X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

১০ মিনিটের পথ পার হতে ৫০ মিনিট

সাদ্দিফ অভি
০৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১১:০০আপডেট : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৮:০৬

কাওসার আহমেদ কলাবাগান থেকে যাবেন কাওরান বাজার। সিএনজি অটোরিকশা কলাবাগান বাসস্ট্যান্ড থেকে শেখ রাসেল স্কয়ারের সিগন্যালে আসতে তার সময় লাগলো দুই মিনিট। সিগন্যাল পেরিয়ে পান্থপথ ধরে এগুতে থাকলেন। স্কয়ার হাসপাতাল পার হতে তার সময় লাগলো আরও ১০ মিনিট। সেখান থেকে পান্থপথ সিগন্যাল পর্যন্ত যেতে আরও ১৮ মিনিট সময় ব্যয় হলো। পান্থপথ-গ্রিনরোড সিগন্যাল পার হয়ে বসুন্ধরা সিটির সামনে দিয়ে কাওরান বাজার সিগন্যাল পার হতে সময় লাগলো আরও  ২০ মিনিট। অর্থাৎ কলাবাগান থেকে কাওরান বাজার— এই আড়াই কিলোমিটার পথ  পাড়ি দিতে কাওসার আহমেদের সময় লেগেছে ৫০ মিনিট। অথচ এই পথটুকু পার হতে সর্বোচ্চ ১০ মিনিট লাগার কথা। যানজটের কারণে এত সময় লেগেছে বলে জানান তিনি।  

শুধু কাওসার আহমেদ নন ঢাকায় বসবাসকারী নাগরিকদের পথচলায় নিত্যদিনের দুর্ভোগ এই যানজট। যানজটের কারণে সাধারণ মানুষ এমনকি রাষ্ট্রেরও ক্ষতি হয় আর্থিকভাবে। যানজটে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষায় তৈরি হয় মানসিক অবসাদ, আর অযথা মানুষের জীবনের কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। গবেষণা বলছে,  যানজটের কারণে শুধু ঢাকায় দিনে ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। যার আর্থিক ক্ষতি বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। যানজট পরিস্থিতি দিন দিন যেভাবে খারাপ হচ্ছে, তাতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণও আরও বাড়বে।

যানজট নিয়ে সর্বশেষ গবেষণা বলছে, ঢাকায় যানজটের কারণে পিক আওয়ারে গণপরিবহনগুলোর গতিবেগ ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটারে নেমে এসেছে, যেখানে হেঁটে চলার গড় গতিও ৫ কিলোমিটার। ফলে প্রতিদিন ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। ১২ বছর আগেও এই গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার।

রাস্তার দুই ধারে এমন তীব্র যানজট নগরবাসীর নিত্যসঙ্গী (ফাইল ছবি)

যানজটে আর্থিক ক্ষতি

২০১১ সালে রাজধানীতে যানজটের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইইবি) জানায়, ক্ষতির পরিমাণ বছরে ২০ হাজার কোটি টাকা। ২০১২ সালে যানজটের আর্থিক ক্ষতি নিরূপণ করে ইউএনডিপি। তাতে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩১ হাজার কোটি টাকার মতো। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ড (বিওআই) জানায়,  রাজধানীতে যানজটের কারণে বছরে অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার, যা মোট জিডিপির ৭ শতাংশের সমান।

সর্বশেষ ২০১৮ সালে ‘ঢাকা মহানগরীর যানজট: আর্থিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই)। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, যানজটের কারণে ২০ হাজার থেকে ৫৫ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক ক্ষতি হচ্ছে। এ থেকে বলা যায়, যানজটের কারণে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে গড়ে ৩৭ হাজার কোটি টাকা। তবে সড়ক খাতে বিনিয়োগ, যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও যানজট নিরসনে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এই ক্ষতি অন্তত ৬০ শতাংশ, বা ২২ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা যেত।

কীভাবে রাষ্ট্রের ক্ষতি হচ্ছে, জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক এবং বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মো. মোয়াজ্জেম হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘করোনার কারণে পরিস্থিতি এখন বুঝার উপায় নেই। অনেক কিছু বন্ধ ছিল। আর পরিস্থিতি ভালো হওয়ার কোনও কারণ নেই। পরিস্থিতি উন্নতি করার জন্য বাস সিস্টেম উন্নত করা, পথচারী সিস্টেম ইমপ্রুভ করা, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের যে ব্যবস্থা ইমপ্রুভ করার কথা ছিল, সেটিও হয়নি। সুতরাং, অবস্থা ভালো হওয়ার কোনও কারণ নেই।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দৈনিক যে কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, সেখান থেকেই এই আর্থিক ক্ষতির হিসাবটা এসেছে। একজন মানুষ প্রতিঘণ্টায় ন্যূনতম যে আয় করেন, সেই হারের সঙ্গে কর্মঘণ্টার হিসাব করে যে অঙ্কটি পাওয়া যায়, সেটি হচ্ছে এই ৩৭ হাজার কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি।’

এই আর্থিক ক্ষতি পৃথিবীর কোনও দেশ শতভাগ পুষিয়ে নিতে পারবে না, উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কারণ শহর থাকবে, মানুষ থাকবে, জ্যাম কিছু পরিমাণ থাকবেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এটাকে কত শতাংশ কমানো সম্ভব। আমাদের ধারণা ছিল— এটি শতকরা ৫০ ভাগ কমানো সম্ভব। পরিবহন খাতে বেসিক যে প্রয়োজনগুলো, সেগুলো বাস্তবায়নের মধ্যে কমপক্ষে ৫০ ভাগ কমানো সম্ভব। সেই অর্থে ১৯-২০ হাজার কোটি টাকা হয়। সরকারের যদি সঠিক বিনিয়োগ পরিকল্পনা সেখানে কাজ করে এবং প্রতি বছ যদি ৫-১০ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হতো, তাহলে হয়তো কাজ হতো। এখন বলতে পারেন, ২২ হাজার কোটি টাকার মেট্রোরেল হচ্ছে, কিন্তু সেটা তো এখনও চালু হয়নি। আরও দুই বছরেও আসছে না। এটি হচ্ছে ১০টি ‘গুটি’র (উপায়) একটি, বাকি যে ৯টি গুটি আছে, সেগুলোর ক্ষেত্রেও কিন্তু কিছু বিনিয়োগের প্রয়োজন আছে। সেটা কিন্তু করা হয়নি এবং সেখানে অল্প টাকার বিনিয়োগ। ট্রাফিক সিস্টেম ও বাস ম্যানেজমেন্ট— এগুলোতে কিন্তু অল্প টাকার বিনিয়োগ। ১-২ হাজার কোটি টাকার মধ্যে হয়ে যাওয়ার কথা। আমাদের বাস সিস্টেমে কাজ করা অত্যন্ত জরুরি। সেখানে হাত দেওয়া হয়নি এখনও। আরও মেট্রোরেল করা হবে, সেগুলো হবে ২০৩০ সালে। কিন্তু এর মধ্যে মানুষের দুর্ভোগ চলতে থাকবেই, আর আর্থিক ক্ষতির পরিমাণও বাড়তে থাকবে।’    

যানজটে নষ্ট হচ্ছে কর্মঘণ্টা

রাহাত হোসেন প্রতিদিন মোহাম্মদপুর থেকে গুলশানে গিয়ে অফিস করেন। সকাল ৯টায় অফিসে প্রবেশ করতে হলে তাকে সকাল সাড়ে ৭টার মধ্যে বাসা থেকে রওনা হতে হয়। আবার অফিস শেষ করেন বিকাল ৫টায়, বাসায় আসতে আসতে তার বাজে প্রায় ৭টা। সারাদিনে অফিসের প্রয়োজনেও বাইরে বের হতে হয় তাকে। ক্লায়েন্টের সঙ্গে মিটিং থাকলে ২ ঘণ্টা আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে বের হতে বলে জানান তিনি। রাস্তার যানজটের কথা চিন্তা করেই এটা করেন তিনি। যানজট না থাকলে গুলশানে যেতে বড়জোর ৩০ মিনিট সময় লাগতো বলে জানান তিনি। বাকি দেড় ঘণ্টায় তিনি অফিসের অন্য কাজ করতে পারতেন।   

এআরআই ’র গবেষণায় বলা হয়, ২০১৫ সালের সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (আরএসটিপি) অনুযায়ী, ঢাকায় দৈনিক প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ ট্রিপ হয়। একজন মানুষ কোনও একটি বাহনে উঠে নির্ধারিত গন্তব্যে নামলে একটি যাত্রা বা ট্রিপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বর্তমানে যানজটে দৈনিক ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে।

২০১৬ সালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের ‘নগর পরিস্থিতি-২০১৬: ঢাকা মহানগরে যানজট, শাসন ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিত’ শীর্ষক এক গবেষণায় বলা হয়েছিল, যানজটের আর্থিক ক্ষতির পরিমাপে ২৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার দৈর্ঘের এয়ারপোর্ট-পোস্তগোলা রুটকে নমুনা হিসেবে নেওয়া হয়। দেখা গেছে, ব্যস্ত সময়ে (পিক আওয়ার) এ রুটে গাড়ির গতিসীমা থাকে ঘণ্টায় ৯ কিলোমিটার। এই ধীরগতির কারণে প্রতিবার যাতায়াতে একজন যাত্রীর যে সময় নষ্ট হয়, যার আর্থিক পরিমাণ দিনে আনুমানিক ৫৩ টাকা। এ ছাড়া যানজটে নষ্ট হওয়া সময়ের আর্থিক মূল্য ও জ্বালানি খরচ সার্বিকভাবে মাসে ২২৭ কোটি টাকা দাঁড়ায় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

এই প্রতিবেদন অনুসারে, ২০০৪ সালে ঢাকার রাস্তায় প্রতি ঘণ্টায় গাড়ির গতিসীমা গড়ে ছিল ২১ দশমিক ২ কিলোমিটার। ২০০৯ সালে তা ঘণ্টায় ৬ দশমিক ৮ কিলোমিটারে এসে দাঁড়িয়েছে। যানবাহনের পরিমাণ যদি একই হারে বাড়তে থাকে এবং তা নিরসনের কোনও উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তাহলে ২০২৫ সালে এই শহরে যানবাহনের গতি হবে ঘণ্টায় চার কিলোমিটার, যা মানুষের হাঁটার গতির চেয়ে কম।

যানজট (ফাইল ছবি)

যানজটে মেজাজ খিটখিটে হয়

গবেষকদের মতে, যানজটের  কারণে ৯ ধরনের মানসিক আচরণকে প্রভাবিত করে। যানজটে বসে থাকলে মানসিক চাপ তৈরি হয়। নানান রকম দুশ্চিন্তা ভর করে। এই মানসিক চাপ সব ধরনের রোগের উৎস। চাপের ফলে নাগরিকদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, যার ফলে অনেকে আক্রমণাত্মকও হয়ে ওঠেন। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘যানজট না থাকলে মানুষ একটি পরিষ্কার পরিবেশের মধ্যে থাকতো, অল্প সময়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে পারতো। তার সময় বাঁচতো এবং পরিবারকে সময় দিতে পারতো। এখন তো সেটা পারছে না। যার ফলে স্ট্রেস বাড়ছে মানুষের। স্ট্রেস বাড়লে অস্থিরতা বাড়তে পারে, তা থেকে হতাশাও বাড়তে পারে। ফলে জীবনমান কমে যাবে। একজন মানুষের তো বিশ্রামের প্রয়োজন হয় কাজের পর। সেই সময় পাচ্ছে না, পরিবারকে সময় দিতে পারছে না। যে পথ ১৫ মিনিটে যাওয়া যায় সেখানে যদি এক থেকে দেড় ঘণ্টা লাগে, তাহলে মানুষ কীভাবে কী করবে।

/এপিএইচ/এনএইচ/  
সম্পর্কিত
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
বহুতল ভবনের সংজ্ঞাফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে কবে সমন্বয় করবে রাজউক?
সর্বশেষ খবর
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
ইউক্রেনের শান্তি পরিকল্পনা অর্থহীন: ল্যাভরভ
ইউক্রেনের শান্তি পরিকল্পনা অর্থহীন: ল্যাভরভ
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়