X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

কয়েকটি রাতের ছেঁড়াখোঁড়া কথা

সাদ কামালী
১৩ আগস্ট ২০২১, ০৯:১৯আপডেট : ১৩ আগস্ট ২০২১, ০৯:১৯

টরন্টো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব (TIFF) শেষ হওয়ার অল্প কিছুদিন পরই সেই বছর ২০০২-এর সেপ্টেম্বর মাসে বিশেষ চারটি ছবি নিয়ে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করে উৎসব কমিটি। ছবিগুলো বাছাই করার বিবেচনায় ছিল বেশি আলোচিত—যে ছবিটি নিয়ে অনেক লেখা বিভিন্ন দেশে নিজ ভাষায় হয়েছে, বাণিজ্যে সফল, বিষয়ের দিক থেকে নতুন ও নির্মাণশৈলীতে স্বাতন্ত্র্যতার স্বাক্ষর আছে, এমন চারটি ছবি। বলা বাহুল্য, চারটি ছবির মধ্যে একটি বাংলা ছবি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ‘মাটির ময়না’। এর কিছুদিন পর নিউইয়র্ক শহরের অভিজাত ও মর্যাদাপূর্ণ হল লিঙ্কন থিয়েটারেও ‘মাটির ময়না’র কয়েকটি প্রদর্শনী হয় এবং ‘কান’ চলচ্চিত্র উৎসবে মর্যাদাপূর্ণ ক্রিটিক অ্যাওয়ার্ড অর্জিত ‘মাটির ময়না’ নির্বাচন TIFF কর্তৃপক্ষের জন্য সহজই ছিল। যা-ই হোক, শহর টরন্টোর প্রাণকেন্দ্রের উত্তর-দক্ষিণে ছুটে চলা পৃথিবীর বৃহত্তম ‘ইয়ং’ (Young) স্ট্রিটের ওপর ঐতিহ্যবাহী থিয়েটার প্রতিষ্ঠান এলগিন থিয়েটারে প্রদর্শন চলে তিন দিন। সেই সময় ‘মাটির ময়না’র চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক তারেক মাসুদ টরন্টো আসেন। আত্মীয়তার সূত্রেই তারেক মাসুদ, আমাদের প্রিয় তারেক ভাই, তখন বেশ কিছুদিন আমাদের বাড়িতে অবস্থান করেন। সারা দিনের নানা কাজ, যোগাযোগ, নানাজনের সাক্ষাৎসহ ব্যস্ত দিনের শেষে তারেক ভাইকে দ্বিতীয়বারের মতো খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয় আমার এবং আমার স্ত্রী লাজুলের। সেই কয়েকটা দিন চলচ্চিত্র, সাহিত্য বা শিল্পকলা বিষয়ে নানা কথা বিনিময়ের সময় আমাদের গ্রামের বাড়ি নূরপুর, ভাঙ্গা অঞ্চলের কত কথা, স্মৃতি, পুরনো মানুষদের স্মৃতি সব মিলিয়ে খুব আন্তরিক একটা সময়—আজ অনেক দিন পর কিছু কিছু কথার ওপর শুকনো ধুলোর প্রলেপ পড়লেও বিস্মৃতির অন্ধকারে ডুবে যায়নি। ফুঁ দিয়ে ধুলো সরিয়ে দিলে সজীব সেসব কথা, হাসির ধ্বনি শুনতেও অসুবিধা হবে না। সেই সব কথার অনেক টুকরো অংশ, যা আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে, কান থেকে আমার হৃদয়ে ও বোধে আলোড়ন তুলে একান্ত আমারও কথা হয়ে উঠেছে, তার ওপর ধুলোর কোনো অধিকার নেই আসন পাতবার। পাঠচর্চা এবং অভিজ্ঞতার মধ্যে তারা চির-আয়ু পেয়ে গেছে। পারিবারিক ও আমাদের গ্রামের স্মৃতিচারণামূলক কথার বিস্তার না-ই করি, শুধু পৃষ্ঠারই ব্যবহার হবে। সেই সব আয়ুষ্মান কথামালা, যার একটি বর্ণও বোধ হয় আমার বিখ্যাত ভুলোমনের শিকার হয়ে ওঠেনি; সেরকম কিছু বাণী, যার মর্ম এবং ধ্রুব রূপটি আমার নিজের কাছে সত্য হয়ে আছে। সেসব হয়তো অন্যদের কাছে আমার মতো করে গ্রহণীয় না-ও হতে পারে—শিল্পের নীতি-নৈতিকতা, চরিত্র, মুক্তি, বিরোধ ইত্যাদি নিয়ে ভাবনা-দ্বন্দ্ব লেখালেখির শুরুর থেকেই আমার মধ্যে রয়েছে, সে কারণে তারেক ভাইয়ের কথাগুলো আমার জন্য ছিল আমার না লিখতে পারা কথাগুলোর প্রতিধ্বনি। অন্তত এমনি মনে হয় এখন।
ফরাসি ওতর (Auteur) শব্দটি আমাদের দেশে শুধু তারেক মাসুদের ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা যায় বলে মনে করি। চলচ্চিত্র সমালোচনায় বিশেষভাবে আদ্রেঁ বাজ্যঁর (Andre Bayin) চলচ্চিত্র তত্ত্ব আলোচনায় গত শতাব্দীর ৪০-এর দশকে আদ্রেঁর চলচ্চিত্রশিল্পের সকল দিকের সামগ্রিক ধারণা ও নিয়ন্ত্রণক্ষমতা বোঝাতে প্রথম ব্যবহৃত হয়। চিত্রনাট্য রচনার নানা দিক, সম্ভাবনা, পদ্ধতি, ছবি পরিচালনা, ক্যামেরা, সম্পাদনা, সংগীত এবং সবশেষে সম্পন্ন ছবিটির মুক্তির সময় মানুষ, এলাকা, হল, বাণিজ্য, প্রতিষ্ঠান, প্রতিষ্ঠানের আকাঙ্ক্ষা, মিডিয়া—সব বিষয়ে তারেক ভাই যেমন দিনে দিনে দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন, তেমন প্রতিনিয়ত সেই নিয়ে ভাবতেন, নতুনদের বলতেন। তিনি শুধু একজন Auteur পরিচালক ছিলেন না, এ ছিলেন চলচ্চিত্রের একজন সার্বক্ষণিক অ্যাকটিভিস্ট। দেশের প্রান্তিক দর্শকদের কাছে প্রথমে মুক্তি, তাদের চলচ্চিত্র ও এর বিষয় সম্পর্কে সচেতন করবার কাজটি করে আসছিলেন এবং তার উদ্দেশ্য এবং প্রয়োজনীয়তার কথা নতুনদের বলতেন। কয়েক রাতের নানা আলোচনার ভিতর তারেক ভাইয়ের এই গুণগুলোর পরিচয় আমাদের মুগ্ধ করে। ২০০২ থেকে তার চলে যাওয়ার দিন (আগস্ট ২০১১) মাঝে প্রায় একটি যুগ। Auteur Film Director তারেক মাসুদ নিজেকে আরও পূর্ণ করে চলেছেন। এই সময় প্রকাশ পায় চলচ্চিত্র বিষয়ে তার লেখাগুলো। ‘চলচ্চিত্রযাত্রা’ গ্রন্থে তার স্বাক্ষর।
যা-ই হোক, আমাদের একান্ত কথার আড্ডায় ফিরি, রাতে খাওয়ার টেবিলে বসবার সুযোগ কম হতো, তার কারণ নানা নিমন্ত্রণ। কিন্তু ঘরে ফিরেই কথায় ফেরা। পরিমাপমতো একটা রেড ওয়াইন হাতে ধরেই কথা চলত, উনি পান-সেবায় ‘ওতর’ ছিলেন না, বলে নেওয়া ভালো। কখনো দ্বিতীয়বার নেননি, হাতের প্রথম গ্লাসটিও কখনো শেষ হতো না।

চলচ্চিত্রের কথাতেই তার নেশা হতো, আমরা দুজন হয়তো দ্রব্যগুণ বাড়িয়ে তারেক ভাইয়ের সেই কথায় সময় হারাতাম। সকালে অফিস, ছেলে নিসর্গের স্কুল, আরও নিত্যতায় কিছু অনিয়ম হতো বৈকি। সময়টা ছিল ‘ফল’, শীতের আগে শীতের আগমনী রং মেখে—হয়তো গভীর ও উজ্জ্বল সেই রঙের ভারেই পাতাগুলো নিঃশব্দে প্রতিনিয়ত ঝরে পড়ে, এ কারণে অটাম ঋতুকে বলে ‘ফল’। এ দেশের ঋতুতে শীত না এলেও এই পাতাঝরার সময়কালে শীতই থাকে সকালে। সে কাঁচাঘুম ঠেলে উঠতে আলসেমি হতো, তার মধ্যে শীতের কামড়! তবু আমাদের অনেক রাত পর্যন্ত কথা হতেই হবে। অনেক কিছু বুঝে নিতে চাই তারেক ভাইয়ের কাছ থেকে। যে মানুষটি মাদ্রাসা পাস করে ঘরে বসে এসএসসি পাস করেন, আর এইচএসসি পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হতেই চলচ্চিত্র সংসদ প্রতিষ্ঠা থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণের দিকে চলে গেলেন! যাওয়ার পথটি কেমন? সংগীত ও সাহিত্যের চর্চা পরিবারে ছিল, কিন্তু প্রযুক্তিনির্ভর সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের এই শিল্পধারার প্রতি তারেক মাসুদ কত দ্রুতই আকৃষ্ট হলেন! তখনো তিনি অনেক ছবি দেখে উঠতে পারেননি! আশির দশকের গোড়ায় তরুণ তারেক, মাদ্রাসা-ফেরত চলচ্চিত্র নিয়ে ভাবছে! প্রথম ছবি নির্মাণের চিন্তায় এমন একজন শিল্পীকে বেছে নিলেন, সেই শিল্পীকে দেশের শিল্পীসমাজ তখনো ভালো করে চিনে উঠতে পারেনি। তার সম্পর্কে মিথ, কল্পকাহিনি নানা দিকে ছড়ানো। জানতে ইচ্ছে হলো, চিত্রকলা, আমাদের চিত্রকলার বিকাশ, পশ্চিমের প্রভাব বিষয়ে তারেক ভাই কতটা পড়েছেন। আমার কৌতূহলের আসল ইঙ্গিতটি বুঝে তারেক ভাই সরাসরি সেই বিষয়ে বলতে শুরু করলেন। এখানে ছোট একটা ফুটনোট দরকার আছে, আমরা একই পরিবারের নূরপুর ভাঙ্গা ফরিদপুরের মানুষ আগেই বলেছি। লোকালয়ের মতো মুখের ভাষা ও পরিচিত মানুষগুলো দুজনেরই ভালো চেনাজানা, তো সহজ মুডে আমাদের লোকাল ভাষার কিছু মিশেল দিয়ে ক্যাজুয়ালি তারেক ভাই বলতে শুরু করেন—বুঝছি, তুমি ‘আদম সুরত’ নিয়ে ভাবছ তো, তেমন কিছুই জানতাম না...সুলতান ভাইকে দেখে আমরা কয়েকজন প্রেমে পড়ে গেলাম। এমন বলিষ্ঠ, খাঁটি খাড়া একটা মানুষ, কিন্তু রহস্যময়। পরে দেখলাম রহস্য-টহস্য নয়—খাঁটি একটা মানুষ, যার মনের মধ্যে আছে শুধু প্রেম। ছবির মানুষগুলোকে উনি চিনতেন, ভালোবাসতেন, তাই উনি তাদের যেভাবে দেখতে চান, সেভাবেই রং চড়ান।
তাকে নিয়ে ছবি বানানোর পরিকল্পনা কি হঠাৎ করেই, চিত্রনাট্য... দূর সাদী, কী যে বলো, চিত্রনাট্য কী লিখব, যখন গোটা মানুষটাকেই ধরতে চাই, তখন তার মধ্যে কিসের নাটক। মানুষটাই চরম আকর্ষণীয়। না, চিত্রনাট্যের আরেকটি কারণ হইলো রবার্ট ফ্লাহার্টি। তোমার তো মনে আছে কবির ভাই (আলমগীর কবির) আমাদের কোর্সে ফ্লাহার্টির ওপর একটা দারুণ লেকচর দিয়েছিলেন, অবশ্য ভাষণটা লেখা ছিল। তার আগেই ফ্লাহার্টির ছবি, ডকুমেন্টারি বানাবার কৌশল আমার ভালো লাগত। ফুটনোট : প্রধান সমন্বয়কারী আলমগীর কবিরের তত্ত্বাবধানে ১৯৮১ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স চালু করে সরকারি অর্থানুকূল্যে। সেই কোর্সে আমি ছিলাম অবৈধ এবং সম্ভবত কনিষ্ঠ ছাত্র, কারণ ছাত্রদের বয়স এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা ‘বিয়ে পাস’, এর কোনোটাই আমার তখন হয়নি। আলমগীর ভাইকে তার প্রডাকশন অফিসে যেয়ে অনুরোধ করি আমাকে ইন্টারভিউ করার। জানাই আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের কেবলই ২য় বর্ষের প্রথম সেমিস্টারের ছাত্র। বাঙালি বুদ্ধিতে এ-ও বলি, শানু ভাইয়া আমার (এবং তারেক ভাইয়ের) চাচাতো ভাই হন। সেনাবাহিনীর প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা শানু ভাইয়া কবির ভাইয়ের ভগ্নিপতি। আমি ওই কোর্সের ছাত্র হতে পারি। ওই কোর্সে তখন তারেক ভাই ছাড়াও তানভীর মোকাম্মেল, মোরশেদুল ইসলাম প্রমুখও ভর্তি হয়েছিলেন। তো সেই লিখিত ভাষণটি পরে ছোটকাগজ ‘বিষর্জা’তে ছেপেছিলাম—অপঘাতে আলমগীর ভাইয়ের মৃত্যুর (১৯৮৯) পর। আবার তারেক ভাইয়ের কথাতে আসি। শুরুতে বলেছিলাম দ্বিতীয়বারের মতো এত কাছ থেকে তারেক ভাইকে পেয়েছি। আর প্রথমবার ছিল ওই ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সের সময়। ভিন্ন একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে চাই। অতিরিক্ত পরিশ্রম, মানুষিক চাপ ইত্যাদির জন্য কাঁধ, হাতের পেশিতে তারেক ভাইয়ের ব্যথা হতো। সম্ভবত এই ব্যথাটা প্রায়ই তার হতো। ফরিদপুর জেলার সদরপুর থানার এক গ্রাম তালমার কোনো ফকির-কবিরাজ থেকে তিনি মালিশ নিয়ে এসেছিলেন বা এটা তার সঙ্গেই থাকে। লাজুল তখন প্রায় রাতেই ওই মালিশ মাখিয়ে ব্যথার নিরাময় করত। যাওয়ার সময় মালিশের অবশিষ্টটুকু রেখে গিয়েছিলেন। অন্যদিকে অল্প সময়ের মধ্যে অনেক ভ্রমণ, টরন্টোর ঠান্ডা তাকে কিছু দুর্বলও করে দিয়েছিল। ক্যাথরিন মাসুদ আমেরিকা থেকে প্রায়ই ফোনে উদ্বেগ প্রকাশ করতেন।
ফিল্ম আর্কাইভের তখন কিউরেটর আব্দুর রউফ। আমলা ভদ্রলোক তরুণ চলচ্চিত্রামোদীদের নিয়ে তটস্থ থাকতেন। বলা বাহুল্য, তারেক ভাই আমাদের সবার মুখপাত্র। কথা ছিল দুপুরে লাঞ্চবক্স ‘স্টার হোটেলের বিরিয়ানি’ দেওয়া হবে। কেউ কেউ দুপুরের লাঞ্চবক্স পেয়ে আর পরের ক্লাসগুলোতে ফিরত না। কিউরেটর চাইলেন লাঞ্চবক্স একবারে ক্লাস শেষেই দেওয়া হবে। কিন্তু অধিকাংশ ছাত্রই যখন পুরো সময় ক্লাস করছে, তখন কয়েকজনের জন্য কেন অভুক্ত থাকতে হবে! তারেক ভাই প্রতিবাদ জানালেন, দাবি, দুপুরেই দুপুরের খাবার দিতে হবে। জোর তর্ক তারেক ভাই, কিউরেটর এবং তার স্টাফদের সঙ্গে! আমরা পেছনে দাঁড়িয়ে। কিউরেটর বাধ্য হলেন। আর একবার কোর্স চলাকালীন স্বল্পদৈর্ঘ্যরে জার্মান অভিব্যক্তিবাদী ছবির প্রদর্শনীর আয়োজন করছে ফিল্ম আর্কাইভ। কিন্তু সেন্সর বোর্ডের অনুমোদনের আগে এই ছবি দেখানো যাবে না, আমলা সিদ্ধান্ত। প্রতিবাদ তারেক ভাইয়ের, অমরা ফিল্মের ছাত্র। মূল দেখবার অধিকার আমাদের আছে। বাণিজ্যিক হলের দর্শকদের মতো কাটাছেঁড়া ছবি আমাদের দেখতে হবে! সঙ্গে পেলেন আরও একজন সিনেমাপাগল কবি শামসুর রাহমানকে। তারেক ভাই, রাহমান ভাই, সঙ্গে আরও কয়েকজন রউফ সাহেবকে বাধ্য করলেন বোর্ডের কাটাছেঁড়ার আগেই ছবিগুলো আমাদের দেখানোর। তখন ধানমন্ডির (শংকর) এক বাড়িতে অডিটরিয়াম লাইব্রেরিসহ আর্কাইভের কার্যালয় ছিল। কবি শামসুর রাহমানসহ সেখানে সকাল নয়টা থেকে ওই ছবিগুলো দেখানো আয়োজন হলো।

যা-ই হোক, ফ্লাহার্টির কথাতে ফিরি।
ফ্লাহার্টি চিত্রনাট্য না লিখেই চিত্রায়ণ শুরু করতেন এবং সম্পাদনার পর্যায়ে তার চিত্রনাট্য তৈরি হতো, তো এই ব্যবস্থা আপনার কাছে খুব আদর্শ মনে হলো!
শোনো, ফ্লাহার্টির ভাবনা ছিল বাস্তব জীবনের ওপর, কল্পকাহিনিতে নয়। তিনি ছবি তোলা আর সম্পাদনা করতে করতে চিত্রনাট্য করতেন, অর্থাৎ, তুমি আগেই একটা মডেল কাহিনির রূপ লেইখা নেওনি। মানে প্রিকনসিভড নও, ক্রিয়েটিভ পসিবিলিটিতে তার অবস্থা ছিল। এইখানেই আমার ভালো লাগে। তবে আমরা যে চিত্রনাট্য আগেই লেখেনি, আবার ভাইবো না তারেক ভাইর খামখেয়ালি। আসলে এটাই ছিল পরিকল্পনা। আমরা সুলতান ভাইর সঙ্গে সারা দিন থাকব, ঘুরব, বসবাস করব। শিল্পীর বাস্তব জীবনের সঙ্গে তার অন্বেষণ, ভাবনা এই সব থাকবে। আসলে চিত্রনাট্য না থাকলেও একটা গাইডলাইন ছিল এমন যে ছবিতে কী থাকবে কী থাকবে না। মহারথী শিল্পীদের কোনো সাক্ষাৎকার থাকবে না। তার সম্পর্কে কোনো ভাষ্য দরকার নেই। তাকে আমাদের ফিল্মের মাধ্যমেই তুলে ধরব। কত সব কল্পকাহিনি ছিল তাকে ঘিরে, যে উনি গোখরা সাপের সঙ্গে ঘুমাতেন, পায়ে আলতা মেখে নূপুর পরে, শাড়ি পরে ঘুরতেন। বাঘকে বশ করতে পারেন ইত্যাদি এসব কিছু এড়িয়ে তার শিল্প অন্বেষার সিরিয়াস দিকটিই থাকবে। অর্থের সংকট তাই প্রযুক্তিরও অভাব, ফলে অনেক কিছুই ভাবনামতো করতে পারিনি ঠিক, দীর্ঘ সাত বছর ধরে ছবিটি শেষ করার পথে সুলতান ভাই এবং এই ছবি—দুটিরই আমরা প্রেমে পড়ি। প্রেম শেষ হতে চায় না, ছবিও শেষ হয় না; মনে রাখবা, আমি যখন শুরু করি, তখন আমার কাঁচা বয়স, সময় সময় চিন্তাভাবনা বদলাচ্ছে। কত ছবি দেখছি, কোর্স করছি, ছবি সম্পর্কে নতুন নতুন ভাবনা তৈরি হচ্ছে। চিত্রনাট্য না থাকার সুবিধা হলো, ছবি শুরুর সময় এবং শেষ করার পর্যায়ে আমার ভাবনাচিন্তা, জানাশোনা কাঁচা অবস্থা থেকে অনেকটা পরিণত হয়েছে। তাই ছবির ফাইনাল সম্পাদনার সময় আমাদের ভাবনা একটা রূপ পেয়েছিল। তাই শুরুর সেই গাইড লাইন থেকে আমরা সরে আসতে পারি। ধারাভাষ্য থাকবে না বললেও আমরা শেষ পর্যন্ত অব ভয়েস যোগ করে ছিলাম।
আচ্ছা, ছফা ভাই কি ‘আদম সুরত’-এর নির্মাণ-নেপথ্যে প্রেরণা? সরাসরি তা বলতে পারব না। আহমদ ছফা, এই আরেকজন মানুষ, প্রখর ধীমান। আসল খাঁটি চিনতেন। ছফা ভাই সুলতান ভাইর শিল্পীজীবন ও শিল্পের স্বভাব-চরিত্র আমাদের ঢাকার সুশীল সমাজের সামনে তুলে ধরেন। আমাদের মতো কৌতূহলী তরুণদের সঙ্গে ছফা ভাইর প্রাণের সম্পর্ক ছিল। সুলতান ভাইর ছবিও মানুষের প্রতি প্রথম আকৃষ্ট হই ছফা ভাইর লেখা ও তার সঙ্গে আড্ডায়। কিন্তু সুলতানকে নিয়ে ছবি বানাবার স্বপ্ন বলো, প্রেরণা বলো, সে হয়তো আরও অন্য কিছু। সুলতানকে নিয়ে প্রবন্ধ লেখা, কবিতা এমনকি একটি উপন্যাস লিখতে না বসে একেবারেই আনাড়ি আমি তারেক বন্ধু মিশুক ১৬ মিমি ক্যামেরা নিয়ে ছবি বানাতে প্রায় প্রস্তুতিহীন অবস্থায় নেমে পড়লাম কেন! আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে পড়ার সময় আমার সঙ্গে কবির ভাইর খুব কথা হতো শানু ভাইয়ার বাসায়। কবির ভাইর কোনো কথা বা চলচ্চিত্র সম্পর্কে তার পরিশীলিত, শিক্ষিত, বিজ্ঞানমনস্ক মন আমার সদ্য কৈশোর-উত্তীর্ণ বয়সে প্রভাব ফেলেছিল কি না, কে জানে। তবে এ কথা সত্য, শিল্পের আকস্মিকতা জেনেও অবচেতনে কোথাও আলমগীর কবির, আহমদ ছফা, কিংবা মাদ্রাসার কোনো হুজুরের কোনো কথা হয়তো আছে।
মনে কি কোনো ক্ষোভ আছে? শৈশব, কৈশোর, মাদ্রাসার মতো পরিবেশে...।
এখন তোমারে বলতে পারি, জানো, ভালোই হয়েছে। অন্য একটা দুনিয়ার অভিজ্ঞতা, যা আমার হয়েছে, আমার আছে আর কারো তা নাই। আমি মাদ্রাসা থেকে বেরিয়ে এইখানে এসে আজ, মাদ্রাসা খুব খারাপ বা ভালো এমন সরলীকরণে যেতে পারি না, সম্ভাবনা, প্রতিকূল পরিবেশেও, সম্ভাবনা কোথায় কে বলতে পারে বলো। ‘মাটির ময়না’ ছবিতে আমি সচেতনভাবে মাদ্রাসার সমালোচনা বা তার গুণগান করিনি। কিন্তু ছাইগাদাতেও কচিপাতার সবুজ গুল্মের সৌন্দর্য ফুটতে পারে। তুমি দেখছ না শাজাহান মিয়াদের ছাইগাদার ভিতর কত বড় বড় ভেন্না গাছ হয়েছিল। ইব্রাহিম হুজুর এবং রোকনের মধ্যে কি বিকার খুঁজে পাও, নাকি স্নেহ-ভালোবাসা আর রহস্যময় আনন্দের সৌন্দর্যের অভিব্যক্তি দেখো। মনে কইরো না, রোকন বা ইব্রাহিম হুজুর মাদ্রাসার কোনো রিপ্রেজেন্টেটিভ ক্যারেক্টার। কারণ, অন্য হুজুর বা আনোয়ারের অন্য বন্ধুরা অন্য রকমের। একজন আধুনিক মানুষ হিসেবে মনে করি সম্ভাবনাকে শিকলে বেঁধে ফেলে বলতে পারব না যে কোনো সম্ভাবনা ছিল না। মানুষ ও প্রকৃতির সম্ভাবনা অসীম।

আমরা কী বলতে পারি না যে মাদ্রাসার ওই পরিবেশ শিশুমনটি বিকাশের পথে অন্তরায়!
তুমি বলতে পারো, আরও কেউ কেউ বলতে পারে। প্রত্যেকের ক্ষমতা আছে বলতে পারার। কিন্তু উপলব্ধির সঙ্গে তার তফাত আছে। আবার ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে ভিন্ন রকম ঘটে। এখন পিছনে তাকিয়ে কোনো আদর্শবাদ দ্বারা শৃঙ্খলিত না হয়ে বলতে পারি, মাদ্রাসায় সেই কাঁচা বয়সে যে শিক্ষাক্রমের মধ্যে আমার একটা যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেখানে সেই বয়সে এবং সেই পরিবেশে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখার খুব একটা পরিবেশ ছিল না। ওই প্রতিকূল পরিবেশ হয়তো আমার মধ্যে বিপরীত, ভিন্ন একটা সংবেদনশীলতা তৈরি করেছে। মাদ্রাসার পরিবেশ স্বাভাবিকভাবেই আমাদের ঘরের মতো নয়, সেখানে আম্মা নাই, জবার মা নাই, আব্বার শাসন নাই, মামাদের যাওয়া-আসা নাই, ফুলসুতি (তারেক ভাইয়ের নানাবাড়ি) গ্রাম নাই, আমাদের নূরপুর নাই, খানবাহাদুর দাদার হুঁক্কাও নাই, বাদশাহ মিয়ার কাশিও রাতের নিঃশব্দ ভেঙে দেয় না। কিন্তু ওই ব্যতিক্রমী পরিবেশে অজান্তেই মনের মধ্যে এমন সংবেদনশীলতা তৈরি হয়েছিল, যা শিল্পী মনের একটি ধরন। আমার আগে তো আমাদের পরিবারের কেউ মাদ্রাসায় যায়নি। অন্যদিকে গান, রবীন্দ্রনাথ, সাহিত্যের কমবেশি চর্চা ছিল বাড়িতে। ছোটবেলায় হাজারহাটি গ্রামের সন্তোষদার মুখে মুখে পদ্য করা আমার খুব ভালো লাগত। সন্তোষদা আমার আদি বাউলগুরু। তোমার মনে আছে সন্তোষদাকে? বলি, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা সাদা ধুতি, খালি গা, একহারা গড়নের সন্তোষদাকে দেখেছি। কিন্তু তার গান আমার মনে নেই বলতেই তারেক ভাই বলেন, আমি সন্তোষদার একটি গীতপদ্য আমার একটা ছবিতে ব্যবহার করব। কোন গানটা?
অন্ধকারেও বুঝতে পারি তারেক ভাইয়ের চোখে-মুখে একরকম আলো ফোটে—‘গান্ধী মরলো গুলি খাইয়া/ জিন্নাহ হাফ মরা/ বর্ণ হিন্দু চইলা গেল/ চাঁড়াল পড়লাম ধরা।’
ফুটনোট : এই পদ্যটুকু স্মৃতি থেকে মনে করে বলবার মতো স্মৃতিধর আমি নই, বলতে পারছি, এই লেখা লিখবার বেশ আগেই ‘অন্তর্যাত্রা’ ছবিতে গানটি ব্যবহার করেন এবং ‘নরসুন্দর’ প্রদর্শনীর সময় তিনি আবার যখন টরন্টো আসেন, সেই তার শেষ টরন্টো আসা, তখন তারেক ভাই বলেছিলেন। আমি লিখেও রাখি। আমার কোনো কাজে লাগাতে। এমন সাধারণ পদ্যে এত গভীর সত্য ও বেদনা সন্তোষদার মতো গ্রাম্যজন কত সহজেই প্রকাশ করতে পারেন! দেশভাগের ওপর লেখা সদ্য একটা গদ্যে তা ব্যবহার করার সুযোগ হাতছাড়া করিনি। তারেক ভাইয়ের ছবিতে লক্ষণ দাসের কণ্ঠে এই পদ শোনা যায়, আমার গদ্যে সত্য চরিত্র ওই হাজারহাটি গ্রামের সুবোধ মিস্ত্রি মনের যন্ত্রণা ক্ষোভ প্রকাশ করতে আবৃত্তি করে।
মনের মধ্যে খচখচ করতে থাকা একটা প্রশ্ন একদিন বিকেলে গাড়ি চালাতে চালাতে প্রকাশ করে ফেলি। আমাদের গন্তব্য ছিল উপন্যাস লেখক বন্ধু সালমা বাণীর বাড়ি। প্রশ্নটি ছিল—নূরপুর ভাঙ্গা যে লোকালয় আপনি ছবিতে ব্যবহার করেছেন, সেখানে তো মাটির বাড়ির কোনো অস্তিত্ব নেই। মাটির বাড়ি কেন ব্যবহার করলেন! তারেক ভাই সরাসরি প্রশ্ন পছন্দ করতেন না, যদি সেই প্রশ্নে তাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করা হয়। তাই আমার বলার ধরনটি তার পছন্দ হলো না। ঠোঁটের কোণে এমন একটি হাসি ফুটিয়ে বললেন, তুমি কি ভাবছ ভাঙ্গা নূরপুরের ওপর ডকুমেন্টারি বানাইছি? ছবি ঠিকই বাস্তবের হুবহু প্রকাশ করতে পারে। শিল্পী সেই আক্ষরিক বাস্তবতা থেকে উত্তীর্ণ হয়ে নতুন এক বাস্তবতা তৈরি করে নেয়। তুমি নূরপুরে মাটির বাড়ি দেখো নাই ঠিক, কিন্তু তুমি কি ‘মাটির ময়না’র কাজি সাহেবের মতো আদর্শ-বদ্ধ মানুষকে দেখতে পাওনি! চারিদিকে নিরেট আবদ্ধ। মাটির মোটা দেয়ালে কোনো একটি ছিদ্র নাই বাইরের আলো প্রবেশ করবার। বেশ ওপরে ছোট একটি জানালা, সেটিও কাজি সাহেব স্ত্রী-কন্যার পর্দার কথা ভেবে বন্ধ করে রাখে। এমন একটা ঘর কি কাজি সাহেবের আদর্শে আটকা পড়া মনকে বেশি প্রতিনিধিত্ব করে না! মুলি বাঁশের বেড়া টিনের যে ঘর আমাদের বাড়িতে ছিল, সেই ঘর কখনো নিরেট অন্ধকার হবে না যদি না বাইরে গাঢ় অন্ধকার না থাকে। ঘরের বেড়ায় বিন্দু বিন্দু তারার মতো আলোর ফুটকিরি; মাটির ঘরের দমবন্ধ অবস্থা সেখানে নেই!
সন্তোষদার গীতপদ্যটি কোন ছবিতে ব্যবহারের কথা ভাবছেন? ‘মাটির ময়না’র এমন জাতীয়-আন্তর্জাতিক সাফল্যের পর অনেকেই আপনাকে দিয়ে ছবি বানাতে চাইবে, মহাজন, ঔপন্যাসিক, গল্প লেখকদের গল্প নিয়ে বলবে, তারেক ভাই ‘সারেং বউ’র রিমেক করতে চাই...। ভালো বলেছ। ঢাকা, কলকাতা থেকে সেরকম কত অফার...কিন্তু আমার সিনেমা আমার প্রকাশমাধ্যম, যার মধ্যে আমার শিল্পবোধ, চিন্তা, দর্শন এবং প্রধানত অভিজ্ঞতা প্রকাশ পাবে। অন্য লেখকের গল্প-উপন্যাসে তাদের ভাবনা-দর্শন প্রকাশ পেয়েছে। আমার শৈশব, অভিজ্ঞতা, মানুষ তার ও চারপাশকে বুঝতে সাহায্য করে। এমন একটা শৈশব যার আছে, তা বুঝতে পারলে সেইটাই তার ট্রেজার হয়ে ওঠে। ভবিষ্যৎ ছবির পরিকল্পনাও আমার অভিজ্ঞতালব্ধ কাহিনির আধার। সেই অর্থে ফিকশন নয়, অভিজ্ঞতারই প্রকাশ। গল্পটা শুধু ওই অভিজ্ঞতা বোধ-দর্শন বহন করার ‘পৈকা’।
বলি, বেতের পৈকা। তারেক ভাই বলে, একদম বেতের বুনুনে ফাঁকফোকর থাকবে না।
কয়েকটা রাতের, দিনেরও কিছু টুকরো কথা-স্মৃতি থেকে কাগজের পৃষ্ঠায় স্থানান্তরের যাত্রায় হয়তো আমার ভাষা বা শব্দের অনুচিত ব্যবহার ঘটে গেল, তবে মূল কথার নয়। সামনেই ডিসেম্বর ৬, তারেক ভাইয়ের জন্মদিন। এমন হতে পারেই আমরা বাঙালিরা শত শত বছর শুধু জন্মদিনের উৎসব করব, তারেক মাসুদ উৎসব ও উদযাপন করব। কোনো অপঘাতের দুর্ঘটনাকে আর কখনো স্মরণ করব না।
অপঘাত তো আমাদের শনিরাহুর নিত্য উৎপাত, নিত্য শোকের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অপদেবতার অপঘাতের নেশায় আমরা শূন্য হয়ে পড়ছি। শুধু অপঘাত নয়, অকালপ্রয়াণও বিপন্নতার জন্য শনির রাহু দায়ী। তারেক মাসুদের মতো নতুন, উদ্যমী, শিল্প সৃজনে পরবর্তীদের বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করতে পারেন, স্রষ্টাদের দিকে তাকিয়ে কষ্ট পেতে হয়, আমাদের প্রতিভাবান নতুন শিল্পপথের দিশারিগণের সিংহভাগই ষাট বছরও অতিক্রম করতে পারেনি। এত ছোট, অনগ্রসর দেশের মতো আর কোথাও কি এমন নজির আছে? জহির রায়হান, আলমগীর করির, তারেক মাসুদ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, মুনীর চৌধুরী, আখতারুজ্জামান, সেলিম আল দীন, হুমায়ুন আজাদ, আহমদ ছফা, শহীদুল জহির—মুহূর্তেই কয়েকটি নাম মনে এল। তাদের প্রত্যেকেই ষাট অতিক্রম করার আগেই অপঘাত বা অকালপ্রয়াণে আমাদের সামান্যকেও শূন্য করে দিয়ে চলে গেছেন।
তারেক ভাই কোনো মাথাভারী বিশেষণ পছন্দ করতেন না, যেমন আর্ট ফিল্ম, বিকল্পধারা, নারীবাদী, প্রগতিশীল ইত্যাদি অভিধা। একটা সাধারণ কৌতূহল প্রকাশ করায় তারেক ভাই বলেছিলেন,
হ্যাঁ, মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক পট, নেতাদের ভূমিকা, ভাষণ, তাদের যুদ্ধ পরিকল্পনা ইত্যাদির চেয়ে সাধারণ মানুষের আবেগ, সাহসী, তৎপরতা আমাকে বেশি আকৃষ্ট করে। যুদ্ধের কেন্দ্রীয় প্লটে নানা আলো ও আলোচনা, প্রকাশনা হচ্ছে। দেশের সাধারণ মানুষদের মধ্যে যারা দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করল, তাদের ওপর কোনো আলোকপাত নেই, তারা ইতিহাস হয়ে উঠতে পারছে না, সেই সাহসী, সাধারণ খালি গা, লুঙ্গি পরা, বন্দুক ধরতে কেবলই ট্রেনিং পেয়েছে, গ্রেনেড ছোড়ার আগেই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জীবন উৎসর্গ করছে, তাদেরকে আমি শিল্পীর চোখে দেখতে চাই। দেখাতেও চাই। ‘মুক্তির গান’-জাতীয় তৎপরতার চেয়ে প্রান্তিকদের দেশের জন্য ভালোবাসা, উৎসর্গই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। আবার ভাইবো না, আমি আর্টফিল্ম বানাবার কথা বলছি। শিল্পীর চোখ মানে সত্য দৃষ্টি। ক্যামেরার ছোট লেন্সের ভিতর দিয়ে বড় বৃহৎ দৃশ্য দেখা আর কি! আমাদের সিনেমা, শিল্প, চিন্তায় খুবই চর্বিত চর্বণ চলে আসছে, নতুন কিছু নেই। তথাকথিত আর্টফিল্মও পুরনো ভাষা ও আঙ্গিকে মোড়া, ক্ষয়িষ্ণু মধ্যবিত্তের মূল্যবোধ, মানবিকতার সংকট দেখতে দেখতে সাহিত্য-সিনেমা ক্লিশে হয়ে উঠেছে। বাঁধাধরা জীবন আটকে আছে। আমি চাই একজন রোকনকে—অন্য ছেলেরা যখন টেনিস বল হাতে ক্রিকেট খেলে, রোকন তখন বল ছাড়াই বল খেলে আনন্দে উজ্জ্বল। অর্থাৎ তার বল হলো কল্পনা। শিল্পীর যদি কল্পনাশক্তি না থাকে, নতুন দেখার চোখ না থাকে, তাহলে অনেক অনেক দামি কথা বলেও ক্লিশে হয়ে উঠবে। সত্যজিৎ থেকে আজকে পর্যন্ত নতুন ভাষার, নতুন ভাবনার কয়টি কাজ পেয়েছি? সত্যজিতের মতো মহৎ শিল্পী হলে চলতি ভাষাবোধকেও দারুণ আর্ট করে তুলতে পারেন। কিন্তু নতুন কিছু সৃষ্টি নয়। সত্যজিৎ তার অগ্রজপ্রতিম বিভূতি বা রবীন্দ্রনাথকে চিত্রায়ণ করেছেন অত্যন্ত শৈল্পিকভাবে ঠিক! তা তার আগের স্রষ্টা রবীন্দ্র বা বিভূতি থেকে কতটা নতুন! মাধ্যম বদল ছাড়া বলতে পার স্টুডিওর বাইরের সাধারণ লোকদের থেকে অতি অভিনয়মুক্ত স্বাভাবিক বাস্তবানুগ অভিনয় আদায় করে নিয়েছেন।
এই বিবেচনায় ‘মাটির ময়না’—আনোয়ার, আসমা, কাজি, ইব্রাহীম হুজুর, আয়েশা, মিলন প্রমুখ চরিত্রগুলোর ভূমিকা কি নতুন! আমরা কি আদর্শবন্দী কাজি, আদর্শবন্দী নয়, কিন্তু অসহায় বিপন্ন মা আয়েশা, রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার মিলন ও তার বন্ধুরা, ভালো মানুষ ইব্রাহিম হুজুরকে সাহিত্যে, ছবিতেও কি বিরল! কখনো আনোয়ার আর তার ছোট বোনটিকে কেন অপু-দুর্গার কথা মনে করিয়ে দেয়!

তারেক ভাই অনেক কথায় ক্লান্ত, আমার কথার শেষে আড়মোড়া ভেঙে বসতে যেয়ে হাতের ধাক্কায় রেড ওয়াইনের গ্লাস পড়ে বিছানার চাদর ভিজে রক্তাক্ত হয়ে ওঠে। আমার স্ত্রী লাজুল দ্রুত তোয়ালে দিয়ে সেসব ম্যানেজ করতে করতে তারেক ভাই দাঁড়িয়ে পড়েন। সেই রাতে আর কথা হলো না। আর তেমন রাতও আসবে না। শুধু থেকে গেল তারেক ভাইয়ের ছবিগুলো, কাজ, কথা আর লেখা। যুগে যুগে যা নতুনদের প্রেরণা দিয়ে যাবে। বলতে দ্বিধা নেই, এক হাতেই তারেক মাসুদ আমাদের চলচ্চিত্রকে বিশ্বের উঁচু আসনে এনে তুলেছিল, যেমন বাংলা সাহিত্যকে রবীন্দ্রনাথ।

‘মাদুলি’র তারেক মাসুদ সংখ্যা হতে গৃহীত।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা