X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

আমেরিকার মিশন ইমপসিবল

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
১৮ আগস্ট ২০২১, ১৬:৩৮আপডেট : ১৮ আগস্ট ২০২১, ১৬:৩৮

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সারা জীবন সমাজের পরিবর্তন আর মানুষের বিবর্তন নিয়ে কাজ করেছেন জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আশরাফ গণি। ন্যাশন বিল্ডিং তথা জাতি গঠন, বিশেষ করে ব্যর্থ রাষ্ট্রকে সফল পরিণত করার দুর্দমনীয় আশা ছিল তার। বইও লিখেছেন এ নিয়ে। কিন্তু সাফল্য দূরে থাক, লুটের মাল হিসেবে প্লেনভর্তি টাকা আর যতসব দামি জিনিস নিয়ে পালিয়ে বেঁচেছেন এই আফগান প্রেসিডেন্ট। নিজের দেশের মানুষের মুক্তি যার দিশা ছিল, সেই মানুষদের তিনি তালেবান নামের হিংস্র হায়েনার সামনে ফেলে দিয়ে গোপনে দেশে ছেড়ে গেছেন। অর্থ যেহেতু তার সঙ্গে আছে, আমেরিকার মতো দেশ কিছুটা হলেও মূল্য দেবে, তাই কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই পা রাখবেন তিনি। বর্তমানে তিনি অবস্থান করছেন আবুধাবিতে।

কিন্তু যে আমেরিকা সারা পৃথিবীতে গণতন্ত্র আর মানবাধিকার রফতানি করে, সে আমেরিকা আকাশ থেকে আফগানদের ফেলে পালিয়ে যায় – এমন দৃশ্য দেখলো সভ্য দুনিয়ার মানুষ। দুই দশক আগে সাধারণ আফগানদের ভাগ্য ফেরানোর নামে অস্ত্রের বলে আফগানিস্তান দখল করে নিয়ে যে স্বপ্নের জাল বুনেছিল, হঠাৎ করেই সব ফেলে চলে গেলো মার্কিনিরা। আমেরিকা তার সেনা আর নাগরিকদের ফিরিয়ে ফিরলো। কিন্তু ফিরলো না আফগানদের ভাগ্য। তারা অন্ধকারে ফেরত গেলো তালেবানি অস্ত্রের ঝনঝনানিতে। অল্প সময় নয়, গোটা ২০টা বছর আফগানিস্তানে যুদ্ধ চালিয়ে শেষ মুহূর্তে তল্পিতল্পা গুটিয়ে পালিয়ে গেলো, যেভাবে ১৯৭৫ সালে ভিয়েতনাম থেকে পালিয়েছিল আমেরিকা।

চিলির সালভেদর আলেন্দে কিংবা কঙ্গোর প্যাট্রিস লুলুম্বা, ইরাকের সাদ্দাম বা লিবিয়ার মুয়াম্মার আল গাদ্দাফি – জনপ্রিয় সব নেতাকে হত্যা করে, একের পর এক দেশ দখল করে করে আমেরিকানদের প্রিয় শব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছিল– ‘MISSION accomplished’  বা কাজ সমাপ্ত। কিন্তু পরাক্রমশালী আমেরিকার যুদ্ধ জয়ের ইতিহাস নেই। ভিয়েতনাম, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া এবং সবশেষে আফগানিস্তান- প্রতিটি দেশ থেকেই খালি হাতে ফিরেছে আমেরিকা। কিন্তু সেই দেশগুলো কতটা খালি হয়েছে সেটা সেসব দেশের জনগণ জানেন। দীর্ঘ ২০ বছর ধরে কোটি কোটি ডলার খরচ করে, হাজার হাজার সৈনিকের দেহ কফিনবন্দি করে, দেশের ইতিহাসের দীর্ঘতম যুদ্ধ শেষ করে আবারও খালি হাতেই আফগানিস্তান থেকে ফিরলো আমেরিকা। এক ওসামা বিন লাদেনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে আমেরিকা গত ২০ বছরে আফগানিস্তানে যুদ্ধের পেছনে ২ লক্ষ ২৬ হাজার কোটি ডলার খরচ করেছে। এরমধ্যে শুধু আফগান সেনাদের প্রশিক্ষণ দিতেই খরচ হয়েছে ৮ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। সরাসরি যুদ্ধেই তাদের ৮১ হাজার ৫৭০ কোটি ডলার খরচ হয়েছে। কিন্তু দিনশেষে তার সম্বল পরাজয়।

আল কায়েদা এবং তাদের আশ্রয়দাতা তালেবান নিধনের লক্ষ্যেই আফগানিস্তানে গিয়েছিল আমেরিকা। কিন্তু তারা বড় কোনও পরিবর্তন করতে পারলো না। অর্থ খরচ করেছে, কিন্তু আফগান সরকারি বাহিনীকে শক্তিশালী করতে পারেনি। দূরে রেখেছিল, কিন্তু জঙ্গি তালেবানদের দুর্বল করতে পারেনি। পানির মতো টাকা খরচ করেছে আমেরিকা ও তার মিত্ররা। বাঁধ, পাকা রাস্তা, স্কুল, হাসপাতাল তৈরি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আফগানিস্তানকে কোনও বাসযোগ্য দেশ বানাতে পারেনি। বিপুল বেকারত্ব এবং দারিদ্র্য নিয়ে দেশটি এখন আবার পড়লো চরম জঙ্গি তালেবানের হাতে।  

তালেবানের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী আমেরিকা সেনা সরাতে শুরু করে। এবং বড় দলটি দেশ ছাড়ে রাতের অন্ধকারে। এরপরই তালেবানদের আর ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। আইনশৃঙ্খলা হাতে রাখতে ব্যর্থ হন আশরাফ গণি। পেন্টাগনের সিদ্ধান্ত মেনে আমেরিকার সেনা তালেবানের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ থেকে সরে আসে। সেই পরিস্থিতিতে তালেবান একের পর এক প্রদেশ দখল করতে শুরু করে। একের পর এক প্রদেশের শাসক আত্মসমর্পণ করতে থাকে। ২০ বছর ধরে তিলে তিলে সাজানো আফগান সেনা থেকে দলে দলে তালেবানে যোগ দেওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। আর এমন এক বাস্তবতায় ভবিষ্যৎ বুঝতে পেরে আলাদা করে তালেবান নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক শুরু করে দেয় চীন ও রাশিয়া। এবং বাদ যায়নি ইরানও।

আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের সমর্থনে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত সোমবার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে বলেছেন, আফগানিস্তান থেকে এভাবে সরে আসায় তিনি অনুতপ্ত নন। দায়িত্বহীন মানুষের মতো বলে দিলেন, আফগানিস্তানে যা ঘটলো, সেটা ওই দেশের সামরিক এবং রাজনৈতিক শক্তির ব্যর্থতা। বাইডেন দাবি করেন, আল কায়েদার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়েছিল আমেরিকা, আফগান রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে দেওয়ার জন্য যায়নি। তা-ই কি আসলে? ইতিহাস বলে আমেরিকা প্রতিটি দেশে সৈন্য পাঠিয়েছে সেই জাতিকে পুনর্গঠনের নামে। তাহলে বলতেই হয় ইতিহাস আমেরিকাকে ক্ষমা করেনি। কিংবা জো বাইডেন এক নতুন আমেরিকার কথা ভাবছেন যে নিজের দেশ রেখে ভবিষ্যতে আর অন্য কোনও জাতি গঠনের খায়েশ দেখাবে না।

এই যুদ্ধে ‘ন্যাংটো রাজা’র মতো ভাবমূর্তি সৃষ্টি হয়েছে আমেরিকার। যেভাবে তার ভাবমূর্তির ক্ষতি হয়েছে তা টাকার অঙ্কে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। চীন, রাশিয়া যেভাবে বিশ্ব রাজনীতির মাঠে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করলো, ইরান এখন যে ভাষায় কথা বলছে, সিরিয়ায় যেভাবে রাশিয়ার কাছে নাস্তানাবুদ হয়েছে – সব মিলিয়ে বলা যায় আমেরিকার একক আধিপত্য আর নেই বিশ্বে।

আসলে ভিয়েতনাম থেকে শিক্ষা নিয়ে আফগানিস্তান থেকে আগেই সরে যাওয়া উচিত ছিল আমেরিকার। সেটা সে করেনি। শান্তি এবং স্থিতি অবস্থা ফিরিয়ে আনার আশ্বাস দিয়ে একসময় আফগানিস্তানে ঘাঁটি গেড়েছিল আমেরিকা। কিন্তু আফগানবাসীকে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে পাততাড়ি গুটিয়ে নেওয়া আমেরিকা আর যেন কোনও পরাশক্তি নয়। গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে অন্য দেশ দখলের মার্কিন সংস্কৃতির অবসান হয়েছে কিনা তা সময়ই বলবে। আফগানিস্তান ছিল আমেরিকার সত্যিকারের মিশন ইমপসিবল।  

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
দুই বলের ম্যাচে জিতলো বৃষ্টি!
পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড প্রথম টি-টোয়েন্টিদুই বলের ম্যাচে জিতলো বৃষ্টি!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ