X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

বিষয়টি ‘কথার কথা’ নয়

রেজানুর রহমান
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৮:৩৪আপডেট : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৮:৩৪

রেজানুর রহমান আমার আজকের লেখাটা একটু অন্যরকম। সবার পছন্দ নাও হতে পারে। কারণ, সংস্কৃতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা আমরা অনেকেই পছন্দ করি না। গানবাজনা, নাটক, চলচ্চিত্র, শিল্পকলা এসব নিয়ে কথা বলার কী কোনও মানে হয়? শুধু শুধু সময় নষ্ট। যারা এমনটা ভাবেন, আমার ধারণা তারা একটু স্বার্থপর। একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, দেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সংস্কৃতি কর্মীরাই ছিল প্রথম সারির সৈনিক। যেকোনও সংকটকালেই তাদের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু প্রয়োজন শেষ, আর সংস্কৃতি কর্মীদের কথা মনে থাকে না।

এই করোনাকালের কথাই ধরি। গত দেড় বছর অন্যান্য সেক্টরের মতো দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনও ঝিমিয়ে ছিল। সিনেমা হল বন্ধ, নাটকের মঞ্চায়ন বন্ধ। সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলেছে। সবার একটাই প্রত্যাশা ছিল, নিশ্চয়ই আবার সবকিছু স্বাভাবিক হবে। আবার জমবে মেলা, বটতলা হাটখোলায়। আশার কথা, করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় দেশের সবকিছুই এখন স্বাভাবিক গতিতে চলমান হওয়ার চেষ্টা করছে। তবে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অবস্থা খুবই করুণ। দীর্ঘ দেড় বছরের বিরতি দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে এতটাই কাহিল করে তুলেছে যে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা ছাড়া পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়। একটা ছোট্ট উদাহরণ দেই। খেয়াল করলেই দেখবেন, রাজনৈতিক, সামাজিক, এমনকি পারিবারিক অনুষ্ঠানেও আমরা শিল্পীদের ডেকে আনি। নাচ গান, বিশেষ করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছাড়া কোনও কিছুই জমে না। সে কারণে যেকোনও আয়োজনের আগে শিল্পীরা হয়ে ওঠেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর কারও কারও কাছে আদরের শিল্পীরাই হয়ে ওঠেন অনেক ঝামেলার। ‘আরে ভাই এত টাকা টাকা করেন কেন? টাকা দিবো না এ কথা বলেছি নাকি? চিন্তা করবেন না। কাল, পরশু টাকা পেয়ে যাবেন...’।

এখন প্রশ্ন হলো শিল্পীদের কি সংসার নেই? তাদের কি খেতে হয় না? তাদের কি বাড়ি ভাড়া দিতে হয় না? এই করোনাকালে নাটক, সিনেমা ও সংগীতাঙ্গনের মানুষরাই সীমাহীন বিপাকে পড়েছে। আয় রোজগারের পথ বন্ধ থাকায় বাধ্য হয়ে ভিন্ন পেশা বেছে নিয়েছেন অনেকে। একটাই আশা ছিল, করোনার সংক্রমণ কমে গেলে নিশ্চয়ই সবকিছু আবার স্বাভাবিক হবে। রাষ্ট্র নিশ্চয়ই শিল্পীদের পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু তার তো কোনও লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। নাটকের মঞ্চ খুলে গেছে। সিনেমা হল খুলে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা কি জানি এই সেক্টরের মানুষগুলো কতটা আর্থিক বিপদে আছেন? সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানগুলোর কথাই বলি। গত দেড় বছরে অনেকে ভাড়া দিতে না পারায় অফিস ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। ফলে নাটকের সেট, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সরঞ্জামাদি, যেমন- হারমোনিয়াম, তবলা ইত্যাদি নষ্ট হয়ে গেছে। আর্থিক সংকটে আবার ঘুরে দাঁড়াবার শক্তি পাচ্ছে না অনেক সাংস্কৃতিক ও নাট্য সংগঠন। তাই দাবি উঠেছে আর্থিক প্রণোদনার। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ৩টি মিলনায়তন ঢাকার নাট্যকর্মীদের অনেক আস্থার জায়গা। কর্তৃপক্ষ মিলনায়তনগুলো খুলে দিয়েছেন। কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে অনেক সংগঠনের পক্ষে এখন  নিয়মিত নাটক করা সম্ভব হবে না। এটাই চরম বাস্তবতা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মঞ্চপাড়ায় হল ভাড়া মওকুফ অথবা বিশেষ প্রণোদনার দাবি উঠেছে। দেশের শীর্ষ সারির দুটি নাট্য সংগঠন যথাক্রমে ঢাকা থিয়েটার ও আরণ্যক সাফ জানিয়ে দিয়েছে, হল ভাড়া মওকুফ অথবা বিশেষ প্রণোদনা না পেলে তারা বরাদ্দপ্রাপ্ত তারিখে মঞ্চ নাটক করবে না!

ঢাকা থিয়েটার-এর প্রধান নাসির উদ্দিন ইউসুফ বলেছেন, ঢাকাস্থ শিল্পকলা একাডেমি ও সারাদেশে শিল্পকলা একাডেমির হল ভাড়া মওকুফ করা ও সব সাংস্কৃতিক সংগঠনকে করোনা প্রণোদনা না দেওয়ার প্রতিবাদে আমরা ১৭ সেপ্টেম্বর শিল্পকলায় নাটক করবো না। তিনি আরও বলেছেন, করোনা মহামারির কারণে দেশের প্রায় সব সাংস্কৃতিক সংগঠনই আর্থিক সংকটে পড়েছে। এ ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।

শিক্ষার পরেই আমরা সংস্কৃতির কথা বলি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ক্ষেত্রে আমরা যে ধরনের আন্তরিকতা দেখিয়েছি, তার ছিটেফোঁটাও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে না। যদিও শিক্ষার সঙ্গে সংস্কৃতির এমন তুলনা করা ঠিক হয়। কিন্তু শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতিরও উন্নয়ন তো জরুরি। অনেকেই হয়তো ব্যাপারটা খেয়াল করছেন না। অথবা খেয়াল করলেও দেখেও না দেখার ভান করে এড়িয়ে যাচ্ছেন। সমস্যা বাড়িয়ে তুলেছে আকাশ সংস্কৃতি। মোবাইল ফোন সংস্কৃতির আগ্রাসন ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আকাশ সংস্কৃতিই ভেসে আসছে মোবাইল ফোনে। আমাদের ভালো সিনেমা নেই, সাংস্কৃতিক চর্চা নেই, মঞ্চ নাটক নেই। ফলে প্রায় প্রতিটি পরিবারে আকাশ সংস্কৃতিই প্রভাব ফেলছে। আমাদের তরুণ প্রজন্ম ভিনদেশের তারকাদের যেভাবে চিনে নিজ দেশের তারকাদের সেভাবে চিনে না! তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দেশের চেয়ে বিদেশি সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ দিনে দিনে বাড়ছে। এমন একটা নাজুক পরিস্থিতিতে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বলিষ্ঠ ভূমিকা দরকার। কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? কথায় আছে, অভাব দেখা দিলে গভীর প্রেমও দরজা-জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়। করোনা দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে মারাত্মক আর্থিক সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। কাজেই আর্থিক প্রণোদনা ছাড়া বোধকরি সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে জাগিয়ে তোলা যাবে না। এটা ‘কথার কথা’ এমন বিষয় না। জরুরি ভেবে দেখার বিষয়।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক: আনন্দ আলো।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মানবিকতায়ও নজির স্থাপন করেছে পুলিশ: ডিএমপি কমিশনার
মানবিকতায়ও নজির স্থাপন করেছে পুলিশ: ডিএমপি কমিশনার
চাই সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার বাজেট
চাই সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার বাজেট
লিঙ্গবৈচিত্র্য ও পুরুষতন্ত্রের মেনে নেওয়া-না নেওয়া
লিঙ্গবৈচিত্র্য ও পুরুষতন্ত্রের মেনে নেওয়া-না নেওয়া
তীব্র গরমে কৃষিশ্রমিকের সংকট চরমে
তীব্র গরমে কৃষিশ্রমিকের সংকট চরমে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ