X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

গণমাধ্যম এবং আমাদের উচ্চশিক্ষা

মো. সামসুল ইসলাম
১৩ আগস্ট ২০২১, ১৫:৫৮আপডেট : ১৩ আগস্ট ২০২১, ১৫:৫৮
মো. সামসুল ইসলাম দেশে ইদানীং শিক্ষা নিয়ে জনগণের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে। গণমাধ্যমে শিক্ষা নিয়ে রিপোর্টিং বেড়েছে, ফেসবুকে লেখালেখি হচ্ছে, টিভিতে টকশোতে উচ্চশিক্ষা নিয়ে আলোচনা বাড়ছে, এমনকি শিক্ষা নিয়ে বিভিন্ন স্বতন্ত্র নিউজপোর্টালও দেখছি। এ ধরনের আলোচনা অবশ্যই ইতিবাচক। কিন্তু আমি মনে করি দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে প্রকৃত উন্নয়নের জন্য গণমাধ্যমে উচ্চশিক্ষা বিষয়ক আলোচনা বা রিপোর্টিং হতে হবে আরও সুনির্দিষ্ট, সমৃদ্ধ এবং বিশেষায়িত।
     
গণমাধ্যমে আমাদের উচ্চশিক্ষা নিয়ে সংবাদগুলো দিনে দিনে গতানুগতিক হয়ে পড়ছে। ভিসি বা শিক্ষকদের দুর্নীতি, প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক র‍্যাংকিং আমাদের অবনতি বা শিক্ষকদের বুদ্ধিবৃত্তিক চৌর্যবৃত্তির খবর ইত্যাদি কয়েকটি বিষয়ে আলোচনার ঘেরাটোপ থেকে বের হতে পারছে না আমাদের গণমাধ্যম। আর কোভিডকালে শিক্ষা বিষয়ক বেশিরভাগ আলোচনাই যে অনলাইন শিক্ষার ভালোমন্দ বা সমস্যা নিয়ে সীমাবদ্ধ তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
 
প্রথমেই বুঝতে হবে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানসমূহ একটি দেশের সমাজ বা সংস্কৃতি বিচ্ছিন্ন নয় এবং শুধুমাত্র শিক্ষক বা শিক্ষার্থীরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র অংশীজন নয়। ভিসি বা শিক্ষকদের দুর্নীতি সামগ্রিক সামাজিক অবক্ষয়েরই বহিঃপ্রকাশ। শিক্ষকদের বুদ্ধিবৃত্তিক চৌর্যবৃত্তি নিয়ে আমরা সবাই বলি। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে যে শিক্ষকরাও সেই সমাজেরই অংশ যে সমাজে সব ধরনের শিক্ষাঙ্গনে চলছে কাটপেস্ট আর গাইডবুকের সংস্কৃতি। যে সমাজে অনেক মানুষ এমনকি ফেসবুকেও অন্যের লেখা দেদার নিজের বলে চালিয়ে দেয় আর খুব বেশি হলে পুরো লেখা শেয়ার করে নিচে খুব ছোট করে ‘সংগৃহীত’ শব্দটি লিখে রাখে, সেই সমাজে কিছু শিক্ষকের মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা না থাকাটাই হবে বরং অস্বাভাবিক।  
 
যা হোক আমরা আমাদের মূল আলোচনায় ফেরত আসি। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিজ্ঞাপন নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা, বিতর্ক  হয়েছে। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়  পিএইচডি গবেষক হিসেবে আবেদনপত্র চেয়েছে কিন্তু অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সরাসরি আবেদনের সুযোগ পেলেও বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পারবে না। তাদের এমফিল করতে হবে।
 
কিন্তু আমাদের মূলধারার গণমাধ্যম কি এ প্রসঙ্গে দেশবাসীকে জানিয়েছে যে ২০১৯ সালে বিআইডিএস-এর গবেষণা অনুসারে বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাকরিপ্রাপ্তির হার ৪৪% আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩২%?
 
অথবা কোনও জরিপ করে এটা কি জানিয়েছে যে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শীর্ষ পর্যায়ের বেশিরভাগ শিক্ষকই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের? এরকম নিয়মের আইনগত দিক নিয়ে গণমাধ্যমে আমার কোনও প্রতিবেদন চোখে পড়েনি। কেউ প্রশ্ন করেনি যে এ ধরনের নিয়মকানুন আদৌ সংবিধানে বর্ণিত সমঅধিকার আর বৈষম্য না করার ধারণাগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত কিনা।

আসলে শিক্ষা নিয়ে বিভিন্ন বৈচিত্র্যপূর্ণ সংবাদ হতে পারে। আমি দুই একটি ধারণা দেই।  যেমন আমাদের দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তো কমবেশি গবেষণা জার্নাল বের হয়। বিদেশে গণমাধ্যমে এই অ্যাকাডেমিক জার্নাল থেকে অনেক রিপোর্ট হলেও আমাদের দেশে এ প্রবণতা নেই। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের জার্নালগুলো কিন্তু হতে পারে গণমাধ্যমের শিক্ষা বিষয়ক সংবাদের অন্যতম উৎস।

আমাদের দেশে বিভিন্ন বিষয়ে অনেক আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষক, গবেষক আছেন। গবেষণায় আমরা পিছিয়ে থাকলেও প্রতি বছর আমাদের দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বা থিংক ট্যাংকগুলোর বিভিন্ন জার্নালে বিভিন্ন বিষয়ে অনেক গবেষণা প্রবন্ধ, পিএইচডি থিসিসের অংশ প্রকাশিত হয়।  আমি অন্তত এটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারি যে এসব জার্নালে প্রকাশিত অনেক গবেষণার ফলাফলেরই সংবাদমূল্য বা নিউজভ্যালু আছে।  পাঠকেরা আগ্রহ নিয়ে এসব পড়বেন। আর আমাদের সংবাদ বুভুক্ষু গণমাধ্যমের জন্য তা হবে মানসম্মত লেখা প্রাপ্তির এক স্বর্ণখনি!  

আবার সাংবাদিকরা  পাবলিক বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ইন্সটিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাস্যুয়েরেন্স সেল (IQAC)-এর কার্যক্রম লক্ষ করলে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম সম্পর্কে ভালো ধারণা পেতে পারেন এবং এ ধারণাগুলোর কিয়দংশ গণমাধ্যমের  পাঠক, দর্শকের সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন। দেশে উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন রেগুলেটর, যেমন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বা বাংলাদেশ অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল উচ্চশিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। বিগত কয়েক বছরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অ্যাকাডেমিক মান পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এক নীরব বিপ্লব সাধিত হয়েছে যে বিষয়গুলো যারা বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষাদানের সঙ্গে জড়িত তাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে।

আমাদের সাংবাদিকরা দেখতে পারেন যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ রীতিনীতিগুলো কতটুকু মেনে চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কারিক্যুলামকে আউটকাম বেসড এডুকেশনের সঙ্গে সম্পর্কিত করার বলা হচ্ছে। সাংবাদিকরা এ বিষয়ে ধারণা নিয়ে জনগণকে জানাতে পারেন। এতে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে তুলনামূলক ধারণা পেতে পারেন। উপরন্তু এটি শিক্ষার্থীদের তাদের পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয় বেছে নিতে সহায়তা করবে।  
     
ইদানীং আন্তর্জাতিক র‍্যাংকিংয়ে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান নিয়ে আমরা খুব বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা পশ্চিমা র‍্যাংকিংয়ের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে খুব বেশি চিন্তাভাবনা করছি না।  র‍্যাংকিংতো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু এর ওপর গণমাধ্যম বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কারণে অন্যান্য বিষয়, যেমন- আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি দেশের চাকরি ক্ষেত্রের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে পারছে কিনা, অথবা দেশের সার্বিক উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয় কী ভূমিকা পালন করছে সে ব্যাপারে খুব একটা আলোচনা হচ্ছে না।
 
আমার দৃষ্টিতে উচ্চশিক্ষা বিষয়ক রিপোর্টিংয়ের একটি প্রধান সমস্যা হচ্ছে আমাদের দেশে বড়  পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস প্রতিবেদকরা সাধারণত স্ব-স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়ায় স্বার্থের সংঘাতের বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। একজন শিক্ষার্থী তার নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে রিপোর্টিংয়ে কতটুকু বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখতে পারে সেটা আমার কাছে এক বিশাল প্রশ্ন! সে কি দুর্নীতির ব্যাপারে সব ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের চাপ সামাল দিতে পারবে? আমার মতে তাকে অবশ্যই সিনিয়র সাংবাদিকদের সহযোগিতা নিতে হবে।  

সেই সঙ্গে অল্প বয়স্ক হওয়ায় স্বভাবতই তাদের অনেকের অভিজ্ঞতার ঘাটতি রয়েছে। আমি উপরে শিক্ষা সংক্রান্ত রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে যে সামান্য কিছু ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছি সেগুলোর অনেক কিছুই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবেদকের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। আমি কিছু দিন আগে অনলাইনে শিক্ষা নিয়ে সংবাদ মাধ্যমের এক ভিডিওক্লিপে এক রিপোর্টারের বিশ্লেষণ দেখছিলাম। আমি কিছুক্ষণ দেখার পরে বুঝলাম যে যিনি অনুষ্ঠান পরিচালনা করছেন বা সংশ্লিষ্ট রিপোর্টার তাদের দুজনেরই উচ্চশিক্ষার সাম্প্রতিক বিষয়গুলো নিয়ে জ্ঞানের যথেষ্ট ঘাটতি আছে। তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।  

বস্তুত শিক্ষা বিষয়ক রিপোর্টিং সাম্প্রতিককালে সাংবাদিকতার একটি বিশেষায়িত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কোভিড-পরবর্তী শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে।   শিক্ষা বিষয়ক রিপোর্টিং নিয়ে পিআইবির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের সাংবাদিকদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে। যথাযথ প্রশিক্ষণ ছাড়া উচ্চশিক্ষার জটিল অনেক বিষয়ই বোঝা সম্ভব নয়। একজন প্রশিক্ষিত গণমাধ্যম কর্মীই কিন্তু পারেন দেশের উচ্চশিক্ষার বিকাশে যথাযথ ভূমিকা রাখতে।
 
লেখক: কলামিস্ট; বিভাগীয় প্রধান, জার্নালিজম, কমিউনিকেশন ও মিডিয়া স্টাডিজ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।

ইমেইলঃ [email protected]
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী: ওয়াশিংটনে অর্থমন্ত্রী
ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী: ওয়াশিংটনে অর্থমন্ত্রী
ইউরোপা লিগ থেকে বিদায়ের ভালো দিক দেখছেন লিভারপুল কোচ
ইউরোপা লিগ থেকে বিদায়ের ভালো দিক দেখছেন লিভারপুল কোচ
রাশিয়ায় বোমারু বিমান বিধ্বস্ত
রাশিয়ায় বোমারু বিমান বিধ্বস্ত
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা সীমান্তরক্ষীদের নিতে জাহাজ আসবে এ সপ্তাহেই
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা সীমান্তরক্ষীদের নিতে জাহাজ আসবে এ সপ্তাহেই
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ