X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

ই-কমার্স প্রতারণা থামানোর উপায়

আনিস আলমগীর
০৭ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৫:১১আপডেট : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৭:৫৫

আনিস আলমগীর গ্রাহকদের টাকা মেরে বিদেশে চলে যাওয়ার সময় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে অনুপ্রবেশের অভিযোগে গত ৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ ঢাকার বনানী থানার পরিদর্শক শেখ মো. সোহেল রানা গ্রেফতার হয়েছে।

বাংলাদেশের পুলিশ বলছে তারা রানাকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। তাকে চাকরি থেকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে আটকের পরে।

এই সোহেল রানার একটি অডিও প্রচার করেছে বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশন। টুঙ্গিপাড়ার লোক আর তার নামের আগে শেখ আছে বলে কেউ তাকে কিছু করতে পারবে না– এই দাম্ভিকতা শোনাচ্ছিল এক গ্রাহককে। দাম্ভিকতা যে তার ভুয়া ছিল সেটা দেশ থেকে পালানোর চেষ্টাতেই প্রমাণ হয়। তার বিরুদ্ধে অনলাইন শপিং কোম্পানি ই-অরেঞ্জ সংক্রান্ত দু’টি মামলা হয়েছে। ই-অরেঞ্জের স্বত্বাধিকারী সোনিয়া মেহজাবিনের ভাই সে। পণ্য ডেলিভারি না দেওয়া এবং অগ্রিম অর্থ ফেরত না দেওয়ায় ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের ১১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দায়ের করা এক মামলায় প্রতিষ্ঠানটির মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী মাসুকুর রহমান এখন কারাগারে।

ই-অরেঞ্জ নতুন কিছু না এই দেশে। ডেসটিনি, যুবক, ইউনিপে-টু– এসব প্রতারণা প্রতিষ্ঠানের হাত ধরেই জনগণের টাকা কীভাবে আত্মসাৎ করা যায় সেই মডেল নিয়ে বাজারে এসেছে ই-ভ্যালি, ধামাকা শপিং, আদিয়ান মার্ট, আলিশা মার্ট, কিউকম, ই-অরেঞ্জ, আলাদিনের প্রদীপ, বুম বুম সিরাজগঞ্জ শপ,  থলে, জাবালি ডটকমসহ নানা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান।

একের পর এক এ ধরনের প্রতিষ্ঠান অপরাধ করেও তাদের মালিকদের সাজা না হওয়া, জেলে গিয়েও আলিশান অবস্থায় থাকায় সাধারণ মানুষের ধারণা জন্মেছে, সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মদত ছাড়া এসব প্রতারক প্রতিষ্ঠান বারবার প্রকাশ্যে এমন দুর্নীতি চালিয়ে যেতে পারে না। সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এবং মিডিয়া দুই হাতে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা কামাচ্ছে। টাকা কামায় সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার বা প্রভাবকরাও। তবে প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হওয়ার সময় হলে আস্তে করে এরা নিজেরা দূরে সরে যায়, প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক নেই বলে ঘোষণা দেয়। এতে ক্ষতি হচ্ছে যারা সৎভাবে ই-কমার্স ব্যবসা করার জন্য কোটি কোটি টাকা লগ্নি করেছেন, তাদের। ব্যয় বেড়ে গেছে বাস্তবের বড় বড় শপিং মার্টের। কারণ, তাদের নিজেদের পণ্য বিক্রির জন্য আলাদা করে ই-কমার্স সাইট চালু রাখতে হচ্ছে।

‘ই-প্রতারণা’ প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারে আসে অবিশ্বাস্য ডিসকাউন্ট দিয়ে। সাইক্লোন, ধামাকা নানা নামে ১০০ টাকার জিনিস তারা কীভাবে ৭০ টাকা বা ৫০ টাকায় দিচ্ছে, সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো তাদের তখন প্রশ্ন করেনি? ভেন্ডর বা পণ্যের কোম্পানি প্রশ্ন করেনি তার জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের পণ্য কী করে অবিশ্বাস্য মূল্যে ই-কমার্স শপগুলো গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করছে? তারা তখন শুধু নিজেদের লাভটাই দেখেছে, যেহেতু তারা আসল বিক্রি মূল্য পাচ্ছে। আস্থার সম্পর্ক তৈরি করে ই-শপগুলো তাদের থেকে কোটি কোটি টাকার পণ্য বকেয়ায় কিনেছে। ‘হায় হায় কোম্পানি’ হওয়ার পর ভেন্ডররাও এখন বকেয়া উদ্ধারে হায় হায় করছে।

সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর পাশাপাশি গ্রাহকদের সঙ্গে ই-কমার্স শপগুলোকে প্রতারণায় সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আমি ভেন্ডরদেরও সমানভাবে দায়ী করি। তারা এর মাধ্যমে তাদের ডিলার, খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। তার নিজের ব্র্যান্ডের প্রতি অবিচার করেছে। যে পণ্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান থেকে ৫০ টাকায় কেনা যায় সেটা তার শোরুম থেকে গ্রাহক ১০০ টাকায় কিনবে কেন! লোভ করতে গিয়ে ব্যবসায় পুরো চেইনকে ধ্বংস করেছে এসব পণ্য মালিকরা।

এত সব কাণ্ডের পর ই-ভ্যালিসহ অনলাইন শপিং মাধ্যমগুলোর ই-শপিংয়ের কোনও প্রকার নীতিমালা আছে কিনা সেটা এখন একটি বিরাট প্রশ্ন। গ্রাহক থেকে টাকা নিয়ে তিন থেকে ছয় মাস পর পণ্য ডেলিভারি দেওয়া বা কোনও কোনও ক্ষেত্রে না দেওয়া, বা কাউকে কাউকে লাভসহ টাকা ফেরত দেওয়ার এই অদ্ভুত বাণিজ্য পৃথিবীর অন্য কোনও দেশে আছে কিনা আমার জানা নেই।

উন্নত বিশ্বে সব সময়ই পণ্যের দাম আগে দিতে হয়, সরবরাহ পরে। কিন্তু অনলাইন শপিংয়ে ফ্রিজ, টেলিভিশন, গাড়ির মতো বড় আইটেম হয়তো পাঁচ-দশ দিন লাগতে পারে, যদি সেগুলো তাদের স্টকে থাকে। কিন্তু ইভ্যালিসহ এসব ই-শপিংয়ের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে তাদের স্টক বলতে বড় ধরনের কিছু নেই, তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ‘ছবি বিক্রি’ করছে। তা দেখিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে পুরো মূল্য নিয়ে তারপর বাজার থেকে সামগ্রী সংগ্রহ করছে, যেটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এবং এই ঝুঁকিতে পড়ে গ্রাহকরা এখন হায় হায় করছে।

এরা কম দামে পণ্য ডেলিভারি দেওয়ার নাম করে জনগণকে লোভে ফেলে একটা বড় মাপের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। নতুন নতুন লোক থেকে এরা টাকা নিয়ে আগের লোককে পণ্য বা লাভসহ টাকা ফেরত দিচ্ছে। এই চক্রবৃত্ত-খেলায় দেখা যাচ্ছে বাজারে তাদের কাছে পণ্য পাওয়ার লোক বেড়ে গেছে এবং নতুন করে টাকা দেওয়ার লোক কমে গেছে।

প্রশ্ন আসে ই-কমার্স বলতে সরকারের খাতায় কী আছে? দেখা যাচ্ছে খাতায় কিছুই নেই। কারণ, ই-কমার্সের জন্য ব্যাংক ঋণ দেয় না, জয়েন্ট স্টকে ই-কমার্সের নিবন্ধন নেই, বাণিজ্যিকভাবে এটা স্বীকৃত নয় বলে ট্রেড লাইসেন্সে ই-কমার্স লেখা যায় না। এসব প্রতিষ্ঠান বাজারে আসার আগে কোনও গাইড লাইন ছিল না বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। বরং গ্রাহক এবং ভেন্ডরদের থেকে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে গা-ঢাকা অথবা হায় হায় কোম্পানিতে পরিণত হওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কিছু নিয়ম-কানুন চালু করছে তাদের জন্য।

বাস্তবে এসব প্রতিষ্ঠান ব্যবসার উদ্দেশ্যে মাঠে আসেনি। তারা এসেছে মার্কেট থেকে টাকা তুলতে। কারণ এই মডেলের বিজনেস পৃথিবীর কোথাও সম্ভব না। একপর্যায়ে এসে এরা ধরা খেতে বাধ্য। সরকারের দরকার ছিল এদের ঋণের পরিমাণ আরও কম থাকতেই লাগাম টেনে ধরা। তাহলে নিরীহ কিছু মানুষ আজ বেকায়দায় পড়তো না।

সরকার ই-ভ্যালির ক্ষেত্রে লাগাম টানার উদ্যোগ নিয়েছিল এটা সত্য। ই-ভ্যালির চেয়ারম্যান ও এমডির ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছিল ২০২০ সালের আগস্ট মাসে। কিন্তু মাস না যেতেই তাদের আবার কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তার মাধ্যমে অনেক লোকের বিশ্বাস জমে যে ই-ভ্যালি ভালো প্রতিষ্ঠান না হলে সরকার ছেড়ে দেবে কেন! ফলে আরও অধিক সংখ্যক লোক সেখানে আরও বেশি পরিমাণ টাকা লগ্নি করে। আরও অনেক ই-কোম্পানি ই-ভ্যালি স্টাইলে লুটপাটে এগিয়ে আসে। কারা ই-ভ্যালিকে ধরে আবার ছেড়েছে, তাদেরও বিচারের আওতায় আনা দরকার এখন।

এখন প্রশ্ন আসে জনগণের বা ই-বাজারগুলোর যেসব গ্রাহক প্রতারিত হয়েছেন তাদের দোষ কোথায়? তাদের দোষ অবশ্যই আছে। একশ টাকার পণ্য আপনাকে ৫০ টাকায় এরা কীভাবে দিচ্ছে তার তো হিসাব নেবেন। হ্যাঁ, স্বীকার করি দেশে কর্মসংস্থানের অভাবে অনেকে আপনারা এই কাজে এসেছেন। কিন্তু আপনি কি ব্যবসায়ী যে একসঙ্গে অনেক মোটরসাইকেল, টিভি, ফ্রিজ বা অন্যান্য পণ্য কিনে ব্যবসা করবেন? ব্যবসার কী বোঝেন আপনি, নিজের টাকা, হাওলাতি টাকা এখানে খাটাবেন? আপনি ব্যবসায়ী হলে রাতারাতি টাকা দ্বিগুণ করা সুযোগ খুঁজতেন না। আপনাকে বলা হয়েছে লুঙ্গি দিলে তুমি প্যান্ট পাবে। সেই লোভে আপনি একের পর এক লুঙ্গি দিয়ে যাচ্ছেন, তাহলে এখন বস্ত্রহীন হওয়ার অবস্থা তো আপনারই হবে। এর জন্য অন্যকে দোষ না দিয়ে নিজেকে দোষ দেন।

যাই হোক, কোনও ব্যবসা লাটে উঠুক সেটা কেউ চাইবে না, বিশেষ করে যেখানে হাজার হাজার মানুষের টাকা এবং জীবিকা জড়িত আছে। তাহলে ই-ভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকাসহ গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণায় জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে টাকা উদ্ধারের কি উপায় আছে? তাদের চাঙা করা যায় কীভাবে? আপনারা বলবেন সময় দেওয়া হোক। সময় দিলে প্রতারক কোথা থেকে টাকা আনবে? আরেকজনের সঙ্গে একই প্রতারণা করে! ই-ভ্যালি তো ছয় মাস সময় চেয়ে তিন মাস পার করে ফেলেছে। কিছু কি পরিবর্তন দেখছেন কেউ।

আমার চোখে এর কোনও সমাধান নেই। যে টাকা তারা ব্যবসা থেকে সরিয়ে ফেলেছে, বিদেশে পাচার করেছে এবং যৎসামান্য দু’চারজনকে লসে পণ্য দিয়ে শত শত নতুন মক্কেল সংগ্রহ করেছে- সে টাকা তাদের থেকে সংগ্রহ করা ছাড়া কোনও উপায় নেই। এই মডেলে ব্যবসা করে গ্রাহক এবং ভেন্ডরদের দেনা তাদের পক্ষে ইহজনমেও শোধ করা সম্ভব না। তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে যেটুকু পাওয়া যায়, পিটিয়ে উদ্ধার করা যায়– সেটুকুই ভরসা। তাদের উপযুক্ত সাজা দিতে হবে। ছাড় দিলে নতুন নতুন কোম্পানি গজাবে, ডেসটিনির রফিকুল আমিনের মতো জেলে বসে জুম মিটিংয়ে নতুন প্রতারণার ফাঁদ খুঁজবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ