X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘বিপদে আমি না যেন করি ভয়’

ড. প্রণব কুমার পান্ডে
২৬ আগস্ট ২০২১, ১৭:৪১আপডেট : ২৬ আগস্ট ২০২১, ১৭:৪৪

ড. প্রণব কুমার পান্ডে কোভিড-১৯ মহামারি বিশ্বব্যাপী শুধু অর্থনীতি এবং স্বাস্থ্য খাতের ওপরই বিরূপ প্রভাব ফেলেনি; বিশ্ববাসীকে তাদের জীবন ধারা পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছে। আমরা এখন নিউ নর্মাল (নতুন স্বাভাবিক) জীবনযাপন করছি। কারণ, করোনা সুরক্ষাবিধি মেনে চলার কারণে আমাদের মাস্ক পরতে হচ্ছে, ঘন ঘন হাত ধুতে হচ্ছে এবং জনাকীর্ণ স্থান এড়িয়ে চলতে হচ্ছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো বিশ্বব্যাপী নাগরিকরা গত দেড় বছর ধরে বাড়িতে থাকতে বাধ্য হয়েছে। দীর্ঘদিন বাড়িতে অবস্থান সব বয়সের মানুষের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি তৈরি করেছে। নতুন স্বাভাবিক জীবন পদ্ধতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। কারণ, তারা তাদের বাড়ি থেকে বের হতে পারে না, স্কুলে যেতে পারে না এবং তাদের বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে পারে না। এমনকি শিশুদের একটি বড় অংশ মানসিক অবসাদে ভুগতে শুরু করেছে।

নতুন স্বাভাবিক জীবন মানুষকে ভার্চুয়াল জগতের ওপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য করছে। ইন্টারনেট এবং ভার্চুয়াল জগতের ওপর এ ধরনের নির্ভরতা পারিবারিক এবং সামাজিক বন্ধনকে নড়বড়ে করে ফেলছে, যা পরিবারের মধ্যে একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন করে তুলেছে। এ ধরনের বিচ্ছিন্নতা কেবল শিশুদের মানসিক অবস্থায় নষ্ট করবে না; বরং তাদের মানসিকভাবে অসুস্থ করে তুলবে। বাড়িতে থাকার বাধ্যবাধকতা ছাড়াও, আমাদের তরুণ প্রজন্ম দীর্ঘদিন অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমের সঙ্গে যোগাযোগের বাইরে রয়েছে। একটি প্রবাদ আছে, "অলস মস্তিষ্ক শয়তানের আড্ডা"। অ্যাকাডেমিক কাজে জড়িত না হয়ে বাড়িতে দীর্ঘদিন থাকার কারণে একটি প্রজন্ম প্রতিবন্ধী হওয়ার পথে। যদিও অর্থনীতি এবং জনস্বাস্থ্যের ওপর মহামারির বিপর্যয়কর প্রভাব নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে, শিক্ষা খাত সংশ্লিষ্ট সবার কাছ থেকে পর্যাপ্ত মনোযোগ পায়নি।

আমাদের জনগণের বেশিরভাগের মধ্যে সবকিছুর জন্য সরকারকে দোষারোপ করার একটি প্রবণতা রয়েছে, যেখান থেকে আমাদের বের হয়ে আসা উচিত। অনেকেই বিশ্বাস করেন যে সরকারের সাহায্য ছাড়া কিছুই করা যায় না। মহামারি চলাকালীন শ্রেণি বা ধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিকের উচিত এই বিপদ কাটিয়ে উঠতে সরকারকে সহায়তা করা। শিশুরা বাড়িতে থাকার কারণে ইন্টারনেটের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে উঠছে বিধায়  অভিভাবকদের উচিত তাদের ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর নজর রাখা এবং ব্যবহারের সীমানা চিহ্নিত করে দেওয়া। 

ইন্টারনেটের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়লে তাদের ভবিষ্যৎ জীবন নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আমাদের সবার উচিত এই সময়ে সন্তান এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সময় কাটানো। মহামারির ফলে অনেক মানুষ পরিবারের সঙ্গে বেশি সময় কাটানোর সুযোগ পেয়েছেন। মহামারি না থাকলে তারা হয়তো অন্য কাজে ব্যস্ত থাকতেন। অতএব, আমাদের উচিত মহামারি সৃষ্ট  ইতিবাচক সুযোগগুলো কাজে লাগানো।

অভিভাবকদের পাশাপাশি সব স্তরের শিক্ষার্থীদের সাহায্য করার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশের সম্প্রসারণের কারণে আমাদের জীবন অনেক সহজ হয়ে গেছে। যদিও বিশ্বব্যাপী বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শ্রেণিকক্ষভিত্তিক শিক্ষাকে অনলাইন পদ্ধতিতে রূপান্তর করেছে, আমরা এখনও পিছিয়ে আছি। তাই শিক্ষকদের উচিত ছাত্রদের সঙ্গে সংযুক্ত থাকার জন্য এগিয়ে আসা। শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে এ কথা সত্য যে অনেকের ডিভাইস, ইন্টারনেট সংযোগ এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কিন্তু, এটাও সত্য যে সরকার শিক্ষার্থীদের ডিভাইস কেনার জন্য ঋণ প্রদান করেছে এবং ইন্টারনেটের  মূল্য কমানো হয়েছে। এখন যেটা প্রয়োজন সেটা হলো শিক্ষাদানকারী সম্প্রদায়ের ইতিবাচক অভিপ্রায়। আমরা ইতোমধ্যে প্রত্যক্ষ করেছি, ইংরেজি মাধ্যম স্কুল এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম অনলাইনে চলছে পুরোদমে। এই শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন করোনা মহামারির কারণে খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। যদি তারা অনলাইনে শিক্ষা চালিয়ে যেতে পারে, তাহলে পাবলিক স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয় কেন পারবে না? এটি একটি মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন, যা স্টেকহোল্ডারদের বোঝা প্রয়োজন।

কেউ যুক্তি দিতে পারে যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আর্থিক সক্ষমতা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের তুলনায় অনেক ভালো। এটি সত্য হতে পারে। কিন্তু, আমরা যদি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের সামগ্রিক পটভূমি মূল্যায়ন করি, তাহলে এটি স্পষ্ট হবে যে শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশের কাছে ডিভাইস, ইন্টারনেট এবং বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে। ফলে, যাদের নেই তাদের কথা ভাবা উচিত। যাহোক, একই সময়ে অনলাইন প্রক্রিয়াটি চালিয়ে যাওয়া উচিত। কারণ, আমরা কেউ জানি না কখন আমরা আমাদের স্বাভাবিক অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম পুনরায় শুরু করতে সক্ষম হবো। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আমার নিজের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে এটা বলতে পারি যে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের অভিপ্রায়।

আমি যখন অনলাইন ক্লাস নেওয়া শুরু করি, ক্লাসে ৮৫-৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিতির হার ২০-২৫ শতাংশে নেমে আসে। ক্লাসের উপস্থিতির এই হ্রাসের জন্য ডিভাইসের বা ইন্টারনেটের অভাবকে দায়ী করা যায় না। বরং এর মূল কারণ হচ্ছে শিক্ষার্থীদের অনীহা। কেননা, আমি যখনই আমার শিক্ষার্থীদের মেসেঞ্জার গ্রুপে একটি বার্তা পাঠাই, ৮০-৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়, যার অর্থ হলো তারা সব সময় ফেসবুকে সক্রিয় থাকে। এ জন্য আমি বিশ্বাস করি যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের অভিপ্রায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাধা অনলাইন কার্যক্রমের ক্ষেত্রে ।
এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মধ্যেও অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। স্কুল বা কলেজ পর্যায়ে অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়া কঠিন হতে পারে। কারণ, জুম বা গুগল মিট, বা অন্যান্য অ্যাপস পরিচালনার প্রক্রিয়ার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ পরিচিত নাও থাকতে পারে। কিন্তু, বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী এই পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত। যদি এই পদ্ধতির সঙ্গে অপরিচিত কিছু শিক্ষার্থী থেকেও থাকে তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি বিভাগের মাধ্যমে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে।  আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে আমরা শতাব্দীর সবচেয়ে খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। সুতরাং, শিক্ষার্থীদের অ্যাকাডেমিক জীবন যাতে ব্যাহত না হয় তা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের অবশ্যই অনলাইন পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এমনকি আমরা ওপেন বুক (উন্মুক্ত বই) পরীক্ষা, উপস্থাপনা এবং পরীক্ষার অন্যান্য পদ্ধতির মাধ্যমে অনলাইন পরীক্ষা নিতে পারি। পরীক্ষার বিষয়ে অনিশ্চয়তার কারণেও শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাসে সংযুক্ত থাকার ক্ষেত্রে অনীহা প্রদর্শন করছে।  ফলে, আমরা যদি ইতিবাচকভাবে বিষয়টি না বিবেচনা করি তাহলে মহামারি একটি প্রজন্মের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক এবং সরকার মহামারি চলাকালীন শিক্ষা খাতের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগের সঙ্গে সময় পার করছে। শিক্ষা খাতকে বাঁচাতে সরকার বেশ কিছু সক্রিয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এদের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত, যাতে কর্তৃপক্ষ যত দ্রুততার সঙ্গে সম্ভব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজসমূহের প্রায় ৭৬ হাজার শিক্ষার্থী ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ গ্রহণ করেছে। যেহেতু শিক্ষার্থীরা ইতোমধ্যে দেড় বছর হারিয়ে ফেলেছে, তারা তাদের অ্যাকাডেমিক ভবিষ্যৎ নিয়ে অধৈর্য হয়ে উঠেছে।

তবে আমাদের সবার উচিত এটা অনুধাবন করা যে মহামারির সময় অধৈর্য  হলে চলবে না। ধৈর্য সহকারে আমাদের এই মহামারি মোকাবিলা করতে হবে। আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি যে সংক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকার একমাত্র উপায় হলো টিকা গ্রহণ।  যেহেতু দেশে পুরোদমে চলছে টিকা কার্যক্রম, তাই ভালো দিন খুব বেশি দূরে নয়। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীর জন্য পর্যাপ্ত ভ্যাকসিনের সরবরাহ নিশ্চিত করায় ধন্যবাদ ও প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। আশা করা যায় আমরা খুব শিগগিরই মহামারি দ্বারা সৃষ্ট অচলাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবো। আমরা টানেলের শেষে জ্বলজ্বলে আলো দেখতে শুরু করেছি। সেদিন খুব দূরে নয় যেদিন শিক্ষার্থীরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসবে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাবে এবং বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে গভীর শ্বাস নিতে সক্ষম হবে। যতদিন পর্যন্ত সেটি না হচ্ছে ততদিন আমাদের ধৈর্য ধারণ করতে হবে। পরিশেষে কবিগুরুর কথা দিয়েই শেষ করতে চাই- "বিপদে মোরে রক্ষা করো, এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে আমি না যেন করি ভয়"।

লেখক: অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ