নাগরিকের খুব স্পষ্টভাবে মনে রাখা দরকার, রাষ্ট্রের কোনও নাগরিক যদি পৃথিবীর জঘন্যতম অপরাধেও লিপ্ত হন, অভিযুক্ত হন, তারপরও দেশের সংবিধান এবং আইন অনুযায়ী তার প্রতিটি অধিকার প্রাপ্য। রাষ্ট্রের কাছে সুবিচার পাওয়া তার সাংবিধানিক অধিকার।

খুব বীভৎস কোনও ঘটনার পর আমরা আবেগাপ্লুত, ক্ষুব্ধ, ক্রোধান্বিত হতেই পারি। কিন্তু আমাদের মনে রাখা উচিত, এসব তাৎক্ষণিক আবেগ দিয়ে আর যাই হোক রাষ্ট্র গঠন করা যায় না; রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটানো যায় না। কোনও বীভৎস অপরাধ আমাকে যতই ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ করুক না কেন, একজন নাগরিক হিসেবে আরেকজন নাগরিকের পক্ষে কোনও আইনজীবী যেন না দাঁড়ায় সে আহ্বান আমরা জানাতে পারি না। তেমনি আমরা পারি না কোনও ব্যক্তিগত কিংবা সাংগঠনিক ‘ছুতো’ দেখিয়ে নিজে আইনজীবী হয়ে কারও পক্ষে না দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই রাষ্ট্রের নাগরিকরা তো বটেই, সংবিধান আইন পড়া আইনজীবীরাও অনেক সময়ই এমন আচরণ করেন।

বর্তমান পৃথিবীতে পপুলিস্ট রাজনীতির বাড়বাড়ন্ত চলছে। আপাত অর্থে এটা খুব খারাপ না। কিন্তু যখন যেকোনও মূল্যে জনপ্রিয়তা পাওয়াই একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়, তখন সেটা সমাজের জন্য ভয়ংকর হয়ে যায় - জনপ্রিয়তা হারানোর ভয়ে অনেকেই খুব গুরুত্বপূর্ণ লড়াই থেকে সরে আসেন। রাজনীতিবিদকে শেষ পর্যন্ত ভোটে দাঁড়াতে হয় এবং নির্বাচিত হতে হয়, তাই তার ক্ষেত্রে পপুলিস্ট হওয়া যত বড় সমালোচনার ব্যাপার, তার চাইতে অনেক বেশি বড় সমালোচিত বিষয় হবে বিচারাঙ্গনে পপুলিজম দেখতে পাওয়া। আমার এই কলামে উল্লেখ করা ঘটনাগুলোর সঙ্গে পরীমণির ঘটনাটি মেলালে আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না, এই দেশের বিচারাঙ্গনে এই অশনি সংকেতটি দেখা যাচ্ছে।

লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ