শত বছরের ঐতিহ্যের প্রতীক ট্রাম। অন্তত ভারতের কলকাতা শহরের বেলায় এমনটা বলাই যায়। ১৮৭৩ সাল থেকেই এই পরিবহন ব্যবস্থার সাক্ষী কলকাতা। প্রথম দিকে ঘোড়ার সাহায্যে এটি চালানো হলেও ১৯০২ সালে এশিয়ার প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রাম পরিবহন ব্যবস্থা চালু হয় শহরটিতে। এতো বছর পর আজ আধুনিক মেট্রো রেলের যুগে কী হাল শতবর্ষী ট্রামের?
কলেজ স্ট্রিট বরাবর ঝাঁকুনি দিয়ে, কয়েক ডজন বইয়ের স্টল পেরিয়ে বেলের অদ্ভুত আওয়াজে নিজের উপস্থিতির জানান দেয় ট্রাম। খোলা জানালা আর প্রাচীন সিলিং ফ্যানের মৃদু বাতাস যেন গ্রীষ্মের আর্দ্রতাটুকু দূরে সরিয়ে দেয়।
বাইরের বাতাসের মৃদু ঝাপটা, ফুটপাতে তাজা মাছের গন্ধ আর মসজিদে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে আজান! গাড়িতে বসেই এসব উপভোগ করেন যাত্রীরা। কখনও বা ঐতিহ্যবাহী কোনও ভবনের পাশ দিয়ে ভ্রমণের সময় ইতিহাসে ডুব দেন যাত্রীরা।
দুই বন্ধুকে নিয়ে একটি ট্রামে উঠেছিলেন মেডিক্যাল শিক্ষার্থী মেঘা রায়। তার ভাষায়, ‘আপনি এখানে কলকাতার যাবতীয় স্বাদ পাবেন। ফলে এটি ভ্রমণের জন্য সেরা উপায়।’
তিন বন্ধু স্বতস্ফূর্তভাবে ট্রামে উঠে পড়েছিলেন। এটি কোথায় যাচ্ছে কিংবা কখন গন্তব্যে পৌঁছাবে সেটি নিয়ে খুব একটা মাথাব্যাথা নেই তাদের। ট্রামে ঘুরছেন; এটিই তাদের কাছে এক দুর্দান্ত বিষয়। শিক্ষার্থী মেঘা রায়ের ভাষায়, ‘এটা রূপকথার মতো।’
মেঘা রায়ের কাছে রূপকথা হলেও বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। মেট্রো রেল চালুর পর থেকেই জৌলুস হারাতে শুরু করে ট্রাম। এখন কোনও রকমে নিজের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে এটি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর কর্তৃপক্ষের অবহেলায় কলকাতা শহরের ট্রাম ব্যবস্থা যেন পরিণত হয়েছে এক নস্টালজিয়ায়।
কর্তৃপক্ষ বলছে, ট্রামগুলো ট্রানজিট মিশ্রণের একটি অংশ হওয়া উচিত। আর ১৫ মিলিয়ন মানুষের শহরে বাস ও মেট্রো ব্যবস্থা অপেক্ষাকৃত ভালো সেবা দিচ্ছে।
কলকাতাকে বিশ্বের অন্যতম জনবহুল শহরে পরিণত করার ক্ষেত্রে যে ট্রামের অবদান ছিল সেটি নিজেই আজ রুগ্ন। অরন্দ দাস গুপ্ত নামের একজন ট্রাম নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ফিরে যান তার শৈশবে। তিনি বলেন, ‘ট্রামওয়ের শহরেই আমরা বেড়ে উঠেছি। এটা কলকাতার ঐতিহ্য।’ জানালেন, তার দাদার বইয়ের দোকানের পাশ দিয়েই ছিল ট্রামওয়ে। সেদিনের কথা এখনও স্পষ্ট মনে করতে পারেন তিনি।
নানা কারণে ইদানিং ট্রাম মলিন হতে চললেও এর ঐতিহ্য রক্ষায় কাজ করে চলেছেন কয়েকজন প্রতিশ্রুতিশীল যাত্রী। সান ডিয়াগো থেকে শুরু করে হংকং পর্যন্ত বিভিন্ন শহরের দিকে ইঙ্গিত করে তারা বলছেন, দুনিয়াজুড়ে হালকা রেলকে নতুন করে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। আর দূষণ এবং জনাকীর্ণতার সঙ্গে লড়াই করা কলকাতার মতো একটি শহরে শতবর্ষী পুরনো এই পরিবহন ব্যবস্থার গুরুত্বের বিষয়টি সহজেই বোধগম্য।
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের এই যুগে ওভারহেড বৈদ্যুতিক লাইন দ্বারা চালিত নির্গমনমুক্ত ট্রাম ডিজেল-জ্বালানি চালিত বাস ও ব্যক্তিগত গাড়ির চেয়ে একটি ভালো বিকল্প।
কলকাতা ট্রাম ইউজার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দেবাশীষ ভট্টাচার্য বলেন, ‘বৈজ্ঞানিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে, পরিবেশগতভাবে ট্রামওয়েকে বাসের রাস্তায় পরিণত করার কোনও কারণ নেই।’
কলকাতার বহু ল্যান্ডমার্ক; সিনেমা হল, বইয়ের দোকান থেকে শুরু করে জাদুঘর কিংবা হাসপাতাল; এমন অনেক কিছু নির্মিত হয়েছিল ট্রাম চলাচলের রাস্তাকে ঘিরে। এসব স্থাপনার একটি ১৮৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত দাস গুপ্ত বুকস।
দোকানের চতুর্থ প্রজন্মের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অরন্দ দাস গুপ্ত ট্রামযাত্রাকে একটি চমৎকার জার্নি হিসেবে উল্লেখ করেন। তবে তার মতে, এতে অনেক বেশি সময় লাগে। আর আজকাল মানুষ দ্রুত চলাচল করতে চায়।