X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার করুণ কাহিনি: তালেবানের কাবুল দখল ও ‘ইয়াঙ্কি জিহাদি’

মাকসুদুল হক
২২ আগস্ট ২০২১, ১৫:২৪আপডেট : ২২ আগস্ট ২০২১, ১৫:২৪

মাকসুদুল হক ‘তুমি চোর’রে কও চুরি করো, গৃহস্থরে কও ধরো ধরো
তবু কেন মাটির সন্তান হইলো গুনাহগার গো
মানুষও বানাইয়া খেলছো যারে লইয়া’।

– গ্রাম্য প্রবাদ ভিত্তিক গান
 
 
আফগানিস্তান প্রশ্নে ২০ বছরের অধিক সময় আমাদের পশ্চিমা শক্তিগুলো যেমন ঢালাও ভাবে তাদের মিথ্যাকে গুণকীর্তন করা শিখিয়েছে– অপর দিকে সত্যকে মিথ্যা বলে বুঝতে, বোঝাতে ও বলতেও বাধ্য করেছে। অথচ সত্য আজ এসে রুঢ়ভাবে আমাদের সবার মুখমণ্ডলে নির্বিচারে চপেটাঘাত করছে।

তালেবান নামের সেই ‘ভয়ানক ও বর্বরোচিত শত্রু’ কাবুল দখল করেছে। এবার কী হবে?
 
যেখানে পশ্চিমা শক্তি ও তার লেজুড়বৃত্তি করা আফগানিস্তানের আশরাফ ঘানি সরকার ঘোষণা করেছিলো– তালেবান যতই অন্যান্য প্রদেশ দখল করুক, রাজধানী কাবুল ঘেরাও করে দখল করতে তাদের লাগবে নিদেনপক্ষে ৯০ দিন। অথচ সকল জল্পনা-কল্পনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তালেবান কাবুল ১০ দিনেই দখল করে ফেললো।
 
পৃথিবীর রণযুদ্ধের ইতিহাসে এটি একটা বিরল ঘটনা– কারণ খুবই স্বল্প মৃত্যুর ঘটনা বা ক্ষয়ক্ষতি এবার ঘটেছে। একভাবে চিন্তা করলে– বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তালেবান কাবুল অব্দি পৌঁছাতে পেরেছে। আপাত দৃষ্টিতে সম্ভাব্য রক্তগঙ্গা প্রতিহত করা হয়েছে কেবল তালেবানদের তথাকথিত ‘ভদ্র ও স্বাভাবিক’ আচরণের কারণে।

এক সপ্তাহে কিছু উশৃঙ্খল ঘটনা ছাড়া ব্যাপক কোনও তালেবান দ্বারা কুৎসিত তৎপরতা খবরে অনুপস্থিত। যুদ্ধ শেষে তারা মিডিয়াতে ‘চার্ম অফেন্সিভ’-এ ব্যস্ত। সমগ্র বিশ্বকে তাদের সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টি লক্ষে এই মুহূর্তের সকল কর্মকাণ্ড সীমিত।
 
তবে এই অব্দি তাদের চিরাচরিত ইসলামি শারিয়া আইন প্রয়োগ করে প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ এমনকি নারী নির্যাতন, নারীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা, নারীরা ঘর থেকে বের হয়েছে বলে পথঘাটে বেদম প্রহার, ধর্ষণ এসবের কোনও খবর গণমাধ্যমে একেবারে পাওয়া যাচ্ছে না বললে ভুল হবে– তবে খুবই কম পাওয়া যাচ্ছে।
 
বলা হচ্ছে পাল্টানো সময়ে এ এক ‘সংশোধিত ও নবজাগ্রত তালেবান’ যার সাথে ১৯৯৬-২০০১ পর্যন্ত যে তালেবান সরকার ক্ষমতায় ছিল তার কোনোরকম মিল নেই। আইফোনের ন্যায় এ নাকি ‘তালেবান ২.০’–  অর্থাৎ নব্য অত্যাধুনিক তালেবান।
 
বিগত তালেবান সরকারের প্রকাশ্যে বর্বরোচিত আচরণ যথা নারীদের চাবুক দিয়ে প্রহার করা,ব্যাভিচার বা ‘জেনাহ’র দায়ে পাথর ছুড়ে মৃত্যদণ্ড কার্যকর করা, চুরির দায়ে হাত কাঁটা ও অদ্ভুত সব কায়দা-কানুন যার সাথে ইসলামের কোনও সম্পর্ক নেই– সমগ্র বিশ্বে যেমন ক্ষোভ সৃষ্টি হয়, একই রকম ক্ষোভ ও শঙ্কা সৃষ্টি হয় বহু ইসলামিক ও মুসলিম প্রধান দেশে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়।

মধ্যযুগীয় বর্বরতা এই পরিবর্তিত পৃথিবীতে মানব মনে শিহরণ, ভয় ও আতঙ্ক জাগানো খুবই স্বাভাবিক আর তা যখন ইসলামের নামে সংঘটিত হয়–  তার ফলে পশ্চিমাদের ভেতরে জঘন্য মুসলিম বিদ্বেষ বা ‘ইসলামোফোবিয়া’র প্রকটভাবে যে আবির্ভাব ঘটেছে তা আমাদের সমষ্টিগত চিন্তা থেকে সরিয়ে দেওয়াটাও অসম্ভব।
 
পাশাপাশি তালেবানের ওসামা বিন লাদেন ও আল কায়দাকে তাদের মাটি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালানোর জন্য ঘাঁটি ও মদদ দেওয়াই আফগানিস্তানের ভাগ্যে নেমে আসে চরম বিপর্যয়। যদিও এ নিয়ে বহু মত, দ্বিমত ও বিতর্ক আছে। আল কায়েদার নিউ ইয়র্ক শহরে ২০০১ এর ১১ সেপ্টেম্বর আক্রমণের কারণে, কেবল তালেবান নয়, সমগ্র বিশ্বে মুসলিম জনগণের ওপরে নেমে আসে অবর্ণনীয় জুলুম, ধিক্কার ও নির্যাতন।
 
রাতারাতি ইসলাম ‘শান্তির ধর্ম’ থেকে হয়ে উঠলো ‘জঙ্গি সন্ত্রাসবাদীদের ধর্ম’ ও পশ্চিমা বিশ্ব ঘোষণা দিলো এই ‘গ্লোবাল জিহাদ’ তারা যেকোনও মূল্যে প্রতিহত করবে। ইসলাম ও মুসলিম যে পৃথক দুটো বিষয় সেই আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণে সে সময় অনেকেই দেওয়ার চেষ্টা করলেও– সেই চেষ্টার অর্থ ছিল নিজেদের পশ্চিমা মিডিয়া দ্বারা বোকা বনা– কারণ পশ্চিমারা ইতিমধ্যে মুসলমানদের পুরো দস্তুর স্টেরিওটাইপিং করা শুরু করে দিয়েছিলো যা এখনও চলমান।
 
এই ঘৃণা,এই মানুষ মানুষে দ্বন্দ্ব গেলো ২০ বছরে কেবল তীব্র হয়নি– মুসলিম মুসলিম সংঘাত, বিদ্বেষ, দাঙ্গা ও যুদ্ধ বেড়েই চলেছে। জঙ্গিবাদ প্রতিহত করতে মার্কিন হস্তক্ষেপের আগের ও পরের চিত্র- ইরাক, লিবিয়া, ইয়েমেন বা সিরিয়ার অবস্থা কী ছিল, এবং এখনকার দুরবস্থা, তা সকলের নিশ্চয়ই বোধগম্য।

এই কাজে একটা ‘বিশেষ সুবিধা’ হয়ে গেলো পশ্চিমাদের। ওপরের দেশগুলোর কথা বিবেচনায় রাখলে একটা বিষয় অন্তত পরিষ্কার: আজ পশ্চিমা শক্তি সমূহ নিজেরা মানুষ খুন করে নিজেদের হাত আর নোংরা করে না। সে সম্ভাব্য সব রকম কৌশল নিয়োগ করছে মুসলিম দ্বারা মুসলিমদের নিধন - ও আফগানিস্তান ও তার ভবিষ্যৎ সেদিকেই যে এগুচ্ছে তা দৃঢ়ভাবে আমি বিশ্বাস করি। তালেবান বা পশ্চিমাদের এই মুহূর্তের ‘শান্তির জুজু’ অত্যন্ত সীমিত সময়ের জন্য ও এরপর যা ঘটবে তার জন্য আমাদের কারো কোনও মানসিক প্রস্তুতি আছে বলে আমি মনে করি না।
 
প্রশ্ন হচ্ছে এরপর কী?

কয়েক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে তৈরি করা ৩,০০,০০০ সৈন্যর ভারী অস্ত্র, ট্যাংক, বিমান বাহিনী ইত্যাদি সুসজ্জিত আফগান সামরিক বাহিনী কেন যুদ্ধ না করে তালেবানের কাছে আত্মসমর্পণ করলো বা যুদ্ধ ময়দান ছেড়ে পলায়ন করে অন্যত্র সরে গেলো? তাও আবার সংখ্যায় ৭০,০০০ স্বল্প ও হাল্কা অস্ত্র সজ্জিত অনিয়মিত এক তালেবান গেরিলা বাহিনীর অগ্রসর হওয়ার মুখে?

এর পেছনে কাজ করেছে যুদ্ধের ক্লান্তি সহ তিক্ততা ও তালেবানের প্রতি লাগামহীন ভয়। হয়তোবা আরেকটা কারণ ছিল বিদেশিদের ইন্ধনে আফগানরা ভাইয়ে ভাইয়ে কতল করতে আর ইচ্ছা প্রকাশ করছিলো না।

তবে যে বিষয়টা উপেক্ষিত তা হলো তালেবানের প্রতি জনসমর্থনেরও কোনও কমতি ছিল না। একটি বিদেশি শক্তির তোষামোদি করা বাহিনীকে ২০ বছর জনগণ সহ্য করেছে– এ-কি কম? এমনি এক ভয় যা দেশের প্রেসিডেন্টকে বাধ্য করেছে জনগণকে ভাগ্যের ওপর ফেলে দিয়ে, রাতারাতি পালিয়ে যেতে।

এখন প্রতি ঘণ্টায় টেলিভিশন পর্দায় দেখা যাচ্ছে কাবুল এয়ারপোর্টের করুণ ও অসহায় চিত্র। লাখো মানুষ পালানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। কাবুল এয়ারপোর্টে মার্কিন, ব্রিটিশ ও অন্য পশ্চিমা দেশের সেনারা ‘লোহার বেষ্টনী’ সৃষ্টি করে সবাইকে ঘিরে রেখেছে।

অপর দিকে তালেবান বাহিনী তাদেরকেও আরেক বিশাল বেষ্টনী দিয়ে পাল্টা ঘেরাও করে রেখেছে। ধারণা করা হচ্ছে এ অবস্থা চলতে থাকবে ৩১ আগস্ট ২০২১ অব্দি। এই থমথমে পরিস্থিতিতে যে কোনও দুর্ঘটনা ঘটে গেলে অবাক হওয়ার কিছুই নেই।
 
এ কার ব্যর্থতা? আফগানিস্তান দেশটির, তার জনগণ নাকি পশ্চিমা শক্তিদের? এ নিয়ে দীর্ঘদিন আলোচনা যে চলতে থাকবে তা অবধারিত।
 
তবে আমাদের বিশ্লেষণের প্রথম প্রশ্ন থাকবে– ভাই একটু থামেন। এই তালেবান, এই আল কায়েদা, এই আইসিস, এই হেজবুল্লাহ– এসকল তথাকথিত ‘জঙ্গি সংগঠন’ সৃষ্টি করলো কে? এই সকল গোমূর্খদের ‘যুদ্ধ করে শান্তি আন্তে হবে’ এ দীক্ষা কে দিয়েছে? কোথায় তাদের রসদ, কোথায় তাদের অর্থ, কোথায় তাদের যুদ্ধে টিকে থাকার মানব সম্পদ?

সব কিছুর মূলে মার্কিনি ও বিভিন্ন পশ্চিমা শক্তি, তাদের দালাল, গুপ্তচর ও গোয়েন্দা সংস্থা। এসকল মুসলমান নামধারী ‘ইয়াঙ্কি জিহাদি’ তারা নিজেরাই সৃষ্টি করে ও নিজেরাই ধ্বংস করে– এ আর ‘নতুন’ কী? মাঝামাঝি সুযোগ করে নেয় বিরতিহীন নিরীহ মুসলমান কতল করার মচ্ছব - যদিও মুখেমুখে দাবি করে ‘এই যুদ্ধ ইসলামের বিরুদ্ধে নয়, এ যুদ্ধ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে।’
 
একটু ভেবে দেখেন তো– জর্জ বুশ, বিল ক্লিনটন ও বারাক ওবামা এই তিন মার্কিনি প্রেসিডেন্ট সম্মিলিতভাবে ২৩ বছরে ‘গ্লোবাল জিহাদ’ রুখার বাহানায় বিশ্বের ৯টি ইসলামি বা মুসলিম প্রধান দেশ দখল করে ১ কোটি ১০ লাখ মুসলমান নির্বিচারে হত্যা করলো। অথচ তাদেরকে কেউ ‘সন্ত্রাসী’ বা ‘জঙ্গি’ বলে না।
 
পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’এর  প্রধান ও প্রথম মহাপরিচালক জেনারেল হামিদ গুল অবসর গ্রহণের পর মার্কিন সৈন্য বাহিনীর ১৯৯৬ সালে আগমনের কিছু দিন আগে বলেছিলেন–
 
‘মার্কিনিরা এক বিশাল ভুল করতে যাচ্ছে। তারা জানে না যে স্বাধীনচেতা আফগানরা কোনও বিদেশি শক্তিকে বরদাশত করে না। ইতিহাসে ঘটলে দেখা যাবে ওরা  ব্রিটিশ, রাশিয়ান সব বিদেশি সামরিক বাহিনীদের নাকানি-চুবানি খাইয়ে বিতাড়িত করেছে। আফগানরা এক যুদ্ধবাজ জাতি। ওরা যুদ্ধে অত্যন্ত আনন্দ থাকে। যুদ্ধই ওদের শান্তি। যুদ্ধ না থাকলে ওরা অশান্তিতে থাকে–
 
এমনি একটা ‘অদ্ভুত’ জাতি সমগ্র বিশ্বের আলোচনার আজ  কেন্দ্রবিন্দু। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে তালেবানের প্রভাবে কী ঘটতে পারে তা নিয়ে বিশ্লেষকদের আলোচনা ও পর্যালোচনাও শুরু হয়েছে। তবে আমরা যেটা জানি না তা হলো তালেবান আর আফগান সমার্থক শব্দ নয়।
 
পাশতুন, হাজারা, উজবেক, নুরিস্তানি, আইমাক, বালুচ, তুর্কমান সহ আরও একাধিক উপজাতীয় ও নৃগোষ্ঠী সম্মিলিত দেশ আফগানিস্তান। পুশতু ও দারি রাষ্ট্র স্বীকৃত সরকারি ভাষা। এই তালিকায় খুবই স্পষ্ট যে আফগানিস্তান ও তালেবান পৃথক দুটি বিষয়। একটি জাতি অপরটি এক ক্ষীণদৃষ্টি সম্পন্ন সত্তা– যা ইসলামকে অপব্যবহার করছে পশ্চিমা ইন্ধনে। আফগনিস্তানকে যুগযুগ ধরে পশ্চাৎপদতা ও অন্ধকারে আচ্ছন্ন রেখেছে।  
 
একটু ফিরে তাকালেই এর নেপথ্যের কাহিনি বোঝা সম্ভব।

১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ এই ১০ বছর সোভিয়েত রাশিয়া আফগানিস্তান দখল করলে যুদ্ধে প্রায় ২০ লক্ষ লোক মারা যায়। এর মূল কারণ ছিল আফগানিস্তানের কমিউনিস্টদের ১৯৮৯ সালে সংঘটিত সামরিক অভ্যুত্থান ও ক্ষমতা দখল যা নস্যাৎ করতে মার্কিনি গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ সহায়তা নিয়েছিলো পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর। আফগানিস্তানের সাহায্যে এগিয়ে আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, যুক্তরাজ্য সহ চীন এমনকি ইসরায়েল।
 
ইসলামি ইতিহাসে এই প্রথম একটি ‘জিহাদ’ ঘোষণা দিয়েছিলো অমুসলিম রাষ্ট্রসমূহ ও মুজাহিদীন গেরিলা নেতাদের হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান তাদের ভূয়সী প্রশংসায় ছিলেন পঞ্চমুখ। ইসলাম বা আফগানিস্তানের পক্ষে নয় বরং সোভিয়েত রাশিয়াকে পরাজিত করতে অস্ত্র সহ যত রকম সহায়তা দেওয়া সম্ভব তা পশ্চিমা শক্তিরা দিয়েছিলো। আফগানদের জন্য এটা ছিল ‘কমিউনিস্ট নাস্তিকতা বিরোধী জিহাদ’– ও সমগ্র মুসলিম জাহান থেকে শতশত বিদেশি যোদ্ধা যোগ দিয়েছিলো এই জিহাদে। এমনকি বাংলাদেশ থেকেও।
 
কিন্তু যুদ্ধে শেষ হওয়ার সাথে সাথে পশ্চিমারা হাত গুটিয়ে সরে পড়লেন অর্থাৎ বাঁদরকে গাছে চড়িয়ে দিয়ে গোড়া কর্তন করলেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৯ কাবুল সোভিয়েত রাশিয়া থেকে মুক্ত হলেও শান্তি নামের বস্তুটি কেবল মরীচিকা রয়ে গেলো।
 
উদহারণ স্বরূপ ১৯৯১ এ সোভিয়েত রাশিয়ার পতন ঘটলে ১৯৯২ সালে কাবুল মুজাহিদীন গেরিলারা দখল নেয়। কিন্তু ইতিমধ্যে তাদের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের কারণে যুদ্ধ আরও তীব্র আকার ধারণ করে। যুদ্ধবাজ নেতা গুলবুদ্দীন হেকমাটিয়ার কাবুলের ওপরে লাগাতার হামলার কারণে ৫০ হাজারের ঊর্ধ্বে মানুষ মারা যায় ও কাবুল শহর প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। বিশৃঙ্খলা, অভ্যন্তরীণ হানাহানির কারণে রক্তপাত ও লাখ লাখ লোক পাকিস্তান ও ইরানে শরণার্থী হিসেবে পলায়ন করা শুরু করে।
 
এ অবস্থায় একেবারে আকস্মিকভাবে ১৯৯৪ সালে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মাদ্রাসা পড়ুয়া ছাত্ররা ‘তালেবান’ নাম আত্মপ্রকাশ করে দক্ষিণ আফগানিস্তানের কান্দাহার শহর দখলে নিয়ে নেয়। ১৯৯৬ এর সেপ্টেম্বর ২৬ তারিখে তালেবান যোদ্ধারা কাবুল শহর দখলে নিয়ে নেয়।
 
বাকিটা ইতিহাস যা আমি নিশ্চিত নতুন করে আর বলার বা বোঝানোর কোনও অবকাশ এখানে নেই।

আফগানিস্তানের সম্ভাব্য ভবিষৎ দৃশ্যবিবরণী:
 
১. কাবুল এয়ারপোর্ট এই মুহূর্তে এক অভয় অরণ্য। তার টারমাকে ও রানওয়ে কোনোটাই তালেবানদের নিয়ন্ত্রণে নেই। এমনকি কে আসছে আর কে যাচ্ছে তারও কোনও হিসাব তাদের কাছে নেই। আটকে পড়া বিদেশি ও আফগান পশ্চিমা দালালদের উদ্ধার ও পলায়নের চেষ্টায় ব্যবহৃত যে সকল বেষ্টনী এয়ারপোর্ট ও তার আশপাশের অঞ্চলে সৃষ্টি হচ্ছে- তা যে কোনও মুহূর্তে ভেঙে পড়ার জোর সম্ভাবনা।
 
২. যে বিমানগুলো বিদেশ থেকে আসছে মানুষ উদ্ধার করতে তা কি বিনা যাত্রী নিয়ে আসছে? না, বহু দেশের সেনা ও ভাড়াটে সৈনিকরা গোপনে আসছে তালেবানদের আকস্মিক ও বিশাল এক ধাক্কা দিতে। সাধারণ ও বেসামরিক মানুষ কী পরিমাণ মারা যেতে পারে তা কেবল অনুমেয়।
 
৩. ইতিমধ্যে পশ্চিমা মিডিয়া প্রচার করছে যে তালেবান বিরোধী ছোট ছোট বিক্ষোভ সমাবেশ সমগ্র আফগানিস্তানে ছেয়ে গেছে। তালেবান পতাকাকে উপেক্ষা করে প্রাক্তন আফগান রাষ্ট্রের পতাকা নিয়ে সম্মিলিত নারী-পুরুষ পথে ঘাটে নেমে পড়েছে, এমনকি বিভিন্ন ধরনের অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে।
 
৪. পাশাপাশি পাঞ্জশির সহ বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল যেখানে পূর্বে রুশ, পশ্চিমা শক্তি কিংবা তালেবান কখনই দখলে নিতে পারেনি সেখানে হাজারো তালেবান বিরোধী যোদ্ধারা সমবেত হচ্ছে।

উভয় ক্ষেত্রে যে বিষয়টা লক্ষণীয়– আফগানিস্তানের সকল মুক্তিকামী মানুষ ‘পশ্চিমা সাহায্যের’ মুখাপেক্ষী। এর অর্থ গিয়ে দাঁড়াচ্ছে আফগানিস্তান সম্পর্কে শেষ দাবার গুটিটি পশ্চিমারাই দান খেলবে। আফগান বা তালেবানরা নয়।
 
৫. তালেবান বলছে তাদের ইসলামি রাষ্ট্রের ধরন ও বাস্তবিক চিত্র কী হবে তা তারা বিদেশি সন্যরা ৩১ আগস্টে ত্যাগ করার পর ঘোষণা দেবে। ইতিমধ্যে পশ্চিমারা ৩১ আগস্ট বাঁধা সময় ছাড় দিয়ে দু’সপ্তাহ বিলম্ব করা যায় কিনা তা তালেবানদের সাথে আলোচনা করছে। আপাতত বলা হচ্ছে এটি ‘ইসলামি আমিরাত আফগানিস্তান’ হবে; আইসিস-এর মতো ‘খেলাফত’ না। এই সম্ভাব্য ইসলামি আমিরাত সমগ্র বিশ্ব সহ ইসলামি ও মুসলিম প্রধান দেশরা কীভাবে গ্রহণ করে– তা দু’সপ্তাহের অন্তর বোঝা যাবে। এই মুহূর্তে তা বলা সম্ভব না।
 
৬. মূলত তালেবানের কাবুল তথা আফগানিস্তান দখল পশ্চিমাদের ‘জাত শত্রু’ রাশিয়া, চীন ও ইরানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা, বেকায়দায় ফেলে এক ধরনের ‘ঘোলা জলে মাছ শিকার’ এর উপক্রম মাত্র। পাকিস্তান একটি দালাল ও বেঈমান রাষ্ট্র - তা আমরা ১৯৭১ সালে টের পেলেও বিশ্ববাসী, বিশেষ করে তথাকথিত ইসলামিক রাষ্ট্র সমূহ এখনও টের পাইনি। আফগানিস্তান প্রশ্নে পাকিস্তানের ভূমিকা সব সময় প্রশ্নবিদ্ধ ছিল ও পশ্চিমাদের কাছে কখনোই তা পরিষ্কার বা স্বচ্ছ ছিল না। তবে তার তাবেদারী,দালালি ও পশ্চিমা পরাশক্তির কাছে নতজানু থাকা - এ নতুন কোনও বিষয় না।

৭. তালেবান পাকিস্তানের সৃষ্টি কেবল নয়, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেনাজির ভুট্টো ‘তালেবান জননী’ বলেও আখ্যায়িত। ইমরান খান তার দেশের অর্থনৈতিক দেউলিয়াপনা থেকে উদ্ধার হতে আফগানিস্তান পরিস্থিতি যে সকল ‘শুভ ও অশুভ’ সুযোগ নেবেন তার কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই।
 
৮. আফগানিস্তান দেশটি তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদের কোনও অভাব নেই। তাকে ইচ্ছাকৃত ভাবে শতশত বছর ধরে দেশটাকে দরিদ্র রাখা হয়েছে কেবল মাত্র পশ্চিমা শক্তিদের ইন্ধনে। প্রচণ্ড স্বাধীনচেতা জাতি হলেও আফগানিস্তানকে দিকভ্রান্ত করে রেখেছে যুদ্ধের পর যুদ্ধের মাঝে। যুদ্ধ তার আর শেষ হওয়ার নয়। প্রকৃত স্বাধীনতা থেকে এই দেশটি বহুকাল ধরে বঞ্চিত। তবে তার দুর্ভাগ্যের অন্ত নেই কারণ এত কিছু সম্পদ থাকা সত্ত্বেও আফিম উৎপাদন তার ভাগ্যকে নিদারুনভাবে ক্ষতি সাধিত করে এসেছে। বিশ্বের সব চাইতে বৃহৎ আফিম রফতানিকারী আফগানিস্তান। তবে এই ব্যবসা সবটাই চোরাই পথে চলে ও এই নিষিদ্ধ দ্রব্যের ক্রেতা মূলত পশ্চিমা দেশগুলো।

আফিম থেকে সৃষ্ট মরফিন ও হেরোইনের ৭০ ভাগ চালান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ বিশ্বের নারকোটিক মাফিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। কত হাজার কোটি বা ট্রিলিয়ন ডলারের এই ব্যবসা তা বলা মুশকিল কিন্তু তথাকথিত ‘ইসলামি জঙ্গি সংগঠন’ তালেবানও এই ব্যবসায় মধ্যস্বত্বভোগী বহু বছর ধরে। তার অস্ত্র কেনার অর্থ, তার বাণিজ্যিক পুঁজি, তার চাঁদার উৎস সবই আফিম। সবই হেরোইন থেকে। আফগানিস্তানের ভাগ্য মাদক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কাবুল দখল হওয়া আর না হওয়ায় কোনও কিছুই যায় আসে না। এখন দেখার অপেক্ষায় থাকলাম– এই আফিম, হেরোইন ব্যবসা শেষমেশ কে দখলে নিতে পারে। তবে তাতে শান্তি যে ফিরে আসবে তেমন কোনও গ্যারান্টি নেই ।

লেখক: সংগীত শিল্পী

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
পশ্চিমবঙ্গে প্রথম দফার ভোট শেষেই বিজয় মিছিল
পশ্চিমবঙ্গে প্রথম দফার ভোট শেষেই বিজয় মিছিল
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ