X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

আমরা প্রকৃতির দাস-দাসী ।। বুলবুল চৌধুরী

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : পিয়াস মজিদ   
২৯ আগস্ট ২০২১, ১৪:৩১আপডেট : ২৯ আগস্ট ২০২১, ১৪:৫১

[খ্যাতনামা কথাসাহিত্যিক বুলবুল চৌধুরী গতকাল শনিবার মৃত্যুবরণ করেন। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি নানা রোগে ভুগছিলেন। ছয় মাস আগে তার ক্যানসার ধরে পড়ে। ষাটের দশকে আবির্ভূত কথাশিল্পী বুলবুল চৌধুরী ১৯৪৮ সালের ১৬ আগস্ট গাজীপুরের দক্ষিণবাগ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘টুকা কাহিনী’। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার, জসীমউদ্দীন স্মৃতি পুরস্কার, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার এবং একুশে পদক। এক যুগ আগে চিত্রশিল্পী ধ্রুব এষের পল্টনের বাসার ছাদে পুলক হাসান সম্পাদিত ‘খেয়া’ সাহিত্যপত্রের জন্য এ সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করা হয়।]


পিয়াস মজিদ : ‘সংসার’ গল্পের এক জায়গায় লিখেছেন, ‘জীবন আসলে মহাগল্প’; তো আপনার লেখালেখির মাধ্যমে এই উক্তির কতটুকু বয়ান করতে পেরেছেন? 
বুলবুল চৌধুরী : পিয়াস, নিশ্চয়ই খেয়াল করে থাকবে শিল্পের বিচিত্র সব মাধ্যমের মাঝে কথাসাহিত্যেই মানুষ সবিশেষ বিধৃত হয়ে আসছে। এতে সে জন্ম থেকে ধরে মৃত্যু অবধি জীবনের নিগূঢ় প্রভেদ নির্ণয় করে যাচ্ছে আপন দিঙ্মণ্ডলের সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গির মিশেল দিয়ে। আর জন্ম-মৃত্যুর ফাঁকে তার যেটুকু আয়ুষ্কাল—আমি তার এক দাস হয়ে জীবনের বহুখানি বয়সই তো পেরিয়ে দিলাম। বেঁচে থাকার ওই পর্বে কণা পরিমাণ থেকে শুরু করে উন্মাতাল ঢেউসমান অত্যাশ্চর্য ঘটনা নিরবধি সংঘটিত হয়েই চলছে। 
হ্যাঁ, জীবনোপায়ের এহেন কালচক্রে পাওয়া মান-অপমান আপনাতে একীকরণই হলো শুধু। আর সময়ের বহুতর মোচড় দিয়ে বুঝলাম, আমি এক বিস্ময়াভিভূত বালক হয়েই মানবলীলা দেখে যাচ্ছি। ওই পরিব্রাজন দিয়েও জমা হলো জীবনের বিস্ময়কর সব অধ্যায়! আপন চরিতাবলির পাতা উল্টে ফিরে ফিরে ওসবই তো উৎকলিত পাচ্ছি। পরিণতিতে তারই বশ মেনে কথাসাহিত্যের নিয়মে নিজের লেখায় সেসবই জড়ো করছি মহাগল্প ভেবে নিয়েই। 

পিয়াস মজিদ : ‘নান্দিবিনাশ’ গল্পে যৌথ পরিবার ভাঙনের দৃশ্যে এক ধরনের তীব্র হাহাকার লক্ষ করি। কিন্তু একে একে যখন আমাদের সামষ্টিক মূল্যবোধ ভেঙে পড়ছে, তখন আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন? 
বুলবুল চৌধুরী : দেখা ভূমির সঙ্গে মনোজগতের সংযোগই হচ্ছে প্রথম উন্মীলন। জন্মেছি গ্রামে। সেখানে থাকতে একটা যৌথ পরিবারের মাঝে অবাধ গতায়াত গড়ে উঠেছিল আদর পেয়ে পেয়েই। গৃহকর্তা গনি মিয়া বেঁচে থাকতে পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদ দূরে থাকুক, তাদের কেউ একে অন্যকে জোর আওয়াজে কোনো কথা বলতে শুনিনি। অথচ তার মৃত্যুতে স্বার্থের সংঘাত দেখা দিয়েছিল পরিবারটিতে। পরিণতিতে তাদের ভাঙন অনিবার্য হয়ে ওঠে। পরবর্তী পর্যায়ে বিষয়টা আমার গভীর আঁক কষে থাকার গল্পের আকারে চলে এসেছে কাগজের পাতায়। কিন্তু লেখালেখি কোনোমতেই জীবনের হুবহু প্রতিচ্ছবি নয়। এতে কল্পনার নানা মাত্রাও সন্নিবেশিত থাকে। ‘নান্দিবিনাশ’ লেখার সময়ে ভাবনা দিয়ে শূন্যতার কতেক মন্থন সমুপস্থিত করা হয়েছিল বোধহয়। সেজন্যই এই গল্পটিতে হাহাকার অমন ঠাঁই পেয়ে থাকবে। 
এবারে ফেরা যাক মূল্যবোধের জিজ্ঞাসায়। মনে পড়ে, ছোটবেলায় গ্রামে থাকতে আত্মীয়স্বজনের বাইরেও প্রতিবেশীদের অনেকেই ফলফলাদি খাওয়ার আমন্ত্রণ জানাত। সেদিনে অভ্যাগতদের পাতে তারা ওসব ঢেলেও দিত অঢেল পরিমাণে। আজ কোনো বাড়িতেই কিন্তু অতীতের সেই চল নেই। তলানি খুঁজতে গিয়ে নিরিখ করি, আজকের দিনে জনসংখ্যাধিক্যের ভারে বেড়ে ওঠা পরিবারগুলোর মধ্যে সম্পত্তি খণ্ড-বিখণ্ড আকার নিচ্ছে। ফলে কমে আসছে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি-জমার পরিমাণ। এতে প্রধান ঘাটতি দেখা দিয়েছে স্বাচ্ছন্দ্যে। ফাঁকে মানুষের কোমলবৃত্তি চাপা পড়ছে। কেননা, অভাববোধই জীবনের সবচেয়ে বড় আতঙ্ক। তা থেকে বাঁচাবার প্রচেষ্টায় মানুষ স্বার্থের সংঘাতে জড়িত হচ্ছে। এই যে বিপর্যয়—তারই চাকায় মূল্যবোধ কি পিষ্ট হচ্ছে না? 

পিয়াস মজিদ : আপনার অনেক গল্পের প্রধান চরিত্র হয়ে উঠেছে পতিতা। ‘পরমানুষে’ দেখি ভোগের বদলে এক পতিতার জন্য খদ্দের কঠিন জিজ্ঞাসা ছুড়ে দিয়েছে অদৃশ্য ঈশ্বরের দুয়ারে। এই মানবিক বোধ আপনি কোত্থেকে অর্জন করলেন? 
বুলবুল চৌধুরী : আমার গোটা চারেক গল্পে বেশ্যাদের কিছু গতিবিধি উঠে এসেছে। তাদের একজনও কিন্তু কল্পনার বুনন নয়। মনে পড়ে, সবে যুবক হয়ে ওঠার বয়সটাতে আমি ঘটনাচক্রে হাজির হয়েছিলাম ভৈরবের বেশ্যাপাড়ায়। মিনারা নামের একটা মেয়ের ঘরেও আমার জায়গা হয়েছিল সেরাতে। আলাপে আলাপে জেনেছিলাম, প্রেমে প্রতারিত হওয়ার পথ ধরেই ও বেশ্যাবৃত্তিতে জড়িয়ে গেছে। মেয়েটির দুর্ভাগ্যে আমি ‘মরমে মরে আছি’র বেদনাই ধরেছিলাম। মাঝে মিনারা আমার দুহাত নিজের দুমুঠোয় তুলে নিয়ে বলেছিল, ‘কই, আসো, বসবা না তুমি?’ আমরা বসেছিলাম চৌকিতে মুখোমুখি অবস্থানে। সেই বসে থাকার মাঝে ফের কী বসবার আছে ভেবে আমি জানতে চেয়েছিলাম, ‘বসব কি, আমি তো বসেই আছি।’ সঙ্গে সঙ্গেই মিনারা খিলখিল হেসে নিয়ে জবাব দিয়েছিল, ‘তুমি বুঝি পইল্লা আসলা পাড়ায়? শোনো, এই বসা মানে হইলো গিয়া মাইয়া-পুরুষের মিলন গো!’ ঠিক কামনা নিয়ে নয়, সেদিনে আমি এক বেশ্যার কাছাকাছি হয়ে শুধুই জানতে চেয়েছিলাম কী হেতু এই ঘৃণ্য জীবন বেছে নিতে হয়! তাই স্পষ্ট জবাব দিয়েছিলাম, ‘শরীর পেতে আমি তোমার কাছে আসিনি।’ 
বেশ বুঝি, যৌনসম্পর্ক স্থাপন করতেই বেশ্যার ঘরে পুরুষের প্রবেশ ঘটে থাকে। আমার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঠাউরে ও নিশ্চয় অত্যাশ্চর্য মেনেছিল। ফিরতিমুখে টাকা ধরিয়ে দিতে গেলে মিনারা সবটা ঠেলে দিয়ে বলেছিল, ‘মাঝে মাঝে আইসা দেইখা যাইও আমারে।’
সেই থেকে বছর কয়েক বেশ্যাটির ঘরে আমার আসা-যাওয়া বজায় ছিল। অথচ পাশাপাশি শুয়ে থাকা সত্ত্বেও মুহূর্তের খেয়ালে একে অপরকে ছুঁয়ে দিইনি। শেষবারের সাক্ষাৎকারে মিনারার জন্য কিনেছিলাম একখানা শাড়ি। আশা ছিল, তা পেয়ে নিজ থেকে পরে নিয়ে ও দাঁড়াবে আমার সামনে। সেসব বাদ থাকুক, উল্টো বুঝেছিলাম, আমার কথায় কোনো কান নেই মেয়েটির। এতে আমিও রাগ দেখিয়ে ঘর ছেড়ে দৌড়পায়ে নেমে পড়েছিলাম পথে। মিনারা কিন্তু তারও বেশি দ্রুততায় আমাকে আগলে দাঁড়িয়ে বলেছিল, তুমি ক্যান বোঝ না আমি পরমানুষ! ঢাকায় ফিরে অবশ্য ওর এই আচরণের হেতু বুঝতে চেয়েছি। ভেদ না পেয়ে কিছুদিন বাদে ভৈরব পৌঁছে জানতে পাই, ভাউড়া পাইন্না হারামির ছুরিকাঘাতে মিনারা মারা গেছে। সঙ্গে সঙ্গেই ভেবেছি, ও যে বলেছিল, ‘আমি পরমানুষ’—উচ্চারণটা কানে বেজে চললেও সেই তলদেশের অর্থ উদ্ধার করতে পারিনি। ওর করুণ মৃত্যুতে বোধ জেগেছে, ভাউড়ার অধীনে বেশ্যাবৃত্তিতে নিয়োজিত মিনারা আসলে পরমানুষ হয়েই চলছিল। পরিণতিতে এই অধ্যায় না-ভোলা স্মৃতি হয়েই বাঁধা পড়ল মনের পটে। অবশেষে ‘পরমানুষ’ গল্পে মিনারার সত্য কাহিনি আমি লিপিবদ্ধ করেছি দুয়ের মাঝে গড়ে ওঠা অনুভবের দ্যোতনা দিয়েই। 
আচ্ছা, মানুষের বিপদে মানুষের প্রাণ কেঁদে উঠবে—সেটাই যে মানবিকতার আবাহন। তাই সমাপ্তিতে পৌঁছে চিনজানের মিনারাকে ওই মানুষেরই নিষ্ঠুরতায় প্রাণ দিতে হওয়ার ঘটনায় ঈশ্বরের দুয়ারে নায়ক আরমানের অমন জিজ্ঞাসা যৌক্তিক উত্থাপনই ভেবেছি। 

পিয়াস মজিদ : আপনার খ্যাত গল্প ‘টুকা কাহিনী’র প্রধান চরিত্র টুকার দ্রোহী সত্তার সমান্তরালে প্রকৃতির শান্ত রসের বিস্তার দেখি। গল্পটির শেষ দৃশ্যের শেষ লাইনে আপনি লিখলেন, ‘ফালি চাঁদ ছিল আকাশে। তাও কি আছে!’ এ কি আপনার গল্পকৌশল? 
বুলবুল চৌধুরী : পৃথিবীর ইতিহাসে উল্টে দেখা যায়, আবহাওয়াভেদে মানুষের বর্ণ, গড়ন এবং মানসপ্রবণতাও ভিন্ন রূপ নিচ্ছে। সেই বিচারে আমরা প্রকৃতির দাস-দাসী হয়েই তো বিচরণশীল আসলে। জোর করে মায়ের তালাক নেওয়ার সময় প্রতিবাদমুখর বাস্তবের টুকাকে আমি দেখেছি খুব কাছ থেকে। আবার চলতি পথে ঘুরে চলা ঠায়-ঠিকানাবিহীন এক নারীকে নিজের ঘরণী করে নেওয়াতেও মানুষটাকে ঘিরে বিস্তর চমক অনুভব করেছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে লক্ষণীয় হচ্ছে, ঋতুর আবর্তেই পুরোপুরি বাঁধা ছিল তার জীবন। খরার দিনগুলোয় তিনি আশপাশের বাড়িতে কামলা খাটার পাশাপাশি পৈতৃক সূত্রে পাওয়া এক খণ্ড ভূমিতে সযতনে ফলাতেন সবজি। সেখানটায় শিম মাচানের তলায় বসা নিড়ানি হাতের টুকা বাদাইল্লা ঘাসের প্রতিটি শিকড় তুলে আনেন মাটি খুঁটে খুঁটে। কেননা, তার জ্ঞান আছে, এসবের কোনো একটা অবশিষ্ট থেকে গেলে তা নিশ্চিতভাবেই অঙ্কুরিত হবে। আবার ওই ঋতুর আবর্তে এলাকায় বর্ষা নেমে এলে তিনি মাইসকা খাটতে ছুটে যেতেন দূর টেক অঞ্চলে। 
পিয়াস, এ থেকে তুমি নিশ্চয় অনুমান করতে পারছ যে, টুকা এক বাস্তবের অধ্যায়। তারপর আসা যাক তার ঘোড়া মারার দৃশ্যে। অন্ধ রাগের বশবর্তী হয়েই তিনি রাতের অন্ধকারে হাওড়া গাছে চড়ে বসে ঘাস খেয়ে চলা নায়েবের ঘোড়ার বুকে লাগিয়েছিল জুইত্তার ঘাই। পরে সেই ঘোড়ার বাচ্চাকে সামনে পেয়ে বিবেকের দংশনে কৃত অপরাধে ক্ষমা চাইতে মানুষটা হাজির হয়েছিলেন নায়েবের দুয়ারে। তার সঙ্গে ছিল মায়ের তালাক হয়ে যাওয়া অসহায় টুকার মতো তারই কারণে মা হারানো ঘোড়ার বাচ্চাটিও। শেষ দৃশ্যে সব শুনে নায়েব জোর লাথি বসিয়েছিলেন অপরাধীর গায়ে। কিন্তু আপন দুর্ভাগ্যে সমাজের কাছ থেকে কিংবা নিজের কাছ থেকে তার কি কোনো সমাধান টানতে পারলেন তিনি? পরিণতিতে নায়েবের লাথিতে বাগানের মাটিতে ছিটকে পড়া টুকা ব্যাঙের ‘ম্যাঘ দ্যাও’ ডাক যেমন শুনলেন, তেমন অন্ধকারের বুক চিরে যাওয়া কুপাখির ডাকও পশেছিল তার কানে। সেই ঘোর-বেঘোর পতিত মানুষটার মনোভূমিতে ‘ফালি চাঁদ ছিল আকাশে। তাও কি আছে’র অনুভব একীভূত হতেই পারে। সে জন্যই এখানটায় পৌঁছে প্রকৃতির কোলে তিনি সমর্পিত হয়েছিলেন। তবে কৌশল নিয়ে যদি প্রশ্ন তোলা হয়—উত্তরে বলি, উপস্থাপনার অভিনবত্ব পরে শিল্পের কৌশল হিসেবে পরিগণিত হতেও পারে। 

পিয়াস মজিদ : আপনার ‘টুকা কাহিনী’কে কি অতিক্রম করতে পেরেছেন বলে মনে করেন? 
বুলবুল চৌধুরী : খেয়াল করেছি অনেকেই আমার প্রসঙ্গ উঠলে ‘টুকা কাহিনী’র বুলবুল চৌধুরী এমনটা ভাব ব্যক্ত করে থাকেন। তবে আমার এই গল্পটি সম্পর্কে প্রথম প্রশ্নের পর দ্বিতীয় পর্বে তুমি অন্যতম উত্থাপন টেনে আনলে। আগের দফায় তা নিয়ে বলতে গিয়ে একখানা ঋণ শুধবার আকাঙ্ক্ষায় ‘টুকা কাহিনী’র জন্ম সম্পর্কিত আমার আপন দায়-দায়িত্বটুকু জানিয়ে রাখার তাগাদা বোধ করেছিলাম। এক্ষনে সুযোগ বুঝে এবং কিছুটা প্রাসঙ্গিক ভেবেই বিষয়টি তুলে আনছি। 
মনে পড়ে, ১৯৭২ সালের দিকে এসে ইতিউতি গল্প লেখার ভেতর দিয়ে তরুণ প্রতিভাবান গল্পকার হিসেবেই কারো কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিলাম। এই সময়টায় আমি ওয়াপদার সরকারি চাকরিতে সকাল আটটা থেকে দুপুর দুটো অবধি হাজিরা দিতাম। তারপরই ছুটে যেতাম ভিক্টোরিয়া পার্ক-লাগোয়া অলক বারী সম্পাদিত মাসিক ‘রোমাঞ্চ’ অফিসে। সেদিনে এই পত্রিকা মূলত তৈরি হতো আমার এবং প্রিয় বন্ধু লেখক-অনুবাদক শেখ আবদুল হাকিমের পরিকল্পনায়। এতে চার রং কভার ডিজাইন করা ছাড়াও ভেতরের আঁকাআঁকি ও অঙ্গসজ্জা সামলাতেন প্রথমে আঁকিয়ে আর পরে অভিনেতা হয়ে ওঠা আফজাল হোসেন। লেখা দেওয়ার সুবাদে সেখানে যাতায়াত ছিল শেখ আবদুর রহমান, ইমদাদুল হক মিলন, সিরাজুল ইসলাম এবং আরও অনেকেরই। এই দলের একজন হচ্ছেন হেলাল। তিনি লিখতেন না, তবে সাহিত্যের চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে পারার পাশাপাশি ঘুরে ঘুরেই সাহিত্যিকদের সঙ্গ দিতেন। সেবারে বাস্তবের টুকাকে নিয়ে একখানা গল্প লেখার স্বপ্ন-খেয়াল জানাতেই তিনি তা সম্পন্ন করার জন্যই আমাকে ক্রমান্বয় আন্তরিক তাগাদা দিয়ে চলছিলেন। 
তবে হয়েছিল কী, সেদিনে অলক বারীর ‘রোমাঞ্চ’ অফিসে তিন তাসের জুয়ার নেশায় ডুবে গিয়েছিলাম আমি। কখনো কখনো রাত পার করে ভোরও নেমে আসত তাতে। ফলে বাস্তবের টুকাকে নিয়ে গল্প লেখা বাদই পড়েছিল। অন্যদিকে, হেলাল কিন্তু নিত্যিনিত্যি জুয়ার আসরে ঢুকে ‘কাহিনী তো জানাই আছে, বসে গেলেই শেষ করতে পারেন’—এমন সব কথাই শোনাতেন। অবশেষে লেখাটা লিখিয়ে নেওয়ার আশায় এক রাতে জুয়ার বোর্ড থেকে আমাকে তিনি জোর করেই উঠিয়ে নিয়েছিলেন তার বাসায়। খাওয়া-দাওয়ার পালা চুকে যেতেই হেলাল কাগজ-কলম বের করে টুকাকে ঘিরে গল্প শুরু করার অনুরোধও জানালেন। প্রকৃতপক্ষে অন্তরের তাগাদা নয়, তার হাত থেকে বাঁচোয়া পেতেই আমি লেখাটা শুরু করেছিলাম। তবে অনেকখানি রাত জেগে কাগজের পাতা ভরিয়ে তুললেও তা শেষ না হওয়ায় পরের রাতে তার ঘরে বসেই গল্পটার সমাপ্তি টেনেছিলাম। আমার হস্তাক্ষর ভারি জটিল বিধায় হেলাল নিজের হাতে ‘টুকা কাহিনী’র কপি তৈরি করে পৌঁছে দিয়েছিলেন তৎকালীন ‘গণসাহিত্যে’র সম্পাদক আবুল হাসনাতের হাতে। 
আজো ভেবে ভেবে থই করতে পারলাম কই যে, নিজের কাজ বাদ ফেলে তিনি কী চিন্তায় আমাকে দিয়ে গল্পটা লিখিয়েই ছাড়লেন। তার চেয়েও রহস্য রয়ে গেল হেলালের আত্মহননের পথ বেছে নেওয়ার কারণ উদ্ধার করতে না পেরে। ‘টুকা কাহিনী’ পত্রিকায় ছাপা হওয়ার পর অনেক প্রশংসাই জুটেছে ভাগ্যে। লেখার সময়ে এ রকম কিছু প্রাপ্তি আসবে তা কিন্তু মোটেও বোধ করিনি। পরে অবশ্য গল্পটা পড়তে বসে প্রশ্ন জেগেছে, আচ্ছা, আমি এ রকম সাজিয়ে তুললাম কীভাবে! শুধু এখানটাতেই নয়, দিনে দিনে হয়ে ওঠা আমার বহু লেখার ছত্র নির্মিতিতে ফিরে ফিরে ওই চমক কি না বুঝে চলছি! আসলে একখানা শ্রেষ্ঠ লেখা লিখব চিন্তার একাগ্রতা দিয়ে যেকোনো রচনার সমাপন দেওয়া সম্ভব। তবে শিল্পে ভরের মিশেল ঘটলেই তা শুধু কালের পাতায় অক্ষয় ছাপ ফেলতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়, মানুষের জন্ম যেমন দশ মাস দশ দিনের গর্ভজাত ফসল, শিল্পের জন্মও তেমন দশ মাস দশ দিনে পূর্ণতা পেয়ে থাকবে। অবশ্য লেখকের সেই দশ মাস দশ দিন পূর্ণ হয় কখনো দশ দিনে, কখনো তারও অনেক কম-বেশি সময় পেরিয়ে তবেই। শুধু ‘টুকা কাহিনী’র বেলায় নয়, নিজের বেশকিছু রচনায় আমি চোখ ফেলে অমন থমকে থমকেই চলি। এতে কোনো লেখা কোনোটিকে অতিক্রম করে গেল তা আমার পক্ষে মনে হয় নির্ণয় করা কঠিনই। 

পিয়াস মজিদ : ‘ভাওয়াল রাজার উপন্যাস’ রচনা করেছেন ঐতিহাসিক ঘটনা অবলম্বনে। এ দিকটায় আগ্রহী হলেন কী ভেবে? 
বুলবুল চৌধুরী : সেবার পথে হঠাৎ করেই খানিক সৌজন্য বিনিময় করার খেয়ালে ঢুকে পড়েছিলাম বিটিভির তৎকালীন মহাপরিচালক মোস্তাফিজুর রহমানের অফিসে। নানা কথার অবকাশে তিনি বলেছিলেন, ‘ভাওয়াল রাজাকে ঘিরে অনেক নাটক, চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে। বিষয়টা নিয়ে আপনি উপন্যাস লিখছেন না কেন?’ 
আমি নিজেও পরগনে ভাওয়ালের মানুষ। ছোটবেলায় গ্রামে থাকতে অনেকের মুখে ভাওয়াল রাজার কাহিনি শুনেছি। তাতে রহস্যের আভাসই মিলেছিল। বয়সে উঠে ঢাকার হলে বসে উত্তম কুমার-সুপ্রিয়া দেবী অভিনীত ‘ভাওয়াল রাজা’ ছবিটি দেখেছি। একই বিষয়কে ধরে বাংলাদেশের দু’পরিচালকও দুটো ছবি নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু এসবের কোনোটিই আমার জিজ্ঞাসার পূর্ণতা দিতে পারেনি। আর মোস্তাফিজুর রহমানের ওই উক্তির পর আমি ভাওয়াল রাজা সম্পর্কিত অনেকের লেখা ইতিহাস পড়লাম। পৃথিবীর বেশকিছু লোকজয়ী নাটক ও উপন্যাস ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত হওয়ার নিদর্শন আছে। এক্ষেত্রে আমিও ভাওয়াল রাজাদের চিত্রবিচিত্র অধ্যায়ে সব মেনেই উপন্যাসটি তৈরি করেছি। কিন্তু ফলাফলে কিছু ফাঁক থেকে যাওয়ায় বইটির পুনর্মুদ্রণ বন্ধ রেখে বর্তমানে সেটির পুনর্লিখনে নিয়োজিত আছি। 

পিয়াস মজিদ : ‘অপরূপ বিল-ঝিল-নদী’ নামে আপনার একটি গল্প আছে। পরে ওই বিষয়কে ঘিরে একই নামের উপন্যাস বের হয়েছে। গল্পের সম্প্রসারণ কি উপন্যাসে পরিণতি পেতে পারে? 
বুলবুল চৌধুরী : ছোটগল্প আসলে রবীন্দ্রনাথের ‘ছোট প্রাণ, ছোট কথা, ছোট ছোট দুঃখ-ব্যথার’ই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভান্ডার। আর উপন্যাস জীবনের ব্যাপ্তি নিয়েই গঠিত হয়ে থাকে। ‘অপরূপ বিল-ঝিল-নদী’ নামে গল্পটা লিখবার পরপরই নায়িকার বিচিত্র গতিবিধির উৎপত্তি কোথায় সেই প্রশ্ন জেগেছিল মনে। উত্তর খুঁজতে গিয়ে কল্পনার অনেক ডালপালা প্রসারিত হতে থাকার খেলায় আমি তা উপন্যাসে রূপান্তরিত করি। 

পিয়াস মজিদ : আপনার ‘জীবনের আঁকিবুঁকি’ বইটিতে খণ্ড খণ্ড আকারে কিছু আত্মকথন লেখা হয়েছে। অন্যান্য লেখাতেও সেই ছাপ পড়েছে। নিজের ঘটনাবলি নিয়ে কি কোনো রচনা লেখার ইচ্ছে জেগেছে কখনো? 
বুলবুল চৌধুরী : হ্যাঁ, আগেই বলেছি, আমি বিস্ময়াভিভূত বালক হয়েই পড়ে আছি মানুষের মাঝে। আর জীবনের অনেকগুলো বছর পেরিয়ে দেওয়ার ভেতর দিয়ে জীবনের বিচিত্র অবলোকনও অনেকাংশে পূর্ণতর হলো। এক্ষণে সেসবের স্মৃতিকথন নয়, সত্যিকারের সব প্রতিফলন দিয়ে আত্মজীবনীর আকারে লিখে রাখার সাধ ধরেছি। ‘আপননামা’ নামকরণের ভেতর দিয়ে লেখাটির প্রাথমিক দিকে প্রাথমিক আঁকিবুঁকিও চলছে। 

পিয়াস মজিদ : আপনার গল্প-উপন্যাসে একটা বিশেষ অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ ঘটেছে। সেক্ষেত্রে জানতে চাইব, সাহিত্যে উপভাষার প্রয়োগকে আপনি কীভাবে দেখেন? 
বুলবুল চৌধুরী : কোনো কোনো পাঠক ক্ষেত্রবিশেষে আমার আঞ্চলিক ভাষা বুঝতে না পারার অনুযোগ এনেছেন। তবে কথা হচ্ছে, আমি যখন কোনো বিদেশি ছবি দেখি, তখন কি সেই ভাষা পুরোপুরি বুঝতে পারি? আমাদের সাহিত্যে আঞ্চলিক ভাষার বহুতর প্রয়োগ ঘটেছে। কোনো পাঠকই কি সেসব স্থানীয় প্রতিটি শব্দের যথার্থ অর্থ উদ্ধার করতে পারেন? নিজের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, আমি যে অঞ্চলের মানুষকে নিয়ে লিখছি, সে তো আপন ধারার কথকতাই উজাড় করে দিচ্ছে অন্যকে। সেক্ষেত্রে আমি সংলাপে শুদ্ধ ভাষা ব্যবহার করলে তা যে নগরে বসে গ্রামের লেখা গল্পই হয়ে উঠবে। 

পিয়াস মজিদ : কল্পনাবাদী, না অভিজ্ঞতাবাদী লেখক মনে করেন নিজেকে? 
বুলবুল চৌধুরী : পিয়াস, সাহিত্যে জীবনের প্রতিফলন হরহামেশই মিলছে দেখবে। আপাতদৃষ্টিতে লিপিবদ্ধ গল্প-উপন্যাসকে জড় ঠেকবে সন্দেহ কি। কিন্তু প্রকৃত সাহিত্য বিষয়বস্তু নির্বাচন, ভাষা প্রয়োগ এবং অভিনব উপস্থাপনায় মানুষের মতোই রক্ত-মাংসসঞ্জাত থাকে। এমন বিবেচনায় লেখালেখিতে আমি সত্যের সঙ্গে কল্পনার অনেক মিশেল অবশ্য দিয়ে যাচ্ছি। তবে সেই কল্পনা কিংবা রহস্য পাঠকের কাছটায় অবিশ্বাস্য ঠেকলেও শেষাবধি মনে হওয়া চাই—হ্যাঁ, হ্যাঁ এমনটা তো ঘটতে পারে বাস্তবে এবং মানুষের মনোজগতে।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা