X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

৭২ কোটি টাকার সেতুর নিচ দিয়ে চলবে না নৌযান

তৌহিদ জামান, যশোর
০৯ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৫:২৭আপডেট : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৫:৩৪

যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের ঝিকরগাছায় ৭২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ব্যয়ে কপোতাক্ষ নদের ওপর নির্মাণাধীন সেতু নিয়ে বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, বর্ষা মৌসুমে ব্রিজের নিচ দিয়ে লঞ্চ বা বড় নৌকা যেতে পারবে না। অন্যদিকে, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) দাবি, অভ্যন্তরীণ জলপথ ও তীরভূমিতে স্থাপনা নির্মাণ নীতিমালা অনুসরণ না করেই সেতুটি নির্মাণ করা হচ্ছে। অভিযোগ আছে, সেতু নির্মাণে বিআইডব্লিউটিএ’র ছাড়পত্রও নেওয়া হয়নি।

ঝিকরগাছা বাজারের গা ঘেঁষে এই সেতুটির অবস্থান। দেশের অন্যতম প্রধান স্থলবন্দর বেনাপোলের সঙ্গে এই সেতু সংযোগ করে দিয়েছে দেশের অন্য জেলাগুলোকে।

সূত্র জানায়, জাপানের সাহায্য সংস্থা জাইকার অর্থায়নে সেতু নির্মাণের কাজ চলছে। এজন্য সেতু ও সংযোগ সড়ক নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ৭২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। এছাড়া, নদের দুই পাড়ে ৯২ কোটি ৭৪ লাখ টাকা ব্যয়ে দুই দশমিক ৪ একর জমি ইতোমধ্যে অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ঢাকাভিত্তিক যৌথ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মনিকো-ডিএনকো সেতু ও সংযোগ সড়ক নির্মাণ করছে। ২০১৯ সালের ১ জুলাই কাজ শুরু হয়েছে এবং ২০২২ সালের ৩১ মে কাজ শেষ হবে। 

সূত্র আরও জানায়, পুরোনো সেতুর দৈর্ঘ্য ছিল ১১৫ মিটার, প্রস্থ ৬ দশমিক ২১ মিটার এবং উচ্চতা ৬ দশমিক ১০ মিটার। নতুন সেতুর দৈর্ঘ্য ১২০ মিটার, প্রস্থ ১১ দশমিক ০৫ মিটার এবং উচ্চতা ৬ দশমিক ৩৪ মিটার। অর্থাৎ পুরোনো সেতুর চেয়ে নতুন সেতুর উচ্চতা শূন্য দশমিক ৩৩ মিটার (প্রায় ১০ ইঞ্চি) বেশি।

কপোতাক্ষ পাড়ের বাসিন্দা ঝিকরগাছা মহিলা কলেজের উপাধ্যক্ষ মো. ইলিয়াস উদ্দীন বলেন, ‘যশোরবাসীর প্রাণের দাবি ছিল পুরোনো ব্রিজ ভেঙে নতুন ব্রিজ তৈরি করার। তবে নির্মাণকাজে নিয়মনীতি মানা হচ্ছে না। আমরা শুনেছি, ১৮ বছরের পানির গড় উচ্চতার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিজের গার্ডারের উচ্চতা নির্ধারণ করা হয়। সেইক্ষেত্রে কপোতাক্ষে ব্রিজ নির্মাণে পানি থেকে সেতুর গার্ডারের উচ্চতা প্রায় ২৫ ফুট হওয়ার কথা। কিন্তু নতুন ব্রিজে এই উচ্চতা মাত্র ১৫ ফুট তিন ইঞ্চি। এতে করে বড় নৌ যান চলাচল মোটেও সম্ভব নয়।’

৭২ কোটি টাকার সেতুর নিচ দিয়ে চলবে না নৌযান সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, নদের ওপর নির্মিত পুরোনা সেতুটি ভেঙে সেখানে নতুন সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। নতুন সেতুর দুটি অংশ। একটি অংশ নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। সেতুর অপর অংশ নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে।

এদিকে নতুন সেতুতে ত্রুটি রয়েছে বলে দাবি করেছে বিআইডব্লিউটিএ। সংস্থাটি বলছে, অভ্যন্তরীণ জলপথ ও তীরভূমিতে স্থাপনাদি নির্মাণ নীতিমালা অনুসরণ না করে সেতুটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে পানি বৃদ্ধি পেলে সেতুর নিচ দিয়ে নৌ যান চলাচল করতে পারবে না। এ অবস্থায় সেতুর দ্বিতীয় অংশ নির্মাণের ক্ষেত্রে বুঝে-শুনে ছাড়পত্র (উলম্ব ও আনুভূমিক) দিতে বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের (বাংলাদেশ) প্রকল্প পরিচালককে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

অভ্যন্তরীণ জলপথ ও তীরভূমিতে স্থাপনাদি নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০১০ অনুযায়ী দেশে চার শ্রেণির জলপথ রয়েছে। প্রথম শ্রেণির জলপথে সারাবছর সর্বনিম্ন ৩ দশমিক ৬ থেকে ৩ দশমিক ৯ মিটার, দ্বিতীয় শ্রেণির জলপথে সারাবছর সর্বনিম্ন ২ দশমিক ১ থেকে ২ দশমিক ৪ মিটার, তৃতীয় শ্রেণির জলপথে সারাবছর সর্বনিম্ন ১ দশমিক ৫ থেকে ১ দশমিক ৮ মিটার এবং চতুর্থ শ্রেণির জলপথে শুষ্ক মৌসুমে ১ দশমিক ৫ মিটারেরও কম পানির গভীরতা বিদ্যমান থাকে। 

বিধিমালায় বলা হয়েছে, কোনও নির্মাণ প্রতিষ্ঠানকে অভ্যন্তরীণ জলপথ ও তার তীরভূমির ওপর স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে উলম্ব ও আনুভূমিক ছাড়পত্র গ্রহণ করতে হবে। নিরাপদ এবং সুষ্ঠুভাবে নৌ যান চলাচল নিশ্চিতে প্রথম শ্রেণির জলপথের ক্ষেত্রে উলম্ব ছাড়ের পরিমাপ হবে ন্যূনতম ১৮ দশমিক ৩ মিটার এবং আনুভূমিক ছাড়ের পরিমাপ হবে ন্যুনতম ৭৬ দশমিক ২২ মিটার। দ্বিতীয় শ্রেণির জলপথের ক্ষেত্রে উলম্ব ছাড়ের পরিমাপ হবে ন্যূনতম ১২ দশমিক ২ মিটার এবং আনুভূমিক ছাড়ের পরিমাপ হবে ন্যূনতম ৭৬ দশমিক ২২ মিটার। তৃতীয় শ্রেণির জলপথের ক্ষেত্রে উলম্ব ছাড়ের পরিমাপ হবে ন্যূনতম ৭ দশমিক ৬২ মিটার এবং আনুভূমিক ছাড়ের পরিমাপ হবে ন্যুনতম ৩০ দশমিক ৪৮ মিটার। চতুর্থ শ্রেণির জলপথের ক্ষেত্রে উলম্ব ছাড়ের পরিমাপ হবে ন্যূনতম ৫ মিটার এবং আনুভূমিক ছাড়ের পরিমাপ হবে ন্যূনতম ২০ মিটার।

বিআইডব্লিউটিএ খুলনার পশ্চিম ব-দ্বীপ শাখার যুগ্ম পরিচালক (নৌ- সংরক্ষণ ও পরিচালন) আশরাফ হোসেন গত ১ আগস্ট ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের (বাংলাদেশ) প্রকল্প পরিচালককে এ বিষয়ে চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ঝিকরগাছায় কপোতাক্ষ নদের ওপর সেতু নির্মাণে বিআইডব্লিউটিএ’র ছাড়পত্র নেওয়া হয়নি। বর্তমানে নদটিতে পানির স্তর সম্পূর্ণরূপে বাড়েনি। তবুও পানির নিম্নস্তর থেকে সেতুর গার্ডারের নিচ পর্যন্ত ১৫ ফুট ৩ ইঞ্চি উচ্চতা পাওয়া গেছে, যা চতুর্থ শ্রেণির জলপথের আওতায় পড়েনি।

 বিআইডব্লিউটিএ’র ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের আওতায় ৫৩টি নদী রয়েছে। এর মধ্যে কপোতাক্ষ নদও রয়েছে। সেতুর উচ্চতা কম হওয়ায় পানি বৃদ্ধি হলে ছোট ও মাঝারি আকারের নৌ-যান চলাচল বাধাগ্রস্ত হবে। সেতুটির দ্বিতীয় অংশ নির্মাণের ক্ষেত্রে নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্স নিতে চিঠিতে বলা হয়েছে।

বিআইডব্লিউটিএ কর্মকর্তা আশরাফ হোসেন বলেন, নদ-নদীর সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্স (উলম্ব ও আনুভূমিক) নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু ঝিকরগাছায় কপোতাক্ষ নদের ওপর সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে তা নেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে আমরা ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের (বাংলাদেশ) প্রকল্প পরিচালককে চিঠি দিয়েছি। বিষয়টি তদন্তে দ্রুত একটি তদন্ত টিম গঠন করা হবে। তদন্ত টিম সরেজমিন তদন্ত করে প্রতিবেদন দেবে। এরপর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে।
  
ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের (বাংলাদেশ) সূত্র জানায়, নতুন ৬-লেনের সেতুটির দুটি অংশ। প্রথম অংশে ৩-লেন এবং দ্বিতীয় অংশে ৩-লেন। সেতুর প্রথম অংশ নির্মাণের কাজ সম্প্রতি শেষ হয়েছে। যানবাহন ও লোকজন চলাচলের জন্য সেতুর ওই অংশ খুলে দেওয়া হয়েছে। সেতুর অপর অংশ নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়েছে।

ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের প্রকল্প পরিচালক শ্যামল কুমার ভট্টাচার্য্য বলেন, কপোতাক্ষ নদের ওপর যে সেতুটি নির্মাণ হচ্ছে তার দুটি অংশ হবে। নীতিমালা অনুসরণ করে সেতুটির প্রথম অংশের নির্মাণ কাজ করা হয়েছে। দ্বিতীয় অংশের নির্মাণ কাজও শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রে ছাড়পত্র নেওয়ার দরকার হয়নি। তার দাবি নদটি চতুর্থ জলপথের আওতায় পড়ে না।

তিনি আরও দাবি করেন, নতুন সেতুর উচ্চতা পুরোনো সেতুটির চেয়ে বেশি। সেতুটি আরও ৫ ফুট উঁচু করা যেতো। তাতে আরও বেশি জায়গা লাগতো। এতে পাশের দোকানপাট নিচে পড়ে যেতো। ঝিকরগাছা পুরো বাজার উচ্ছেদ হয়ে যেতো।
  
উত্তর দিক থেকে আসা কপোতাক্ষ নদ ঝিকরগাছা বাজারের কাছে বাঁক নিয়ে দক্ষিণমুখি হয়েছে। নদের ওপর আড়াআড়িভাবে পূর্ব থেকে পশ্চিমে নির্মাণ করা হচ্ছে সেতু। উত্তর পাশে সেতুর একটি অংশের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। সেতুটিতে তিনটি স্প্যান রয়েছে। সেতুর দুই পাশে দুটি এবং মাঝে দুটি-এই মোট চারটি পিলার রয়েছে। সেতুটির দক্ষিণ পাশে অপর অংশের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে।


এদিকে, নতুন সেতুকে ত্রুটিপূর্ণ ও নির্মাণে সরকারি নিয়মনীতির লঙ্ঘন করা হয়েছে দাবি করে এটি পুনর্নির্মাণের দাবি জানিয়েছে কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলন কমিটি। গত ১৯ আগস্ট তারা সেতুর উপরে মানববন্ধন ও সমাবেশ করে।

কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলনের উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, কপোতাক্ষ নদ খনন শুরু হয়েছে। এছাড়া দর্শনায় ভৈরবের সঙ্গে মাথাভাঙ্গার সংযোগ দেওয়া হলে কপোতাক্ষের গভীরতা বাড়বে। এতে সেতুর নিচ দিয়ে নদে কোনও নৌ যান চলাচল করতে পারবে না।

তিনি বলেন, সেতু নির্মাণে যে নীতিমালা রয়েছে, সেটি মেনেই সেতু করতে হবে। সরকারের সিদ্ধান্ত সরকারের আরেকটি পক্ষ বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে লঙ্ঘন করেছে।

দ্বিতীয় সেতুর নকশা পরিবর্তন করে বিআইডব্লিউটিএ’র নীতিমালা অনুসরণ করে সেতুটি করার দাবি জানান তিনি। 

 

/টিটি/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক