X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

বাকস্বাধীনতা বনাম নারী-বিদ্বেষী প্রচারণা

ফারজানা মাহমুদ
০২ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৬:২০আপডেট : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৭:৩৮

ফারজানা মাহমুদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি গান আছে। গানটির প্রথম লাইন হলো, ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা, মনে মনে।’ মনে মনে আপনি-আমি যা খুশি ভাবতে পারি। চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা ছাড়া মানবকল্যাণ সম্ভব নয়, তাই চিন্তার স্বাধীনতা অবাধ, এটি আমাদের সংবিধানেও স্বীকৃত। চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা অবাধ হলেও যা খুশি বলা বা প্রকাশ করা উচিত কিনা তা নিয়ে আমাদের অনেকের মধ্যে দ্বিমতও আছে। কারও যা ইচ্ছা তা বলার কারণে যদি কোনও ব্যক্তির সম্মানহানি ঘটে, কোনও গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ায় কিংবা সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, তবে সেই বাকস্বাধীনতার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।

আমাদের সংবিধানের ৩৯নং অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিরবচ্ছিন্ন অধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অনুচ্ছেদ ৩৯(২)-এ বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনের প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার রয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অবাধে মত প্রকাশ করা যায় বলে অনেক সময় আমরা দেখি নারী-বিদ্বেষী মতামত মিথ্যা প্রচারণা, অন্যের ধর্মের অবমাননা বা বিশেষ গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় কেন্দ্রিক ঘৃণা উসকে দিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে একজনের মত প্রকাশের স্বাধীনতা আরেকজনের সামাজিক ও মানসিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, অথবা সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে।

আমাদের দেশে বিদ্যমান আইন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মত প্রকাশের স্বাধীনতা সঙ্গে ধর্মীয় সংবেদনশীলতা, শালীনতা ও জনশৃঙ্খলার সামঞ্জস্য রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। বিশেষত যদি ধর্মীয় বা ধর্মের ব্যাপারে সমালোচনার জায়গাটা দেখি। দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ২৯৫(ক) ধারায় বলা হয়েছে, ইচ্ছাকৃতভাবে দেশের কোনও নাগরিককে মৌখিক, লিখিতভাবে বা অন্য কোনও উপায়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হলে তা ধর্মীয় অবমাননা বলে গণ্য হবে। এ রকম অপরাধের ক্ষেত্রে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।

২৯৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোনও ব্যক্তির ধর্মানুভূতিতে আঘাত করার উদ্দেশ্যে ধর্মীয় কোনও স্থানে অনধিকার প্রবেশ করা, মৃতদেহের অসম্মান অথবা শেষকৃত্যানুষ্ঠানে সমস্যা তৈরি করা হলে সেটাও ধর্মীয় অবমাননা বলে গণ্য হবে। এ রকম অপরাধের ক্ষেত্রে এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।

দণ্ডবিধির ২৯৮ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ধর্মানুভূতিতে আঘাত করার উদ্দেশ্যে কোনও বাক্য বা শব্দ বিকৃত করা, এমন অঙ্গভঙ্গি করা যাতে তার ধর্মবিশ্বাস আহত হতে পারে, এমন আচরণ করা হলে এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। সেই সঙ্গে জরিমানারও বিধান রয়েছে। 

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (২০১৮)-এর ২৮ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ কোনও কিছু প্রকাশ, সম্প্রচার, ওয়েবসাইট বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রচারের মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কারও ধর্মীয় বিশ্বাস বা মূল্যবোধে আঘাত করেন, তাহলে সেটা একটা অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।

এ ধরনের অপরাধ করলে অনূর্ধ্ব সাত বছররে কারাদণ্ড এবং অনূর্ধ্ব ১০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে। তবে কেউ যদি দ্বিতীয়বার একই ধরনের অপরাধ করনে, তাহলে তার অনূর্ধ্ব ১০ বছরের কারাদণ্ড, ২০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।

ন্যাশনাল ব্রডকাস্ট পলিসি ২০১৪ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া হয় এমন কিছু সম্প্রচার করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু কী বললে বা প্রকাশ করলে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত আসতে পারে বা ধর্মীয় অনুভূতির পরিমাপক কী– তা পরিষ্কার নয়। যেহেতু ‘অনুভূতি’ একটি বিমূর্ত ও ভাবমূলক শব্দ, তাই উপরোক্ত আইনগুলোর ধারাসমূহের অপব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।

চিন্তার স্বাধীনতা এমন হতে হবে যেন অন্যের ক্ষতির কারণ কিংবা ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি না করে। আবার কারও সমালোচনা বা মতামত যদি ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে তবে সেই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে প্রচলিত আইনের আওতায় নিয়ে এসে শাস্তি এবং সংশোধন নিশ্চিত করতে হবে। আইন নিজ হাতে তুলে নিয়ে সমালোচকের শাস্তি নিশ্চিত করা কিংবা কোনও মতামত বা মতাদর্শকে মানতে না পারলে সমালোচকের শাস্তি কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কোনও অবস্থাতেই নির্ধারণ করতে পারেন না।

আমাদের দেশের আইনে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কারণে বাকস্বাধীনতাকে সংকুচিত করার বিধান আছে। কিন্তু নারীর প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষ ছড়ানোর বিষয়ে বাকস্বাধীনতা সংকচনের কোনও বিধান নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে কিংবা নানা ধরনের ভিডিও তৈরি করে যেভাবে নারী-বিদ্বেষী মতবাদ ও মতামত ছড়ানো হয়, তাকে মত প্রকাশের স্বাধীনতার আওতায় না এনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা উচিত। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যেসব নারী কর্মক্ষেত্রে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নিজগুণে স্বীয় অবস্থান তৈরি করেছেন– কোনও বিশেষ ঘটনাকে উপলক্ষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের নিয়ে অশালীন,নারী-বিদ্বেষী প্রচারণা, এমনকি ভিডিও তৈরি করে ছাড়া হচ্ছে। কর্মজীবী নারীদের ঘিরে নেতিবাচক প্রচারণা ও ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ সমাজের সব শ্রেণির নারীর অগ্রগতিকে ব্যাহত করবেই। নারী-বিদ্বেষী প্রচারণা নারী নির্যাতনের ঘটনাকেও বাড়িয়ে তুলবে। তাই যেকোনও ধরনের বক্তব্য, মতামত, প্রকাশনা বা প্রচার, যা নারী-বিদ্বেষী কিংবা গোষ্ঠী হিসেবে নারীদের প্রতি ঘৃণা ও অবমাননাকে উৎসাহিত করে, তা আইনের দ্বারা নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। আমাদের নারীদের অগ্রগতি, স্বাধীনতা, নিরাপত্তা নিশ্চিতে শুধু শৃঙ্খলা, নৈতিকতা, শালীনতা কিংবা মানহানি সাপেক্ষে নয়, ‘নারীর প্রতি ঘৃণার প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত বিধিনিষেধ সাপেক্ষে’ প্রতিটি নাগরিকের মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার প্রদান করতে হবে। আমাদের সংবিধানের ২৮নং অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র ও জনজীবনের সব পর্যায়ে নারী ও পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। জনজীবন ও সামাজিক পরিমণ্ডলে নারীর সমান অধিকার ও পদচারণা নিশ্চিতে নারীর স্বাধীনতা ও সম্মান নিশ্চিত করতে হবে প্রতিটি স্তরে। নারী-বিদ্বেষী প্রচারণা নারীর অগ্রযাত্রায় প্রতিবন্ধক এবং এটি নানা ধরনের নির্যাতনকেও উৎসাহিত করে। তাই প্রচলিত আইনে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে কীভাবে নারীর সম্মান ও অধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা যায়, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।  

লেখক: (ব্যারিস্টার) আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। মানবাধিকার কর্মী। 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
উত্তর গাজায় আবারও হামলা জোরদার করলো ইসরায়েল
উত্তর গাজায় আবারও হামলা জোরদার করলো ইসরায়েল
ফরিদপুরে দুই নির্মাণ শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় বিএনপির তদন্ত কমিটি
ফরিদপুরে দুই নির্মাণ শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় বিএনপির তদন্ত কমিটি
বৃষ্টির জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়লেন মুসল্লিরা
বৃষ্টির জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়লেন মুসল্লিরা
সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিতে চাকরি, ৫ ক্যাটাগরির পদে নিয়োগ
সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিতে চাকরি, ৫ ক্যাটাগরির পদে নিয়োগ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ