এহসান গ্রুপের এমডি রাগীব আহসানকে গ্রেফতারের পর বেরিয়ে আসছে তাদের নানা ধরনের প্রতারণার খবর। গ্রুপে বেশি লাভের আশায় বিনিয়োগ করে অনেক গ্রাহক আজ পথে বসেছে। অনেকেই পাওনা টাকা চাইতে গিয়ে হয়েছেন মারধরের শিকার। মানুষের ডিম ও মুরগি বিক্রির জমানো টাকাও আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে এহসান গ্রুপের বিরুদ্ধে।
পরকালে মুক্তির দোহাই দিয়ে গ্রাহক সংগ্রহ করতো এহসান গ্রুপ
এহসান গ্রুপের প্রতারণা শিকার শিক্ষক মো. ইয়াহিয়া ওরফে রাব্বী। তার বাড়ি পিরোজপুর পৌরসভার ছোট খলিশাখালী এলাকায়। রাব্বী জানান, ২০১২ সাল থেকে এহসানের বিভিন্ন প্রকল্পে (মাসিক সঞ্চয়, বাৎসরিক সঞ্চয়, এককালীন সঞ্চয়) পাঁচ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন তিনি। মেয়াদ শেষে লভ্যাংশসহ টাকা চাইতে গিয়ে কপালে মার জুটেছে তার। মার খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়ে এখন তিনি কিছুটা সুস্থ। তবে শরীরে এখনও মারের ধকল রয়েছে। ইমামতি, প্রাইভেট পড়ানো ও মাদ্রাসায় ব্যাচ পড়িয়ে যা আয় হয়েছে তা থেকে জমিয়ে তিনি এহসান গ্রুপে বিনিয়োগ করেন। এখন সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন রাব্বী।
ভুক্তভোগী মাদ্রাসা শিক্ষক আরও বলেন, আমি মাদ্রাসায় অধ্যয়নরত অবস্থায় প্রাইভেট পড়িয়েছি, পিরোজপুর শহরতলির কুমারখালী মসজিদে ইমামতি করেছি। এরপর আমি পড়াশোনা শেষ করে সদর উপজেলার চলপুখরিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেছি। এসব থেকে আমি সব মিলিয়ে প্রতিমাসে ১০-১৫ হাজার আবার কখনও ১৭ হাজার টাকার মতো পেতাম। সেসব টাকা থেকে জমিয়ে আমি এহসানে রেখেছি।
রাব্বী বলেন, এহসানের এমডি রাগীব আহসান ও তার শ্বশুর পিরোজপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা শাহ আলম আমাদের বলেছেন, এহসানে বিনিয়োগ শরিয়া সম্মত। এখানে সুদের কোনও কারবার নেই। আমি তাদের কথা বিশ্বাস করে এহসানে বিনিয়োগ করেছি। আমার কথামতো খলিশাখালী এলাকার মানিক নামে এক পানের বরজ ব্যবসায়ী দেড় লাখ টাকা রেখেছেন। বাৎসরিক প্রকল্পে ২৫ হাজার টাকা রেখেছিলাম, তা থেকে শুধু প্রতিমাসে ৫০৬ টাকা করে পেয়েছি। কষ্টের টাকা এহসানে রেখে আজ আমি প্রতারিত। আমাকে মারও খেতে হয়েছে রাগীব ও তার ভাইদের হাতে।
রাগীবের কথার যাদুতে এহসানে জড়িয়ে নিঃস্ব শিক্ষক
এহসানের প্রতারণার বিষয়ে শিক্ষক রাব্বী বলেন, জমা রাখা টাকার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর করোনার প্রথম ঢেউয়ের আগে থেকে আমি জমানো টাকার লভ্যাংশ ফেরত চাই। এরপর তারা টালবাহানা করতে থাকে। আমি আমার টাকার জন্য এহসানের নির্ধারিত ফরম ১০০ টাকা দিয়ে নিয়ে আবেদন করলে তিন মাস পর যেতে বলে। আমি তিন মাস পরে গেলে আবার নতুন করে আবেদন করতে বলে। যতবার আমি টাকার জন্য আবেদন করেছি ততবারই ফরমের জন্য নতুন করে টাকা দিতে হয়েছে। কিন্তু এহসানে আমার জমা রাখা টাকা আর পাইনি।
টাকা চেয়ে নির্যাতনের শিকার হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, গেলো ৭ সেপ্টেম্বর এহসান এমডি রাগীব আহসান আমাকে ফোন করে বলেন, আসো তোমার টাকা দেওয়ার বিষয়ে কথা আছে। আমি যখন খলিশাখালী মাদ্রাসায় পড়েছি রাগীব আহসান তখন সেখানকার শিক্ষক। আমি সরল বিশ্বাসে সেদিন দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে নূর-ই মদিনার গেটে গিয়ে রাগীব আহসানকে মোবাইলে মেসেজ পাঠাই। তাতে লিখি স্যার আজকে টাকা দেবেন, না হলে চলে যাই। একটু পর দারোয়ান কবির গেট খুলে দেয়। আমি গেটের ভেতরে গেলে রাগীব আহসান আমাকে একটা গালি দিয়ে বলে, ওরে ধর। তখন আমি দৌড়ে গেটের বাইরে যেতে চাইলে দারোয়ান কবির আমাকে ধরে ফেলে। পরে রাগীব ও দারোয়ান কবির মিলে আমাকে বেদম মারধর করে।
ভুক্তভোগী শিক্ষক বলেন, মার খেয়ে চিৎকার শুরু করলে আমার গলা ধরে নূর-ই মদিনা ভবনের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নেওয়ার পর রাগীব আহসানের ভাই আবুল বাসার ও শামীম এসে আমাকে কিল-ঘুসি মারতে থাকে। এতে আমি একপর্যায়ে জ্ঞান হারাই। তাদের মারধরে আমার গায়ের জামাও ছিঁড়ে যায়। পরে জ্ঞান ফিরলে আমার জামা পাল্টিয়ে অন্য এক ছাত্রের পাঞ্জাবি পরিয়ে গেটের বাইরে নিয়ে ফেলে আসে। এরপর আমি বাবাকে ফোন দিলে তিনি সেখান থেকে আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করান।
ছাত্র ধর্ষণে ইমামতি থেকে বহিষ্কার হয়ে এমএলএম শুরু রাগীবের
মারধরের বিষয়ে মামলা করবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাগীর ও তার সহযোগীরা আমাকে এ বিষয়ে বাড়াবাড়ি না করার জন্য হুমকি দিয়েছে। বর্তমানে আমি চরম নিরাপত্তাহীনতার ভুগছি।
এহসান গ্রুপে টাকা বিনিয়োগ করে প্রতারণার শিকার হয়েছেন দিনমজুর আব্দুর রাজ্জাক। পিরোজপুর শহরের পিটিআই এলাকার বাসিন্দা রাজ্জাক শ্রম আর ঘাম ঝরিয়ে আয় করা টাকা জমা রেখেছিলেন এহসান গ্রুপে। তার মায়ের ডিম ও মুরগি বিক্রির টাকাও এহসান গ্রুপ আত্মসাৎ করেছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
রাজ্জাক বলেন, এহসানের কার্যক্রম সুদমুক্ত এ কথা জেনে ৫০ হাজার টাকা রেখেছিলাম। আমার বাবাও বিভিন্ন উপায়ে ও মূল্যবান দ্রব্যাদি বিক্রি করে এক লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। পিরোজপুরে এহসানের কার্যক্রম শুরু থেকেই আমরা টাকা রেখেছিলাম।
এ সময় প্রতারণা কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন রাজ্জাক। বলেন, আমার মা রহিমা বেগম বাড়িতে দেশি মুরগি পালতেন। ডিম ও মুরগি বিক্রি করে ৫০ হাজার টাকা জমিয়েছিলেন। সেই টাকাও এহসানে জমা দেওয়া হয়। মেয়াদ শেষ হওয়ার পর সে টাকা ভাঙিয়ে আবার এককালীন পদ্ধতিতে টাকা রাখা হয়। সেই টাকাও আর ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না।
রাজ্জাকের দাবি, এহসান গ্রুপের কাছে আমাদের বর্তমান পাওনা পাঁচ লাখ টাকা। আমার বাবা, মা ও অপর দুই ভাইয়েরও টাকা জমা আছে এহসানে। টাকা ফেরত পেতে প্রশাসনের সহায়তা চান তিনি।