X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

শেকড়ে ও সত্তায় শাহাবুদ্দিন

সিলভিয়া নাজনীন
১১ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৫:৩৫আপডেট : ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৬:১৩

শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ ১৯৫০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস নরসিংদী জেলায় হলেও জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকাতেই। জীবনের ধাপে ধাপে শিল্পী নিজেকে নির্মাণ করেছেন প্রতিকূল অবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে, শিল্পকে নিয়ে গেছেন অনন্য এক উচ্চতায়। কখনো দেশের প্রয়োজনে নিজেকে নির্ভীক যোদ্ধা হিসেবে প্রমাণ করা হোক আবার কখনো-বা শিল্পের অর্জন দিয়ে বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দেওয়া হোক, এর সবটাই তিনি করেছেন দেশাত্মবোধ থেকে, দেশ ও শিল্পের প্রতি দায় থেকে। 
          শিল্পী শাহাবুদ্দিন সম্পর্কে যেকোনো আলাপে অবধারিতভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে বাঙালির গৌরবগাথাঁ মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট। একজন শিল্পী, যোদ্ধা এবং শিল্পকর্মের বিষয়—একাকার হয়ে যাওয়া; একটি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জনের প্রতীকে রূপান্তরিত হওয়া, ব্যক্তি মানুষের জন্য এ প্রায় অসম্ভব এক অর্জন। শিল্পী শাহাবুদ্দিনের ক্ষেত্রে এই ঘটনা বাস্তবতায় রূপ নিয়েছে। ইতিহাসের বাঁক বদলের সময় হয়তো সময়ের নিজস্ব প্রয়োজনেই এমন কিংবদন্তির জন্ম হয়। তা না হলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমাদের প্রধান শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি ক্রিয়াশীল থাকার পরেও শিল্পীদের মধ্যে থেকে শাহাবুদ্দিনের মতো আর তেমন কাউকে কেন পাওয়া গেল না! মুক্তিযুদ্ধের ছবি অনেকেই হয়তো এঁকেছেন, যুদ্ধের নানাবিধ প্রেক্ষাপটকে বিভিন্নভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন আমাদের অনেক শিল্পী, কিন্তু শাহাবুদ্দিনের ছবি, শিল্পী স্বয়ং আর মুক্তিযুদ্ধ যেমন করে পরস্পরের ভেতরে বিলীন হয়ে যায় তেমন করে আর কিছুই হয়নি। 
          মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও কুতার্কিকের অভাব হয় না, বাঙালির এই অর্জনকে মৃত ইতিহাস আখ্যা দিয়ে সামনের দিকে চোখ ফেরানোর তথাকথিত প্রগতিশীলতা বাঙালিকে শুধু বিভ্রান্ত করার ক্ষমতাই রাখে। তবে ভবিষ্যৎকে অতীতের ভিত্তির ওপরেই দাঁড়াতে হয়। গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের বাইরে গিয়ে নতুন নতুন ডিসকোর্স তৈরি করা যায়, কিন্তু সেই ক্রিয়েটিভ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সন্দেহ পোষণ করা সাধারণ দায়িত্বশীলতার অংশ। কারণ সময়ের প্রয়োজনে গড়ে ওঠা এক মনোভঙ্গি, সেই সময়ের তারুণ্যের মধ্যকার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া—বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করাই বরং দায়িত্বশীলতার আচরণ। ব্যতিক্রমের নামে আলাদা হওয়ার উদগ্র বাসনায় অথবা কোনো পরিকল্পিত বিতর্ক তৈরির মাধ্যমে দৃষ্টি আকর্ষণের মোহে পাশ্চাত্যের কিছু বাতিল থিওরি ব্যবহারকারীর সংখ্যাও বাড়ছে প্রতিনিয়ত। বাঙালির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জনকে বিতর্কিত করার প্রচেষ্টা এখন অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে জোড়ালো। 
          কিন্তু শিল্পী শাহাবুদ্দিনের কাজের আলোচনায় সাব-টেক্সট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অবশ্যই এর ইমপ্যাক্টকে বিবেচনায় নিতে হবে। তার কাজ শুধু গতির ক্ষিপ্রতা নয় অথবা শুধু মুক্তিযুদ্ধও নয়; শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ক্ষুধাপীড়িত মানুষ যখন সুলতানের ক্যানভাসে দৃঢ় পদক্ষেপে উঠে দাঁড়াল সেখান থেকেই শাহাবুদ্দিন তাদের দিয়ে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ফেললেন। আরাধ্য মুক্তিকে অপ্রতিরোধ্য গতির সাথে মিলিয়ে দিয়ে তিনি গোটা মানুষকেই শক্তিতে রূপান্তরিত করলেন। 
          শাহাবুদ্দিন শিল্পী নন, তিনি আমাদের চেতনার জড়তাকে কাটিয়ে তোলার মন্ত্র পড়তে থাকা নিবেদিত প্রাণ ওঝা, আমরা একদল বিবশ বাঙালি কুঁড়েমির গালি খেতে খেতে যখন সত্যিই অথর্ব হয়ে যাচ্ছিলাম তখন অসাধারণ ক্ষিপ্রতায় আমাদের শূন্যে ছুড়ে দিলেন তিনি; বর্শার ফলার মতো ধারাল দেহে আমরা ফিরে পেলাম ঝকঝকে আত্মার উদ্ভাসিত সম্ভাবনা। হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো-তাম্রলিপি মহাস্থানগড়-উয়ারি-বটেশ্বর-ভিতরগড়ের সুসভ্য মানুষ যেন দলে দলে উঠে এসেছে শাহাবুদ্দিনের ক্যানভাসে। এখানে বাঙালির চিরন্তন সাদাসিধে চেহারাটি সময়ের প্রয়োজনে আমূল বদলে যাওয়া। মালকোচা দেওয়া লুঙ্গি পরা উদোম শরীরে এদেশের চিরায়ত মানুষগুলো মুহূর্তেই ভয়ংকর চিতার মতো ফুঁসে উঠতে পারে। মাৎসন্যায়-কৈবর্ত বিদ্রোহ-ফকির সন্ন্যাসী-সিপাহী বিদ্রোহ-সাঁওতাল তেভাগা-তিতুমীরের অজস্র উদাহরণ ছড়িয়ে আছে বাংলার আনাচে কানাচে। এদের প্রত্যেকেই শাহাবুদ্দিনের ক্যানভাসে ক্ষিপ্র-যুদ্ধ-তীব্রগতির পুঞ্জীভূত প্রতীকে রূপান্তরিত হয়েছে। এদের সাধারণ নাম মুক্তিযোদ্ধা। যারা সর্বশেষ ১৯৭১ সালে বর্বর পাক বাহিনীকে চূড়ান্ত পরাজয় বরণে বাধ্য করেছিল।
          শাহাবুদ্দিন আহমেদের পেইন্টিং মুক্তিযুদ্ধে সঞ্চয় করা সেই অদম্য শক্তিকে শিল্পী শাহাবুদ্দিন ঢেলে দেন তার ক্যানভাসে, ফুটিয়ে তোলেন বীরত্ব, মানব ইতিহাসের সাহসনামা। স্বাধীনতা পদক, নাইট (ফ্রান্সের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক) সহ আরো অনেক দেশি বিদেশি কিংবা আন্তর্জাতিক পদক প্রাপ্ত এই শিল্পী কাজ করে চলছেন নিজের আপোষহীন বিবেকের সাথে। সমসাময়িক গৎবাঁধা নিয়মে যখন শিল্পীর দম বন্ধ হয়ে পড়ে, তখনই তিনি খুঁজে পান নিজস্বত্তাকে, নিজের শেকড়কে। বলিষ্ঠ তুলির আঁচড়ে—করে যাচ্ছেন সেটাকে সংজ্ঞায়িত। প্রতিবারই সেটা হাজির হয়েছে আরো স্পষ্ট আর শক্তিশালী রূপে। এ যেন নিজেই নিজেকে ছাপিয়ে যাবার যুদ্ধ, নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বি। তার তুলিতে ধরা দেয় সময়, দায়িত্ববোধের গতি কিংবা প্রকৃতির অনন্য উদাহরণ মানুষ। প্রতিকৃতিতে এ পর্যন্ত তার ক্যানভাসে ভেসে উঠেছে বঙ্গবন্ধু থেকে শুরু করে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মহাত্মা গান্ধী কিংবা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো শক্তিশালী চরিত্র, যেগুলো তার ক্যানভাসে প্রতিবারই ফিরে এসেছে পূর্ব অপেক্ষা আরো বেশি শক্তিশালী বক্তব্য নিয়ে। যদিও একটি প্রশ্ন থেকেই যায় তিনি এই একই বিষয়বস্তুর মধ্যে কতটা একঘেঁয়ে হয়ে উঠেছেন! এর উত্তরের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আরো কিছু দশক। তবে সম্ভবত তিনি রচনা করে চলেছেন বাংলাদেশের সবচেয়ে গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের এক সুদীর্ঘ উপন্যাসের এক একটি বিরচিত অধ্যায়। সুতরাং, কাজের পারম্পর্য রক্ষার দায় এখানে রয়েছে।                 
          বাংলাদেশের শিল্পচর্চার ইতিহাস খুব দীর্ঘ নয়, এই পঞ্চাশ বছরের মধ্যে আমাদের জাতীয় জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের শিল্পভাষায় এই ঘটনার প্রবল উপস্থিতি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে অনাদিকাল পর্যন্ত বলে যাবে মুক্তিযুদ্ধের শিল্পিত ইতিহাস। শিল্পী শাহাবুদ্দিনের দীর্ঘ কয়েক দশকের প্রবাস জীবন তার শিল্পকর্মে বাঙালির সংগ্রামী ইতিহাস থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারেনি। তিনি স্বাধীন বাংলার জন্ম স্লোগান ‘জয়বাংলা’র মন্ত্রে উজ্জীবিত বাঙালি, শক্তির ধারক হয়ে শিল্পকর্মে উপস্থাপন করে চলেছেন বীরগাঁথা। পাশ্চাত্যের প্রেক্ষিতে আধুনিকতা শিল্পী শাহাবুদ্দিনের মনে আঁচড় কাটতে পারেনি। ক্যানভাসে তার ব্রাশের শক্তিশালী আঁচড় ক্ষিপ্র গতি আর রঙের ঔজ্জ্বল্য অবয়বধর্মী আর ফিগারেটিভ নিরীক্ষায় ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। বলিষ্ঠ পদচিহ্ন, উত্তোলিত দৃঢ় বাহু, বিজয়ের পতাকা হাতে ছুটে চলা অনেক সময় বিমূর্ততার প্রতিভাস নির্মাণ করে। অভিজ্ঞতার এক দুর্লভ সময়কে তিনি আমাদের সামনে বিবৃত করে চলেছেন। সময়কে বেঁধে চলেছেন শক্তির সাথে, যেখানে পূর্ণতা পায় বোধ ও বুদ্ধির স্বাধীনতা।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের বিক্ষোভ
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের বিক্ষোভ
কুমিল্লা মেডিক্যাল সেন্টার হাসপাতালকে ২ লাখ টাকা জরিমানা
কুমিল্লা মেডিক্যাল সেন্টার হাসপাতালকে ২ লাখ টাকা জরিমানা
ফটোকপি দোকানের কর্মচারী, জেলে, রাজমিস্ত্রি তৈরি করতো জাল টাকা
ফটোকপি দোকানের কর্মচারী, জেলে, রাজমিস্ত্রি তৈরি করতো জাল টাকা
রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর নিরাপত্তা জোরদার করছে কিয়েভ
রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর নিরাপত্তা জোরদার করছে কিয়েভ
সর্বাধিক পঠিত
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের