X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসঙ্গ পরীমণি: আইন, আদালত এবং মানবাধিকার

ফারজানা হুসাইন
২৪ আগস্ট ২০২১, ১৮:২৫আপডেট : ২৪ আগস্ট ২০২১, ১৮:২৯

ফারজানা হুসাইন প্রায় পুরো আগস্ট মাস ধরেই সংবাদপত্র এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনায় আছেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের আলোচিত চিত্রনায়িকা শামসুন্নাহার স্মৃতি ওরফে পরীমণি। গত ৪ আগস্ট রাতে প্রায় ৪ ঘণ্টার অভিযান চালিয়ে বনানীর বাসা থেকে পরীমণিকে আটক করে র‍্যাব। এ সময় তার বাসা থেকে বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য জব্দ করা হয় বলে র‍্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়। আটকের পর পরীমণিকে নেওয়া হয় র‍্যাব সদর দফতরে। পরে র‍্যাব-১ বাদী হয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে পরীমণির বিরুদ্ধে মামলা করে।

আটকের দিন থেকে এখন পর্যন্ত শেষ খবর হলো, পরীমণির বিরুদ্ধে বনানী থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় তৃতীয় দফায় রিমান্ড শেষে আদালতে হাজির করা হয় গত শনিবার ২১ আগস্ট। ওইদিন আদালত পরীমণিকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

নায়িকা হিসেবে পরীমণির ক্যারিয়ারের বয়স খুব বেশি দিন না হলেও, তিনি আলোচনা আর সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন প্রায় সব সময়ই। কখনও ঘটা করে পুরো সিনেমার নায়িকাসুলভ কায়দায় নিজের জন্মদিন পালন করেছেন, তো কখনও আবার এতিম ও গরিব শিশুদের সঙ্গে কেক কেটে ও খেয়ে নিজের জন্মদিন পালন করেছেন। বিভিন্ন সময়ে বিদেশ ভ্রমণ আর কোটি টাকার গাড়ির সঙ্গে তার ছবি দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তার সরব উপস্থিতি ছিল বরাবরই।

এই ‘larger than life’ উপস্থিতির কারণেই হয়তো ২০২০ সালে স্বনামধন্য আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিন ফোর্বসের এশিয়া প্যাসিফিকের ১০০ জন ডিজিটাল তারকার তালিকায় অমিতাভ বচ্চন আর শাহরুখ খানদের মতো সুপারস্টারদের সঙ্গে ভাগ বসিয়েছেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নায়িকা পরীমণি।

আজকের এই লেখা সেলিব্রেটি পরীমণি-কথন হতে পারতো, তার রূপের প্রশংসামুখর রচনা হতে পারতো, নতুন কোনও সিনেমায় তার অভিনয়ের আলোচনা হতে পারতো! এ আলোচনা তেমনটা হলেই বরং আমি খুশি হতাম, আমরা খুশি হতাম। কিন্তু পরীমণিকে নিয়ে আজকের আলোচনা উদ্বেগের, সংশয়ের আর হতাশার।

পরীমণি আটক হওয়ার পর শুরুর দিকে কোনও এক অজ্ঞাত কারণে প্রায় সবারই মুখে কুলুপ আটা থাকলেও, স্বস্তির সঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে, ধীরে ধীরে সরব হতে শুরু করেছেন সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ। যারা শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত বা পরিচিত মুখ  আর আমাদের ভীষণ শ্রদ্ধার পাত্র তারা হয়তো পরীমণির জন্য কথা বলছেন তাকে নিজেদের পরিবারের একজন ভেবে। কিন্তু সব ছাপিয়ে পরীমণি আজ বাংলাদেশের আইন, অধিকার আর সংবিধানের পরাজয়ের গল্পই যেন হয়ে উঠেছে সর্বসাধারণের জন্য।

আজকের লেখার  প্রসঙ্গ পরীমণি, কিন্তু প্রধান বিষয় বাংলাদেশ নামক এই প্রজাতন্ত্রের একজন নাগরিকের সাংবিধানিক ও মানবাধিকার অধিকার প্রসঙ্গ। পরীমণি আটকের পর থেকে যে তিনটি আইনি বিষয় নিয়ে প্রশ্ন উঠছে তা হলো, একজন অভিযুক্তের রিমান্ড, জামিন ও আইনি পরামর্শ গ্রহণের অধিকার।

১. বারবার কেন পরীমণিকে রিমান্ডে নেওয়া হচ্ছে? আইন এ বিষয়ে কী বলে?

২. আদালতে আবেদন করেও কেন বারবার পরীমণির জামিন নামঞ্জুর করা হচ্ছে? পরীমণির জামিন পেতে বাধা কোথায়?

৩. পরীমণিকে কেন আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না? এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা কতটা আইনানুগ ও সাংবিধানিক?

১. রিমান্ড:

এ পর্যন্ত পরীমণিকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে তিনবার এবং জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে ন্যূনতম চারবার। পরীমণি আটক হওয়ার পর প্রথম তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আটকের পরদিন তাকে আদালতে উপস্থিত করা হয়।

পুলিশ কর্তৃক আসামিকে রিমান্ডে নেওয়া আমাদের খুব পরিচিত এবং ভয়াবহ আতঙ্ক সৃষ্টিকারী একটা শব্দ, যদিও আশ্চর্যের বিষয়, এ শব্দটির ব্যাখ্যা আমাদের ফৌজদারি কার্যবিধিতে কোথাও নেই, কেবল উল্লেখ আছে মাত্র।

ধারা নং ১৬৭-তে রিমান্ড বিষয়ে বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তি পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্তকার্য সমাপ্ত না হলে এবং ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ বস্তুনিষ্ঠ বিবেচিত হলে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিকটবর্তী আদালতের ক্ষমতাসম্পন্ন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে রিমান্ড প্রার্থনা করতে পারেন, যা একসঙ্গে ১৫ দিনের অধিক হবে না।

ধারা নং ৩৪৪-এ রিমান্ড বিষয়ে বলা হয়েছে, আসামির অপরাধ সংশ্লিষ্টতা বিষয়ে পর্যাপ্ত সাক্ষ্য পাওয়ার পর যদি প্রতীয়মান হয় রিমান্ডের মাধ্যমে অধিকতর সাক্ষ্যপ্রাপ্তি সম্ভব, সেক্ষেত্রে একটি মামলার তদন্ত বা বিচার চলাকালীন আদালত একসঙ্গে সর্বোচ্চ ১৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করতে পারেন।

এটি একটি সর্বজনজ্ঞাত বিষয় যে আদালতে ম্যাজিস্ট্রেটরা নিয়মিত রিমান্ডের জন্য পুলিশের এই অনুরোধ অনুমোদন করেন। যদিও অধিকতর তদন্তের জন্য ম্যাজিস্ট্রেটকে রিমান্ডের জন্য  পুলিশকে প্রদত্ত ক্ষমতা একটি ‘ব্যতিক্রমী ক্ষমতা’, যা শুধু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যেতে পারে।

গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে রিমান্ডে নিয়ে থানায় ফিরিয়ে আনার পর পুলিশ গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির কাছ থেকে তথ্য বা স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করে। এই প্রক্রিয়ায় তথ্য বা স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য পুলিশ কর্তৃক আটককৃত ব্যক্তিকে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করার সংবাদ প্রায়ই শোনা যায়, যা কখনও কখনও পুলিশ কাস্টডিতে থাকাকালীন আসামির মৃত্যুর কারণও হয়- এমন নজিরও রয়েছে।

গ্রেফতার ও রিমান্ডে নেওয়া সম্পর্কিত একটি বহুল আলোচিত কেস আছে বাংলাদেশে। যেটা BLAST কেস নামে পরিচিত। প্রচলিত রিমান্ডে নেওয়াকে অনুৎসাহিত করে ২০০৩ সালে এই মামলার রায়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিগণ তদন্তের স্বার্থে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির সঙ্গে রিমান্ডে কী ধরনের আচরণ করতে হবে সে সম্পর্কিত একটি নির্দেশাবলি দিয়েছেন।

সাধারণ ক্ষেত্রে, পুলিশের অবশ্যই যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য এবং যুক্তিসঙ্গত তথ্য থাকতে হবে, যা গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে অপরাধের ক্ষেত্রে জড়িত করে। পুলিশ অফিসারকে অবশ্যই প্রথম ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত কেন শেষ করা যায়নি এবং কেন এই অভিযোগের ভিত্তি বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর নির্ভর করতে হবে তার কারণগুলো জানাতে হবে।

যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হেফাজতে থাকা ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায়, তাদের অবশ্যই একজন ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিতে হবে এবং জিজ্ঞাসাবাদ অবশ্যই কারাগারের অভ্যন্তরে একটি কাচের তৈরি ঘরে হতে হবে। আটক ব্যক্তির আত্মীয় এবং আইনজীবীরা কক্ষের বাইরে উপস্থিত থাকতে পারেন। আটক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের আগে এবং পরে একজন ডাক্তার দ্বারা পরীক্ষা করতে হবে।

রিমান্ডের মেয়াদ সম্পর্কে এই ডাইরেকটিভস-এ আটককৃতদের মেডিক্যাল টেস্ট  রিপোর্ট পাওয়ার পর কেবল ব্যতিক্রমী মামলায় আটককৃতদের সর্বোচ্চ তিন দিনের রিমান্ডে নিতে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের নির্দেশ দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত।
এ তো গেলো  রিমান্ডে থাকাবস্থায় আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশি আচরণ সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের দিকনির্দেশনা। এবার দেখি সংবিধান কী বলছে।

বলা বাহুল্য, একটি দেশের সংবিধান সে দেশের নাগরিকের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করে এবং নাগরিককে যে কোনও ধরনের নির্যাতন থেকে মুক্তির নিশ্চয়তা দেয়। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদের অধীনে, কাউকে নির্যাতন করা যাবে না বা নিষ্ঠুর বা অমানবিক বা অবমাননাকর শাস্তি বা এমনকি চিকিৎসা করা যাবে না এবং কাউকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষী হতে বাধ্য করা যাবে না। যদি কেউ স্বেচ্ছায় অপরাধ স্বীকার করে, সেটা ভিন্ন বিষয়।

সংবিধানের অধীনে আইনের ভূমিকা ও শাসনের ( Rule of law and Governance) অন্যতম মৌলিক বিষয় হলো Right to Liberty বা নাগরিক স্বাধীনতার অধিকার, যা নাগরিকের সবচেয়ে প্রিয় ও প্রয়োজনীয় অধিকার এবং এটিকে কেবল তখনই সীমাবদ্ধ করা যেতে পারে যখন একজন ব্যক্তিকে অন্য কোনও অপরাধ করতে বাধা দিতে গিয়ে তাকে আটকে রাখা একান্ত প্রয়োজন।
কিন্তু ‘কাজীর গরু কিতাবে আছে,  গোয়ালে নেই!’ দুঃখের বিষয় যে পরীমণির ক্ষেত্রে হাইকোর্টের দেওয়া নির্দেশনা আর সংবিধানের নিশ্চিত করা অধিকার অবহেলিত রয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত পরীমণির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ, মোট দুই লাখ সাত হাজার টাকা মূল্যমানের মাদকদ্রব্য পাওয়া গেছে তার বাড়িতে। পরীমণিকে আটক করার পর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, সেই জিজ্ঞাসাবাদের সূত্র ধরে প্রথম কয়েকদিনেই কয়েকজনকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ মামলায় আটক করা হয়েছে। কিন্তু তারপর থেকে পরীমণিকে আরও তিনবার বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে, সেই রিমান্ডগুলো থেকে কী ধরনের তথ্য উদ্ধার করা গেছে এবং এই বারবার রিমান্ড পরীমণির বিরুদ্ধে আনা মাদক মামলায় কতটা অগ্রগতি এনেছে তার পুরোটাই ধোঁয়াটে। এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে মামলার তদন্তের স্বার্থে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে আরও জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু পরীমণির ক্ষেত্রে পুলিশের করা দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা  রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করার আগে আদালত কীভাবে সন্তুষ্ট হলেন যে পূর্ববর্তী রিমান্ড ফলপ্রসূ হয়েছে এবং পরবর্তী রিমান্ড মামলার তদন্তকে সাহায্য করবে, সে প্রশ্ন কি যেকোনও সচেতন নাগরিক করতে পারেন না?

২. জামিন:

আটকের পর থেকে পরীমণির পক্ষ থেকে পরীমণির আইনজীবী বারবার আদালতের কাছে  জামিন চেয়ে আবেদন করেছেন বলে সংবাদপত্রগুলো এবং বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের মাধ্যমে আমরা জেনেছি। যদিও বারবারই এই আবেদন মহামান্য আদালত নাকচ করে দিয়েছেন।

প্রথমে বলি জামিন আসলে কী? জামিন অর্থ আইনগত হেফাজত থেকে কোনও ব্যক্তিকে ছেড়ে দেওয়া। আইনের হেফাজত থেকে ছেড়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া আইন দ্বারা নির্ধারিত রয়েছে বাংলাদেশে প্রচলিত ফৌজদারি কার্যবিধিতে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই আইনের প্রায়োগিক চর্চাটা নেই।

A person is innocent until proven guilty- অর্থাৎ কোনও ব্যক্তিকে আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত না করা পর্যন্ত তাকে অপরাধী বলা যাবে না। এটা হচ্ছে আইনের মূলনীতি। বিচার শেষ হওয়ার আগে যেহেতু কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না, সেহেতু ওই ব্যক্তি জামিন পাওয়ার কিছু আইনগত অধিকার রাখেন। কিন্তু ইদানীং দেখা যাচ্ছে, কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ার পরপরই তার বিরুদ্ধে নানা কাহিনি গণমাধ্যমে প্রকাশ হচ্ছে।  শুরু হয়ে যাচ্ছে তার মিডিয়া ট্রায়াল। ফলে অনেক ক্ষেত্রে তার জামিনের ক্ষেত্রটাও সংকুচিত হয়ে আসছে।

গ্রেফতারকৃত কোনও ব্যক্তিকে জামিন দেওয়া যাবে না এমন বিধান ফৌজদারি কার্যবিধিতে নেই। তবে অপরাধ বিবেচনায় জামিনযোগ্য ও জামিন অযোগ্য অপরাধ ভাগ করা হয়েছে। জামিন অযোগ্য ধারার মামলায় গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তির জামিনের বিধান ফৌজদারি কার্যবিধিতে বলে দেওয়া হয়েছে।

ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৭ ধারায় জামিন অযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে যখন জামিন মঞ্জুর করা যাবে সে সম্পর্কে বলা হয়েছে।

এই ধারার (১) উপ-ধারায় বলা হয়েছে, মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় কোনও অপরাধে অপরাধী বলে বিশ্বাস করার মতো যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকলে তাকে মুক্তি দেওয়া যাবে না। এই উপ-ধারার প্রথম অংশে বলা হয়েছে, অন্যান্য ক্ষেত্রে জামিন দেওয়া যেতে পারে।

তবে এই ধারায় আরও বলা হয়েছে, মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় অপরাধ কোনও অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি ১৬ বছরের নিম্ন বয়স্ক, বা নারী বা অসুস্থ বা অক্ষম হয় তাহলে আদালত তাকে জামিনে মুক্তি দিতে পারবেন। ৪৯৭-এর (২) ধারায় বলা হয়েছে, তদন্ত অনুসন্ধান বা বিচারের কোনও পর্যায় আদালতের নিকট বা পুলিশ কর্মকর্তার নিকট যদি প্রতীয়মান হয় যে, জামিন অযোগ্য ধারায় অপরাধ করেছে বলে বিশ্বাস করার মতো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই, তাহলে তাকে জামিন দেওয়া যাবে। এ ক্ষেত্রে আদালতের বিবেচনামূলক ক্ষমতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

জামিনের বিষয়ে আদালতের বিবেচনামূলক ক্ষমতা সম্পর্কে ৪৯৭ ধারার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, অভিযুক্ত ব্যক্তির পালানোর সম্ভাবনা আছে কিনা, সাক্ষীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে অভিযুক্তের পক্ষে সাক্ষ্য জালিয়াতি করার কোনও সম্ভাবনা আছে কিনা, উভয় পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিনা তা আদালতকে বিবেচনা করতে হবে। এমনকি মৃত্যুদণ্ডযোগ্য বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড যোগ্য অপরাধ সংঘটিত করেছে, কেবল এই কারণে তাদের কারাগারে রাখার কোনও আইনগত বা নীতিগত বাধ্যবাধকতা নেই।
এই ধারায় আরও বলা হয়েছে, জামিন অযোগ্য ক্ষেত্রে জামিন দেওয়ার বিষয়টি আদালতের ইচ্ছাধীন ক্ষমতা, যা প্রতিটি মামলার ঘটনা ও অবস্থার ভিত্তিতে সতর্কতার সঙ্গে প্রয়োগ করতে হবে। এ বিষয়টি আদালতকে অনেকটা স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে।

পরীমণি একজন নারী, তার বিরুদ্ধে আনীত মাদকের অভিযোগ যদি প্রমাণও হয় তবে প্রচলিত আইনে তার সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের জেল হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন পরীমণির আইনজীবীরা। যদিও প্রথম থেকেই পরীমণির আইনজীবীরা বলেছেন, তার বিরুদ্ধে আনা মাদকের মামলা অসত্য।

পরীমণির আইনজীবীরা জানিয়েছেন তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ। সংবাদমাধ্যমে এসেছে, পরীমণি বলেছেন তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন, পাগল হয়ে যাচ্ছেন জেলখানায় থাকতে থাকতে। উপরন্তু পরীমণি সমাজের একজন পরিচিত মুখ, চলচ্চিত্রের নায়িকা, বেশ নামকরা সেলিব্রেটি। তার পক্ষে জামিন পেয়ে আত্মগোপন করা কিংবা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব বলা যায়। তারপরও আদালত প্রয়োজন মনে করলে পরীমণির পাসপোর্ট জব্দ করতে পারেন, তার দেশ ত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারেন, নির্ধারিত দিনে প্রতি সপ্তাহে নিকটস্থ পুলিশ স্টেশনে তাকে হাজিরা দেওয়ার শর্তে জামিন মঞ্জুর করতে পারেন- সে এখতিয়ার আদালতের রয়েছে। আবার, মাদকের মামলায় বাদী তো রাষ্ট্র, এখানে সাক্ষ্যও মোটামুটি সংগৃহীত হয়ে গেছে প্রথম পর্যায়েই, সাক্ষী  তেমন কেউ আছে বলেও শোনা যায়নি, সুতরাং পরীমণির পক্ষে জেল থেকে জামিনে ছাড়া পেয়ে কোনও সাক্ষীকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করার কোনও সুযোগ নেই। সুতরাং সংবাদমাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করলে, আইনগত দিক থেকে পরীমণির জামিন পেতে তেমন বাধা নেই,  যদি এবং কেবল যদি আদালত তার ইচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগ করতে চায় তবেই তা সম্ভব।

কিন্তু আমরা সবাই হতাশ হয়ে লক্ষ করছি মহামান্য আদালত তার সেই Discretionary power বা ইচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগ করেননি। পরীমণির বিষয়ে আদালত তার স্বাধীনতার বা ক্ষমতার প্রয়োগে বড় বেশি অনমনীয় আচরণ করছেন বলেই যেন প্রতীয়মান হচ্ছে। সর্বশেষ আপডেট অনুযায়ী জামিন শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে প্রায় এক মাস পর সেপ্টেম্বর-এর ১৩ তারিখে। পরীমণির এই দীর্ঘদিন জেলে থাকার শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষতি তো অপূরণীয়।

জামিন অযোগ্য মামলায় আদালতের হাতেই ক্ষমতা থাকে জামিন মঞ্জুর করা বা না করার। যথেষ্ট সুযোগ থাকা সত্ত্বেও একজন সুপ্রতিষ্ঠিত নারীকে এভাবে বারবার রিমান্ডে পাঠিয়ে এবং তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে আদালত কি ক্ষমতার অপব্যবহার করছে না?– এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন অনেকেই।

৩. আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শের অধিকার:

রিমান্ড কিংবা জামিন প্রসঙ্গে তবু আইনের ফাঁকফোকর আর অপব্যবহার নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে প্রশ্ন তোলা যায়, আলোচনা আর সমালোচনার ঝড় তোলা যায় চায়ের কাপে আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। কিন্তু যে বিষয়টি নিয়ে কেবল আইনজীবী আর মানবাধিকারকর্মী নয়, বরং যেকোনও সচেতন নাগরিকসহ সবাই উদ্বিগ্ন আর শঙ্কিত, তা হলো গত প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে পরীমণিকে আটক করে রাখা হয়েছে এবং এই পর্যন্ত তাকে তার আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শের সুযোগ আদালত দেয়নি। এ প্রসঙ্গে বলি, গত দুদিন ধরে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে ইন্টারনেটে খুঁজে চলেছি সমসাময়িককালে এ ধরনের কোনও মামলা কখনও বাংলাদেশে কিংবা পৃথিবীর অন্য কোথাও হয়েছে কিনা, যেখানে একজন আটককৃত ব্যক্তিকে তার আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। আমি তা খুঁজে পাইনি।

১৯৬৩ সালের একটি বিখ্যাত আমেরিকান মামলার কথা বলি। গিডিয়ন বনাম ওয়েনরাইট নামে পরিচিত এই মামলার বাদী ক্লারেন্স গিডিয়ন। ভেন্ডিং মেশিন থেকে টাকা চুরি করার জন্য পানামা সিটি পুল হল ভেঙে প্রবেশ করলে গিডিয়নকে গ্রেফতার করা হয়। আইনজীবী নিযুক্ত করার আর্থিক সামর্থ্য গিডিয়নের ছিল না। যখন গিডিয়ান আদালতে হাজির হন, তখন আদালত-নিযুক্ত আইনজীবীর জন্য তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা হয়। এই মামলায় গিডিয়নের পাঁচ বছরের সাজা হয়। আদালতের এই রায়ের সাংবিধানিকতাকে চ্যালেঞ্জ করে গিডিয়ন সুপ্রিম কোর্টে একটি হাতে লেখা আবেদন পাঠিয়েছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট গিডিয়নের সঙ্গে একমত হন যে আইনি পরামর্শ পাওয়ার সুযোগ না থাকায় তাকে সুষ্ঠু বিচার দেওয়া হয়নি, এবং তার দণ্ড বাতিল করে দেওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্টের যুক্তি ছিল যে আইনি পরামর্শের অধিকার একটি মৌলিক অধিকার।

আমাদের দেশের সংবিধান আর মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরীমণিকে তার আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করার সুযোগ না দেওয়া অসাংবিধানিক এবং তার মৌলিক মানবাধিকারের লঙ্ঘন।

বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৩নং অনুচ্ছেদে ঘোষিত হয়েছে যে, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে যথাসম্ভব দ্রুত গ্রেফতারের কারণ না জানিয়ে আটক রাখা যাবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তার মনোনীত আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শের ও তার দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হতে বঞ্চিত করা যাবে না।

সংবিধান হলো কোনও রাষ্ট্র পরিচালনার ‘ম্যানুয়াল’, নাগরিকদের জন্য তাদের অধিকারের রক্ষাকবচ। আদালত যখন সংবিধানের পরিষ্কার বলে দেওয়া ঘোষণাকে উপেক্ষা করে কোনও নাগরিককে হেনস্তা করতে চায়, তখন তা কেবল আদালত আর উক্ত নাগরিকের মধ্যকার বিষয় থাকে না। ন্যায়বিচার আর আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য তখন প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব হয়ে ওঠে এই অসাংবিধানিক পদক্ষেপের প্রতিবাদ করা।

আইনি সহায়তা আটককৃত ব্যক্তির জন্য আইনি সহায়তা নিশ্চিত করা একটি সুষ্ঠু, মানবিক এবং দক্ষ ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার অপরিহার্য উপাদান, যা রাষ্ট্রের আইনের শাসনকে নিশ্চিত করে। এটি ন্যায্য বিচারের অধিকারসহ (Right to fair trial) অন্যান্য মৌলিক অধিকারের ভিত্তি এবং যে কোনও নাগরিকের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সুরক্ষাকবচ যা মৌলিক ন্যায্যতা (Fundamental fairness)  এবং ফৌজদারি বিচার প্রক্রিয়ায় জনগণের আস্থা নিশ্চিত করে।

কেবল সংবিধান নয়, কাউকে আটক করার পর সময়ক্ষেপণ না করে যত দ্রুত সম্ভব আইনি পরামর্শের সুযোগ করে দেওয়া নিশ্চিত করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনও। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, ফৌজদারি বিচার প্রক্রিয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে আইনি সহায়তা পাওয়ার সুযোগ মানুষকে এমন সময়ে রক্ষা করে, যখন তারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ; এই সুযোগ পুলিশ কাস্টডিতে নির্যাতন ও অসদাচরণের হাত থেকে তাকে রক্ষা করে। এটি এটাও নিশ্চিত করে যে দরিদ্র ও দুর্বল মানুষদের প্রতি সম্মানজনক আচরণ এবং সুষ্ঠু আচরণ যেন করা হয়।

ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় আইনগত সহায়তা পাওয়ার অধিকার Right to fair trial-এর অংশ এবং  Right to fair trail - একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবাধিকার। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আইন, নিয়মাবলি ও গাইডলাইন, যেমন, The United Nations Principles and Guidelines on Access to Legal Aid in Criminal Justice Systems ,  the Universal Declaration of Human Rights and the International Covenant on Civil and Political Rights বারবার করে এই অধিকার রক্ষার জন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে তাগাদা দিয়ে চলেছে।

আমাদের সামাজিক কাঠামো নারীবান্ধব নয়, তাই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আইন করে নারীর ক্ষমতায়ন আর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হয়। কিন্তু আদালত যদি পরীমণির মতো নিজ যোগ্যতায় প্রতিষ্ঠিত হতে চাওয়া নারীর সাংবিধানিক অধিকার এবং মানবাধিকারে হস্তক্ষেপ করে তাহলে তা হয়ে যায় রাষ্ট্র-কর্তৃক নিপীড়ন। আদালতের এই অনমনীয় আচরণ কেবল নারীর ক্ষমতায়নের চেষ্টাকেই ব্যাহত করে না, নারী-পুরুষ সবার জন্য ন্যায়বিচার পাওয়ার নিশ্চয়তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। পরিবার, সমাজ আর ধর্মীয় অনুশাসনের সঙ্গে যদি রাষ্ট্রযন্ত্র ও নারীর বিরুদ্ধাচরণ করে তখন তা কেবল একটি বেআইনি বা রূঢ় আচরণ থাকে না; বরং রাষ্ট্রের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ রূদ্ধ করে।

আজকের লেখা শেষ করবো আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনার সেই চমৎকার শপথবাক্য আবারও পাঠ করে, ‘আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে’।

লেখক: আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চট্টগ্রামে ক্রিকেটারদের ‘ক্লোজড ডোর’ অনুশীলন
চট্টগ্রামে ক্রিকেটারদের ‘ক্লোজড ডোর’ অনুশীলন
হাসপাতালের ৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ১০ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
হাসপাতালের ৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ১০ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
রাঙামাটিতে ডাম্প ট্রাক খাদে পড়ে ৬ শ্রমিক নিহত
রাঙামাটিতে ডাম্প ট্রাক খাদে পড়ে ৬ শ্রমিক নিহত
আরও বিস্তৃত হবে তাপপ্রবাহ, তবে সিলেটে হতে পারে বৃষ্টি
আরও বিস্তৃত হবে তাপপ্রবাহ, তবে সিলেটে হতে পারে বৃষ্টি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ