X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

পরীমণি, হলমার্ক ডেসটিনির মতো ঘটনা মনে প্রভাব ফেলে

ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৭:০৭আপডেট : ০৪ অক্টোবর ২০২১, ১৮:২০

ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ একজন কিশোর-কিশোরী বা তরুণের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে অনেক বিষয় নির্ভর করে। প্রথমত, তার বংশানুক্রম বা জেনেটিকস একটি গুরুত্বপূর্ণ যা মানসিক স্বাস্থ্যের জৈবিক উপাদানগুলোকে নির্ধারণ করে। এটিকে আমরা বলতে পারি সামাজিক ইকোলজিক্যাল সিস্টেমের সবচেয়ে অন্তর্গত অংশ।  মাইক্রোসিস্টেমের পরের স্তরকে বলা যায় মেসো সিস্টেম- একজন ব্যক্তির স্কুল, চারপাশ, ধর্মবিশ্বাস, নিকটতম প্রতিবেশী এই মেসোসিস্টেমের অংশ। এর পরের স্তরকে বলা হয় এক্সোসিস্টেম- পরিবারের দূরবর্তী সদস্য, অর্থনৈতিক অবস্থান, প্রচারমাধ্যম, সামাজিক ঘটনা আর দুর্ঘটনা এই মেসোসিস্টেমের অংশ। আর রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক বড় বড় পরিবর্তন, যেমন- বিশ্বযুদ্ধ, অতিমারি ইত্যাদি হচ্ছে ম্যাক্রোসিস্টেমের অংশ। অর্থাৎ একজন ব্যক্তির বেড়ে ওঠা আর তার মানসিক বিকাশের পেছনে কেবল পরিবার বা স্কুল নয়, তার চার পাশের সামগ্রিক পরিবেশ প্রভাব ফেলে।

কোনও বাবা-মা যদি মনে করেন আমার সন্তানের সামনে আমি তো কোনও নেতিবাচক কাজ করিনি, কেন তার  মানসিক স্বাস্থ্য বিপন্ন হবে? এর উত্তর হচ্ছে, পরিবারকে ছাপিয়ে চারপাশের ঘটে যাওয়া তাবৎ ঘটনা একজন শিশু বা কিশোরের ওপর প্রভাব ফেলে তার মানসিক স্বাস্থ্যকে বিপন্ন করে।

অনেক সময় বাবা-মা মনে করে থাকেন, "ও তো ছোট, এগুলোর কী বোঝে?" কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে, শিশু কিশোররা তাদের মতো করে চারপাশের ঘটে  যাওয়া ঘটনায় প্রভাবিত হয়। তাদের মানসিক স্বাস্থ্য চারপাশের ওপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়।

মার্কিন গবেষক লরেন্স কোহলবার্গ মানুষের নৈতিকতার বিকাশের পর্যায় ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনটি স্তরের বর্ণনা দেন। জন্ম থেকে প্রথম কয়েক বছর শাস্তি এড়াতে শিশুরা নিয়ম-কানুন মেনে চলে, এরপর বয়ঃসন্ধিতে সে নিজের কাজের স্বীকৃতির জন্য সামাজিক রীতিনীতির সঙ্গে একাত্ম হয়—‘ভালো ছেলে’ বা ‘ভালো মেয়ে’ অভিধায় তারা ভূষিত হতে চায়। আর নৈতিকতার বিকাশের তৃতীয় স্তর—যা শুরু হয় ১৬-১৭ বছর বয়সের দিকে। তখন সে নৈতিকতাকে নিজস্ব ধারণার জগতের সঙ্গে মিলিয়ে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা দিতে থাকে। তার ধারণার জগৎ বা জ্ঞানীয় বিকাশ যদি হয় প্রচলিত সমাজ-সংস্কৃতিপন্থী, তবে তার নৈতিকতার চর্চা হয় সমাজ অনুগামী। আর তার ধারণার জগতে যদি সে বিশ্বাস করে এই সমাজ, এই প্রচলিত রীতিনীতি ‘সঠিক নয়’, তখন সে তার চারপাশকে পরিবর্তন করতে চায়। পরিবর্তনের পন্থা হতে পারে প্রচলিত পদ্ধতিতে অথবা তার নিজস্ব বিশ্বাসের মতো করে। এই পরিবর্তনের যেকোনও পথকে সে নিজস্ব যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করে। একজন তরুণের মনোস্তত্ত্ব এখানেই অস্বাভাবিক  মোড় নেয়। প্রচলিত ধ্যান-ধারণার বাইরে তার মধ্যে জন্ম নেয় ভ্রান্ত বিশ্বাস। অস্বাভাবিক আচরণ আর বিশ্বাসকে সে নিজের বলে ভাবতে থাকে।

বয়ঃসন্ধিকাল থেকে পরিণত বয়স, যেমন ২৫-২৬ বছর পর্যন্ত একজন তরুণের মনোজগতের পরিবর্তনটি আশপাশের সবাইকে বুঝতে হবে। এই বয়সে তার মনোজগতের পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী, খেয়াল রাখতে হবে যে এই পরিবর্তন যেন ইতিবাচক দিকে হয়। নৈতিকতার বিকাশের পর্যায় ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কোহলবার্গ তিনটি স্তরের বর্ণনা দেন। জন্ম থেকে প্রথম কয়েক বছর শাস্তি এড়াতে শিশুরা নিয়ম-কানুন মেনে চলে, এরপর বয়ঃসন্ধিতে সে নিজের কাজের স্বীকৃতির জন্য সামাজিক রীতিনীতির সঙ্গে একাত্ম হয়—‘ভালো ছেলে’ বা ‘ভালো মেয়ে’ অভিধায় তারা ভূষিত হতে চায়। আর নৈতিকতার বিকাশের তৃতীয় স্তর—যা শুরু হয় ১৬-১৭ বছর বয়সের দিকে। তখন সে নৈতিকতাকে নিজস্ব ধারণার জগতের সঙ্গে মিলিয়ে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা দিতে থাকে। তার ধারণার জগৎ বা জ্ঞানীয় বিকাশ যদি হয় প্রচলিত সমাজ-সংস্কৃতিপন্থী, তবে তার নৈতিকতার চর্চা হয় সমাজ অনুগামী। আর তার ধারণার জগতে যদি সে বিশ্বাস করে এই সমাজ, এই প্রচলিত রীতিনীতি ‘সঠিক নয়’, তখন সে তার চারপাশকে পরিবর্তন করতে চায়।

পরিবর্তনের পন্থা হতে পারে প্রচলিত পদ্ধতিতে অথবা তার নিজস্ব বিশ্বাসের মতো করে। এই পরিবর্তনের যেকোনও পথকে সে নিজস্ব যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করে। প্রচলিত ধ্যান-ধারণার বাইরে তার মধ্যে জন্ম নেয় ভ্রান্ত বিশ্বাস। তখন তার মধ্যে নিজেকে শেষ করে ফেলার প্রবণতা দেখা দেয়।

বয়ঃসন্ধিকাল থেকে পরিণত বয়স, যেমন ২৫-২৬ বছর পর্যন্ত একজন তরুণের মনোজগতের এই পরিবর্তনটি আশপাশের সবাইকে বুঝতে হবে।

চারপাশের সব ধরনের ঘটনা দুর্ঘটনা, শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশে প্রভাব ফেলে। বাবা মা যদি মনে করেন আমার সন্তানের বয়স মাত্র ১৪ বছর, সে পরীমণির গ্রেফতার নিয়ে তার কিছু যায় আসে না, এটা সম্পূর্ণ ভুল। পরীমণি কে? তার গ্রেফতার ন্যায্য না অন্যায্য, তাকে বারবার রিমান্ডে নেওয়া কতটুকু যৌক্তিক সেটা নিয়ে একজন শিশু বা কিশোর তার মতো ব্যাখ্যা গ্রহণ করে।

হলমার্ক কী? ডেসটিনি কী, বা প্রশান্ত হালদার কী প্রক্রিয়ায় হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে সেগুলোও শিশু মনে প্রভাব ফেলে।  এমনকি ওসি প্রদীপের নৃশংসতা কিংবা এস আই আকবরের জিঘাংসাও তার মনোজগতকে পরিবর্তিত করে। পরীমণির গ্রেফতারের মতোই, চারপাশের সব জাতীয় আর আন্তর্জাতিক ঘটনা বা দুর্ঘটনা শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশকে প্রভাবিত করে। কখনও কখনও তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে বিপন্ন করে। এই বিপন্নতার মাত্রা যদি খুব বেশি হয় তখন কিশোর-তরুণেরা আত্ম পরিচয়ের সংকটে ভোগে, যা তাদের কখনও কখনও আত্মহত্যার দিকে ধাবিত করে। জাতীয় মানসিক  স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ২০১৮ সালের এক জাতীয় জরিপ অনুযায়ী, ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের প্রায় ৫% একবারের জন্য হলেও  আত্মহত্যা করার চিন্তা করেছেন, আর ১.৫% একবারের জন্য হলেও পরিকল্পনা বা চেষ্টা করেছেন!

মনে রাখতে হবে যেকোনও ধরনের মানসিক বিপন্নতা কিংবা আত্মহত্যা প্রবণতার পেছনে চারপাশের পরিবেশ আর ঘটনার প্রভাব রয়েছে। চারদিকের অনিয়ম আর সমস্যা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে বিপন্ন করে। তাই যে কারও আত্মহত্যার প্রবণতা বা মানসিক স্বাস্থ্যের বিপন্নতার প্রতিকার করতে হলে সবার আগে তার চারপাশকে পরিবর্তন করতে হবে।

আশপাশের নানা অনিয়ম আর অনৈতিকতাকে পরিবর্তন না করে কিশোর-তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি সম্ভব নয়। সর্বজনীন মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে রাষ্ট্রীয় আর সামাজিক কাঠামোয় পরিবর্তন প্রয়োজন।

শিশু-কিশোর  তথা আমাদের আগামী প্রজন্মের সুষম বিকাশের জন্য কেবল পারিবারিক বা প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনই যথেষ্ট নয়, রাষ্ট্রীয় নীতি আর সমাজ কাঠামোকে মানবিকীকরণ করা প্রয়োজন।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ