X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত

মো. সামসুল ইসলাম
২২ আগস্ট ২০২১, ১৫:৪৭আপডেট : ২২ আগস্ট ২০২১, ১৫:৫০

মো. সামসুল ইসলাম দেশে উচ্চ শিক্ষার মানোন্নয়নে সাম্প্রতিককালে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এসবের মধ্যে আমার কাছে যেটি সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে তাহলো সরকার কর্তৃক পাবলিক ও প্রাইভেট সব ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য দেশে একটি শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট গঠনের সিদ্ধান্ত। বাংলা ট্রিবিউনেই পড়লাম শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ইউজিসি এ ব্যাপারে আইনি কাঠামো তৈরির কাজও শুরু করে দিয়েছে।

আমার কাছে এটা বিস্ময়কর মনে হয় যে দেশের বেশিরভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য কোনও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নেই। কিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিক্ষক প্রশিক্ষণের কোনও ইন্সটিটিউট বা কেন্দ্র নেই। শিক্ষকদের জন্য অপরিহার্য Continuing Professional Development বা CPD এর কোনও ব্যবস্থা নেই। ক্লাসে শিক্ষাদান পদ্ধতি, মূল্যায়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে তা বেশিরভাগ শিক্ষকই জানেন না। বেশিরভাগ শিক্ষকরা এখনও ক্লাসে লেকচার দিয়ে যান, শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বা মেধাবিকাশের দিকে এখন কম দৃষ্টি দেন।

সনাতন শিক্ষা পদ্ধতিতে অভ্যস্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যেও নিজে কাজ করে দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যাপারে ব্যাপক অনীহা দেখা যায়।

শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন যে সবাই পাস করেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু ভালো ছাত্র হলেই যে ভালোভাবে বোঝানোর সক্ষমতা থাকবে তা নাও হতে পারে। শিক্ষক হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়েই সবাই ক্লাসে যাবেন এটা তারা চান। এ কারণেই ইনস্টিটিউট হচ্ছে। 

তবে এখানে উল্লেখ্য যে আমাদের দেশে বিশ্বব্যাংকের উদ্যোগে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ইন্সটিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স সেল বা IQAC গড়ে উঠেছে তা কিন্তু ভিন্ন উদ্দেশ্যে গড়ে উঠেছে। শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য নয়।

IQAC মূলত বিভিন্ন বিভাগের মান, ইন্টার্নাল এবং এক্সটার্নাল কোয়ালিটি, অ্যাক্রিডিটেশন এসব ব্যাপারগুলো নিয়ে মূল্যায়ন করে। শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যাপারটি যে ভিন্ন এবং গুরুত্বপূর্ণ তা সরকার যে দেরিতে হলেও বুঝতে পেরেছে সেজন্য তারা অবশ্যই ধন্যবাদ পেতে পারেন। 

আমাদের সমস্যা হচ্ছে যে আমরা শিক্ষার ভিত্তি বা মূল বিষয়গুলোর দিকে নজর না দিয়ে গবেষণা কেন্দ্র বা বিভিন্ন বিশাল অবকাঠামো গড়ে তোলার মাধ্যমে বিশ্ব র‍্যাংকিংয়ে জায়গা করে নিতে চাইছি। উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য টিচিং ও লার্নিং সেন্টারের ব্যবস্থা রয়েছে। যেখানে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার উপযোগী করে তোলা হয়। ভালো বিশ্ববিদ্যালয় মানে ভালো গ্রাজুয়েট তৈরি। আর দক্ষ গ্রাজুয়েট তৈরি করতে পারেন প্রশিক্ষিত শিক্ষকরাই। 

আমি বিশ্বখ্যাত হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচিং ও লার্নিং সেন্টারগুলোর ব্যাপারে তথ্য জানতে গুগলে সার্চ দিয়ে একটা পেজেই পেলাম নয়টা প্রতিষ্ঠিত ও বিশ্বখ্যাত সেন্টারের ঠিকানা। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট কয়টা এধরনের সেন্টার আছে তা আমি বের করতে পারিনি। শিক্ষক প্রশিক্ষণের বিভিন্ন তত্ত্ব, কৌশল থেকে শুরু করে বিষয় ভিত্তিক শিক্ষক প্রশিক্ষণের সেন্টার রয়েছে সেখানে।

আমাদের পাবলিক, প্রাইভেট কয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে এরকম সেন্টার রয়েছে? শুধু বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান দিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষিত করা যায় না, যদি না শিক্ষাদানের কৌশলগুলো জানা থাকে। এখন আমাদের দেশে আউট কাম বেসড এডুকেশনের বা ওবিইর কথা জোরেশোরে বলা হচ্ছে।  কিন্তু এর জন্য দরকার প্রশিক্ষিত শিক্ষক। 

টিচিং ও লার্নিং সেন্টারগুলোতে শুধু যে শিক্ষাদানের আধুনিক কৌশল বা ক্লাসরুম ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি শেখানো হয় তা নয়। কীভাবে কোর্স ডিজাইন করতে হবে, অ্যাসাইমেন্ট বা পরীক্ষার মূল্যায়ন করতে হবে সে বিষয়গুলো সম্বন্ধে এখানে শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করে তোলা হয়। আমরা শিক্ষার্থীদের কাটপেস্টের সমালোচনা করি, কিন্তু কয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাসাইনমেন্ট বা প্রবন্ধ জমাদানের জন্য লিখিত গাইডলাইন দেওয়া হয়? নির্দিষ্ট স্টাইলে রেফারেন্স চাওয়া হয়? মূল্যায়নের ক্ষেত্রে rubric এর মাধ্যমে কি শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইমেন্টগুলোর মূল্যায়ন করা হয়? না, এসব কিছুই হয় না। যেহেতু শিক্ষার্থীদের মনোযোগ শুধু নম্বরের দিকেই, তাই শিক্ষকরাও নম্বর বা গ্রেড দিয়েই দিয়েই খুশি। কিন্তু এতে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান পূর্ণাঙ্গ হয় না। 

টিচিং এবং লার্নিং সেন্টারগুলোতে মাইক্রো টিচিং ওয়ার্কশপ, ইনস্ট্রাকশনাল কোচিং, ব্রাউন ব্যাগ মিটিং ইত্যাদির মাধ্যমে শিক্ষকদের আধুনিক শিক্ষাদান পদ্ধতির বিভিন্ন কৌশল যেমন অ্যাকটিভ লার্নিং, প্রজেক্ট বেসড বা প্রবলেম বেসড লার্নিং, অ্যাকশন রিসার্চ, অ্যাকাডেমিক রাইটিং, পোর্টফলিও ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি বিষয়ে ধারণা দেওয়া হয়। এছাড়া শিক্ষকরা বিষয়ভিত্তিক শিক্ষাদানের বিভিন্ন কৌশল সম্পর্কেও জ্ঞান লাভ করেন। শিক্ষা বিষয়ক প্রশিক্ষণ তো চলমান একটি প্রক্রিয়া। একজন শিক্ষককে তো জীবনের শুরুতে একবার প্রশিক্ষণ নিলে হবে না, টিচিং এবং লার্নিং সেন্টারগুলোতে বারংবার প্রশিক্ষণের জন্য আসতে হবে।

দেশ উচ্চশিক্ষায় কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে না যাওয়ার ক্ষেত্রে আমরা প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষাদানের ব্যাপারটিকে কিছুটা দায়ী করতে পারি।

ইংরেজি বা বাংলায় লেখালেখিতে আমাদের শিক্ষার্থীদের দুর্বলতা, 21st Century Skills অর্জনে তাদের ব্যর্থতা, চাকরিক্ষেত্রে তাদের অনুপযুক্ততা ইত্যাদির জন্য আমরা শিক্ষা পদ্ধতিকেও দায়ী করবো। চারিদিকে সামাজিক অবক্ষয় দেখে আমরা বুঝতে পারি যে এমনকি আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের ঠিকমত নৈতিকতা শিক্ষাও দিতে পারছি না। কারণ নৈতিকতা শিক্ষাদানের যে পদ্ধতি আমাদের দেশে অনুসরণ করা হয় তা সেকেলে। আমি জানি না মরাল ডেভেলপমেন্টের তত্ত্বও প্রায়োগিক দিকগুলো নিয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিজেরাই কতটুকু অবগত! 

বিদেশে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের পূর্বে সব শিক্ষককে একটি টিচিং ফিলোসফি স্টেটমেন্ট জমা দিতে হয়। সেখানে টিচিং এবং লার্নিংয়ের ক্ষেত্রে শিক্ষকের ধারণা, নিজের শিক্ষা পদ্ধতির বর্ণনা এবং যৌক্তিকতা, শিক্ষকতার ব্যাপারে নিজের বিশ্বাস, মূল্যবোধ  ইত্যাদির বিস্তৃত বর্ণনা থাকতে হবে। শিক্ষা এবং শিক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা না থাকলে এ ধরনের স্টেটমেন্ট লেখা বেশ কঠিন। যারা শিক্ষক হন তারা টিচিং এবং লার্নিং সেন্টারগুলোতে আগে থেকেই প্রশিক্ষিত হন সেজন্য এধরনের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া তাদের জন্য অপেক্ষাকৃত সহজ। 

উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে তাই শিক্ষক প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে আমরা নিঃসন্দেহে অনেক পিছিয়ে আছি। বিদেশি ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম দেখলে আমরা এটা সহজে বুঝতে পারি। সরকারের শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইন্সটিটউটের উদ্যোগ তাই প্রশংসার দাবিদার, যদিও এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার ছিল অনেক আগেই। 

তবে আমি মনে করি কেন্দ্রীয় শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউটের পাশাপাশি প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত একটি মানসম্মত টিচিং বা লার্নিং সেন্টারের উপস্থিতি থাকা বাঞ্ছনীয়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ইউজিসির উচিত এই ব্যাপারে প্রাইভেট, পাবলিক সব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে উৎসাহিত করা। আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত নন এমন শিক্ষক দিয়ে দেশে উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়ন আসলেই অসম্ভব।

লেখক: কলামিস্ট; বিভাগীয় প্রধান, জার্নালিজম, কমিউনিকেশন ও মিডিয়া স্টাডিজ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ। 

ইমেইল: [email protected]   



/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ