X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার করুণ কাহিনি: ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ (২)

মাকসুদুল হক
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৭:৫১আপডেট : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৮:০৮

মাকসুদুল হক ‘তোমার এই খেলাঘরে শিশুকাল কাটিল রে,

তোমারি ধুলামাটি অঙ্গে মাখি ধন্য জীবন মানি’– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

১. গেলো সপ্তাহের লেখায় দৃঢ় প্রত্যয়ে বলেছিলাম, বাংলাদেশ নিয়ে কোনও ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব না; ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম এই সপ্তাহে তা নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করবো। তবে, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ যখন লিখতে বসেছি, কাকতালীয়ভাবে একটা ‘ভীতিকর’ ভবিষ্যদ্বাণী ফের চোখের সামনে এসেছে।

বিশ্বব্যাংক ১৩ সেপ্টেম্বর এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলছে, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৫০-এর ভেতরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় প্রায় ২ কোটি মানুষ অভিবাসন করবে। একই সময়ে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার অর্ধেক জনগোষ্ঠী ওই একই কারণে ‘সম্ভবত’ অভিবাসন করবে।’

বাংলাদেশে সম্ভবত এই ভয়াল চিত্রের মূল কারণ বলা হচ্ছে, নদীমাতৃক দেশটি পানির স্বল্পতা বা অভাব দেখা দেবে, খাদ্যশস্য ফসলের বিনষ্ট বা ধ্বংস হবে, ভূমি হ্রাস হবে ও বঙ্গোপসাগরের পানি অধিক বৃদ্ধি পাওয়াসহ ঝড়, সাইক্লোন, সুনামি ইত্যাদির মতো চরম প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা ঘটবে।

শুধু তা-ই নয়, বলা হচ্ছে, এসব ঘটনার হটস্পট দেশগুলোকে চিহ্নিত করা যাবে ২০৩০ সালে, অর্থাৎ আগামী ৮ বছরের ভেতরে। ২০১৮ সালে বিশ্বব্যাংক বলেছিল, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বকোণে ধান চাষাবাদ করা অঞ্চলগুলো থেকে এই অভ্যন্তরীণ অভিবাসন প্রক্রিয়া সূত্রপাত হবে।

উল্লেখ্য, বহু বছর আগেই ভবিষ্যদ্বাণী দেওয়া আছে– ২০৫০ বা ২৯ বছরের ভেতরে বাংলাদেশের মাটির আয়তনের প্রায় অর্ধেক বঙ্গোপসাগরের নিচে তলিয়ে যাবে। তাই আগামী ৮ বছরে বাংলাদেশ যে জলবায়ু পরিবর্তনের হটস্পট হতে যাচ্ছে তা পশ্চিমা ‘বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ’ থেকে বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য বিশ্বাস না করা ছাড়া এই মুহূর্তে আমাদের কি কিছু করার আছে?

২. তবে আশার আলো এক জায়গায়।

বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে হাত গুটিয়ে বসে নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মতো এ নিয়ে আমাদের চলছে শক্তিশালী লবিং ও জাতিসংঘ ছাড়াও পৃথিবীর অন্যান্য ফোরামে বাংলাদেশ ও তার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সরব উপস্থিতি আমাদের প্রস্তুতি ও দাবি দাওয়া বিষয়ে কোনও রকম ছাড় দিচ্ছে না।

ভবিষ্যতের এই সম্ভাব্য বিপর্যয় রুখে দেওয়ার জন্য যত রকম দেনদরবার করা তা চালিয়ে যাচ্ছে ও বাংলাদেশ অগ্রিম ‘ক্ষতিপূরণ’ দাবি করছে। যেহেতু উন্নত প্রথমা বিশ্বের ধনী দেশগুলোর পরিবেশ সংক্রান্ত দায়িত্বহীন আচরণ, তাদের ভোগবাদী সামাজিক ব্যবস্থা ও যাচ্ছেতাই ব্যবহারের জন্য আমাদের আগামীর দিনগুলো প্রশ্নবিদ্ধ– এই ক্ষতিপূরণ দাবি করা অবশ্যই যৌক্তিক, মানবিক ও আন্তর্জাতিক আইনসম্মত।

এই বিপর্যয় মোকাবিলা করার জন্য যে পরিমাণ অর্থের জোগান প্রয়োজন, তার তুলনায় প্রাপ্ত অর্থ অপ্রতুল ও স্বল্প হলেও তা নিয়েই মাঠ পর্যায়ের কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। কিন্তু উন্নত দেশগুলোর ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রদানের প্রতিশ্রুতি এখনও সুরাহা হয়নি ও এ নিয়ে তাদের গড়িমসি খুবই লজ্জাজনক।

তবে ইতিবাচক বিষয়টা হলো, বাংলাদেশ কারও কাছে কোনও দান-খয়রাত চাচ্ছে না। আবারও বলছি–চাচ্ছে উন্নত দেশগুলোর বেপরোয়া ও প্রকৃতির প্রতি যে কেয়ারলেস এবং বিধ্বংসী আচরণ, যার বলি আমাদের মতো সমুদ্র উপকূলীয় দেশের মানুষেরা তার ন্যায্য ক্ষতিপূরণ ও সেই প্রয়াসে তার স্বচ্ছতা, বুদ্ধিমত্তাসহ বলিষ্ঠ পররাষ্ট্রনীতির ছাপ রাখে।

৩. যেহেতু বাংলাদেশ পৃথিবীর কোনও দেশ বা জাতিকে স্বেচ্ছায় বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কোনও ক্ষতিসাধন করেনি– আমাদের স্বকীয় জলবায়ু নীতি ও ভূমিকা ‘রোল মডেল’ হিসেবে সমগ্র বিশ্ব এখন সূক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে অবলোকন করছে ও তা প্রশংসিত হচ্ছে।

তবে মূল বিষয়টা হচ্ছে– যুগ যুগ ধরে ক্ষমতার দাপট, যুদ্ধ ও দাঙ্গা বাঁধিয়ে সমগ্র অনুন্নত ও দরিদ্র দেশগুলোর ওপরে ছড়ি ঘুরিয়ে দাম্ভিকতায় মাতাল উন্নত দেশগুলো আজ প্রকৃতির ভয়াল ছোবল ও প্রতিশোধের সম্মুখীন।

ধরিত্রী মাকে ‘ক্রয়’ করে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করলেও প্রকৃতিকে যে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না ও মানুষ যে ‘প্রকৃতিরই দাস’ এই সত্যের উপলব্ধিতে আজ সমগ্র বিশ্ব শঙ্কিত।

গেলো ১৮ মাসে করোনা ও কোভিড ১৯-এর ভয়াবহতায় যখন পৃথিবী হিমশিম খাচ্ছিলো, আমরা ঠিকই লক্ষ করলাম ধনী দেশগুলোর ওপরে প্রকৃতির নিদারুণ প্রতিশোধ।

সমগ্র ইউরোপসহ অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আমেরিকা, রাশিয়া, ব্রাজিলে অপ্রত্যাশিত বনঅরণ্যে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা, বন্যা, চরম তাপ উত্তাপ একদিকে, অপর দিকে শৈত্যপ্রবাহসহ লাগামহীন তুষারপাত ইত্যাদি ছাড়া  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গেলো মাসে ঘটে যাওয়া তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বিভীষিকাময় টর্নেডো ও বন্যা কি প্রমাণ করে না যে প্রকৃতিরও ধৈর্যের ও সহ্যের সীমা আছে, প্রকৃতি তার নিজের নিয়মে চলে, মানুষের নিয়মে না?

পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোর এত বুদ্ধি, এত মেধা, এত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, এত প্রযুক্তির নির্ভরতা, এত যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার, এত নিরীহ মানুষ হত্যা করার পর, তাদের এই ‘নব্য উপলব্ধি’ ও প্রকৃতির কাছে আত্মসমর্পণ সত্যি প্রমাণ করে বিশ্ব আজ এক অভূতপূর্ব অধ্যায়ে অনুপ্রবেশ করেছে, যা আমাদের পূর্বপুরুষ ও প্রজন্ম কখনোই কল্পনাও করতে পারেনি।

হিতার্থে একটি কথা পরিষ্কার– প্রকৃতি তার প্রতিশোধ অবশ্যই নেবে ও তা নিতে সে ঠিক এই মুহূর্তে বদ্ধপরিকর।

৪. প্রকৃতি প্রতিশোধ কেনই বা নেবে না, যখন পশ্চিমা বিশ্ব প্রযুক্তি দ্বারা দূরবর্তী দেশগুলোতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঘটনা, যেমন- ঘূর্ণিঝড় এমনকি ভূমিকম্প ঘটাবার ক্ষমতা রাখে? প্রকৃতিকে যে  ‘ওয়াপনাইজ’ করা হচ্ছে,  তার যথেষ্ট আলামত থাকা সত্ত্বেও, প্রকাশ্যে তা নিয়ে কোনও আলাপচারিতা নেই কেন?

কোভিড-১৯ ভাইরাস দ্বারা উন্নত দেশগুলোর সমগ্র মানবজাতির ওপরে চলমান জুলুমের প্রতিশোধ যে শুরু হয়ে গেছে তা সন্দেহাতীত। এই কথার সত্যতা পাওয়া যাবে আমার আগের অনেক লেখায়। উন্নত দেশগুলোর করোনার শুধু মৃত্যুর হার অনুন্নত দেশগুলোর সঙ্গে যদি তুলনা করা যায়– তা কি যথেষ্ট প্রমাণ নয়?

বাংলাদেশের মানুষকে খুন করে, আমাদের অর্থনীতি ও হতদরিদ্রের ভাগ্য ধ্বংস করার এই নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্রে–(করোনার শহীদদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি) আমাদের ৩০,০০০-এর কিছু বেশি মৃত্যু যে আলবৎ একটা ‘বিশ্ব রেকর্ড’ তা কি ‘থানাটোফোবিয়া’ (মৃত্যু আতঙ্কের মানসিক রোগ) ছড়ানো মিডিয়া স্বীকার করবে–তা নিয়ে দুই লাইন প্রশংসা কোথাও কি কেউ দেখেছেন, শুনেছেন?

৫. তাতে কি এ প্রমাণ হয় না যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ‘ফলো দ্য সায়েন্স’ বা বিজ্ঞানকে অনুসরণ করো প্রোপাগান্ডামূলক ভবিষ্যদ্বাণী বাংলাদেশের আপামর জনগণ প্রত্যাখ্যান কেবল করেনি, সে তা প্রতিহত করেছে তার আত্মার শক্তি দিয়ে, তার প্রকৃতি ও গরিমা সংস্কৃতি, এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ- তার মাটির খুব কাছাকাছি থেকে?

বাংলাদেশের মাটি কতটা ‘পবিত্র’ তা কি আমরা চিন্তায় রাখি?

এই মাটিতে প্রতি ৫ কিলোমিটার অন্তর অন্তর হাজারও মহামানব, আধ্যাত্মিক সাধক, পীর, গুরু, সন্ন্যাসী, আউলিয়া, কামেল, সাঁই,  ফকির, দরবেশ, ওলামায়ে একরামগণ ‘চিরজাগ্রত নিদ্রায়’ শায়িত আছেন। এই বুজুর্গরা যে আমাদের দরিদ্রের ভাগ্যের ওপর সব সময় কড়া নজর রাখছেন তা আমরা না বিশ্বাস করি, না আছে আমাদের কোনও প্রকার ভক্তি-শ্রদ্ধা।

বলুন দেখি– কোন পশ্চিমা দেশে তাদের নিজস্ব পবিত্র আত্মাগণ তাদের মাটি পবিত্র করেছেন? যা আছে অতি নগণ্য, বা নেই বলা যায়। নেই বিধায় সেই দেশগুলোতে ভারতীয় উপমহাদেশের শত শত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিবর্গ, গুরু, সুফিদের আনাগোনা।

৬. এসব কথা কেবল চিন্তার খোরাক নয়, এ বাস্তব উপলব্ধির দর্শন, যা আমাদের ‘অতি ফ্যাশনেবল’ শহুরে না রাজধানীকেন্দ্রিক মানুষের নেই কোনও জ্ঞান, নেই কোনও জানার আগ্রহ বা প্রচেষ্টা।

সব কিছুই ‘অবৈজ্ঞানিক ও কুসংস্কর’ বলে গরিমা সংস্কৃতিকে তুচ্ছ করে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিশ্বাসকে অবজ্ঞা করে, আজকের সমাজের, আজকের প্রজন্মের কৃত্রিমতায় সৃষ্ট অসংবেদনশীলতা গেলো ১৮ মাসে আমরা দুঃখভারাক্রান্ত চিত্তে নীরবে প্রত্যক্ষ করলাম।

‘মূল্যবোধের অবক্ষয়’– তা নিয়ে না হয় কিছুই বললাম না। নিজেদের জাতি, নিজের মাটি বা নিজেদের মূল্য আসলেই কী, তা যেহেতু জানা, বোঝার ইচ্ছাটুকুই নেই, মূল্যবোধের এসব ‘ফাঁকা বুলি’ আওড়ানোর কোনোই অর্থ হতে পারে না।

৭. আমি বারবার বলেছি, কোভিড-১৯ কোনও ভাইরাস নয়, এ হচ্ছে ‘মনস্তাত্ত্বিক তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’ এবং তা যে শেষ হয়ে গেছে, তা মনে করা অকালপক্বতা বা ভুল হবে না, তা হবে ক্ষমা অযোগ্য পাপ। শত্রু আমাদের সহজে ছাড়বে না এবং নতুন নতুন ‘প্যাকেজড’ মৃত্যু ও জীবন জীবিকা হারানোর আতঙ্ক ছড়িয়ে আমাদের ‘দৌড়ের ওপরে’ রাখবে।

একই ধারাবাহিকতায় বিশ্বব্যাংকের এই নতুন ভবিষ্যদ্বাণী যে সেদিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে তা বুঝতে নিঃসন্দেহে আমাদের খুব বেশি বেগ পেতে হবে না।

সব ভালোর যেমন শেষ আছে, সব খারাপেরও শেষ আছে– প্রশ্ন হচ্ছে সব সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের হাজার বছরের অধিক দুর্দিনের সমাপ্তি কি ঘটবে না?

তার নিপীড়িত, হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের কি কখনও কোনও দৃশ্যমান ও উপযুক্ত পরিবর্তন আমরা আশা করতে পারবো না?

আমাদের জীবনদশায় স্থায়ী পরিবর্তন আমরা কি দেখে যেতে পারবো, নাকি ‘দারিদ্র্য মোচন’র কথা বলার পর দরিদ্র প্রান্তিক জনগাষ্ঠীর ‘ভিক্ষার থালা’ পেটের ক্ষুধা, ও শিশুদের আর্তনাদ হয়ে থাকবে সব সময়কার জন্য জাতির ‘স্থায়ী প্রতীক’?

আমাদের ধনী গরিবের যে আকাশচুম্বী বৈসাদৃশ্য, যা দেখে আমরা বহুকাল ধরে অভ্যস্ত হয়ে গেছি- বা ‘গরিব তো না খেয়ে মরবেই’র মতো অপবিত্র উচ্চারণ, তা কি হয়ে যাবে আমাদের ‘জাতীয় মুদ্রাদোষ’?

‘সোনার বাংলা’র স্বপ্ন কি জাতীয় সংগীতের ৮ লাইন পর্যন্ত সৌজন্যমূলক সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ থাকবে, নাকি সমগ্র বাঙালি জাতি বিশেষ করে তার ৯০ ভাগ প্রান্তিক জনগোষ্ঠী আরেকবার সব অন্যায়, সব জুলুম, সব অবিচার, সব বৈষম্যের বিরুদ্ধে মাথাচাড়া দিয়ে ফের জেগে উঠবে তার ন্যায্য হিস্যা বুঝে নিতে?

যে ভবিষ্যদ্বাণী পশ্চিমা বিজ্ঞান আমাদের দিচ্ছে তার উল্লেখযোগ্য ও পরিতৃপ্তির বিষয়টা হলো, ‘যাহা কিছু ঘটিবে তা রাতারাতি ঘটিবে না’– ঘটবে ধীরে বহু ধীরে, বলা হচ্ছে ৮ থেকে ২৪ বছর সময়কাল ধরে।

তা খুবই ভালো কথা, কারণ এর উপসংহার: আজকের, এই মুহূর্তের পৃথিবীর বায়ুদূষণের মাত্রা, তা সত্য হোক আর মিথ্যাই হোক, তা নির্ণয় করেই এসব ফাজুল কথা বলা হচ্ছে।

৯. কিন্তু এমন কোনও গ্যারান্টি কি বিজ্ঞান আমাদের দিতে পারবে যে মানুষসৃষ্ট কোনও ‘আকস্মিক ঘটনা’ যেমন পারমাণবিক বোমা বা কোনও ‘অনিচ্ছাকৃত দুর্ঘটনার’, আরেকটি প্যান্ডামিক, আরেকটি ছোট মাঝারি বা বড় যুদ্ধের কারণে প্রকৃতির এই ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়া ‘ত্বরান্বিত’ হবে না?

প্রথমা বিশ্বের সব কথা, নির্দ্বিধায়, বিনা প্রশ্নে আমরা কি কারণে এতটা ‘অকুণ্ঠ ইমান’ নিয়ে বিশ্বাস করছি, যখন অতীত ও সাম্প্রতিক ইতিহাস বলছে তার কোনও কথাই বিশ্বাসযোগ্য না, এবং এই ‘নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার’-এর সবচেয়ে দুর্বিষহ অস্ত্র হলো মিথ্যা?

তাছাড়া রয়েছে মিডিয়া ও হাতের গণনায় অতি নগণ্য তথাপি তোষামোদকারী ‘চামচা শ্রেণি’র ‘ক্ষমতাবান ও প্রতিপত্তিশালী’ মানুষ ও তাদের হীন চক্রান্ত ও ব্যক্তিস্বার্থ, যে শ্রেণির বাংলাদেশেও কোনও কমতি নেই।

আমরা কি এতটাই ‘বেকুব’ যে এও জানি না সমগ্র বিশ্বের অর্ধেক সম্পদের মালিকানা মাত্র ৮ জন ব্যক্তির হাতে ন্যস্ত? তারা ট্যাক্স ফাঁকি দেয় ও দরিদ্রের মজুরি সর্বনিম্নে নামিয়ে, রক্ত চুষে মুনাফা করে ও ক্ষমতার জোর খাটিয়ে রাজনীতি, রাষ্ট্র ও সমাজকে প্রভাবিত করে– নিয়ন্ত্রণ করে?

বাংলাদেশে যাদের আমরা ‘বহুজাতিক কোম্পানি’ বলি ও তাদের গোলামি করার সুযোগ পেলে নিজেদের ধন্য মনে করে বাহবা দিতে থাকি– তারাও যে ওই একই গরিবের রক্তচোষা যন্ত্রের ‘চালিকাশক্তি’- তা কি আমরা টের পাই?

১০. দয়াল আমাদের ক্ষমা করুক– যদি আসলেই কোনও অভাবনীয় বা অকল্পনীয় ঘটনা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘটে যায়, যদি আক্ষরিক অর্থে বাংলাদেশের অর্ধেক জনগণ বুঝতে পারে তাদের ‘পায়ের নিচে মাটি নেই’ বা জল এসে তার ‘পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে’, তখন সে কি ‘ইয়া নপসি ইয়া নপসি’ জিকির করবে নাকি অন্যত্র, অন্য দেশে পালাবে?

কার সঙ্গে সে তখন যুদ্ধ করবে যখন শত্রু কোভিড-১৯-এর মতো ‘অদৃশ্য’, যখন শত্রু তার একটি মিথ্যা বাঁচিয়ে রাখার জন্য হাজারও নতুন মিথ্যা, ঘণ্টায় ঘণ্টায়, মিনিটে মিনিটে, সেকেন্ডে সেকেন্ডে আবিষ্কার করে প্রয়োগ ও নির্বিচারে ব্যবহার করবে?

আদতে আমাদের পালানোর কোনও পথ কি খোলা আছে, নাকি আমরা ‘এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি’ গাইতে গাইতে চোখ বুজে ‘না ফেরার দেশে’ গমন করবো?

১১. আপনারাই ভেবে বলুন তো– কোন পার্শ্ববর্তী ‘বন্ধুপ্রতিম’ দেশ বা রাষ্ট্র আমাদের ২ কোটি মানুষকে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য জায়গা বা কর্মসংস্থান করে দেবে, যখন সবাই নিজেদের আখের গোছানো নিয়ে থাকবে ব্যস্ত?

উদাহরণস্বরূপ– প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা এসে আমাদের সীমান্তে প্রাণ বাঁচানোর দায়ে পৌঁছানো মাত্রই আমরা দ্বার খুলে দিয়ে ‘মানবিক’ আচরণ করি।

‘ও মা গরিবের ধন যা আছে তাই দিবো চরণ তলে’– আমাদের গরিবের সীমিত সম্পদের চাপ থাকা সত্ত্বেও তাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে চলছি বছরের পর বছর।

এই মানুষগুলোকে না মিয়ানমার ফেরত নিচ্ছে, না কোনও পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র, না বিশ্বের অন্য কোনও দেশের আছে মাথা ব্যথা, না কেউ এগিয়ে আসছে তাদের অভিবাসনে সাহায্য করার জন্য।

বলা হচ্ছে, তারা মুসলিম হওয়ার কারণেই তাদের ভিটামাটি থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে, তাদের ওপরে চলেছে গণহত্যার মতো জঘন্যতম অপরাধ।

সবই সত্য, সবকিছুই মেনে নিলাম– কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ‘এক দেহ, এক মন, এক ভাগ্য’ দাবিদার বিশ্বভ্রাতৃত্ব, তথাকথিত ‘মুসলিম উম্মাহ’ আজ কোথায়?

১২. কোনও রোহিঙ্গাকে এ পর্যন্ত কি কোনও মুসলিম রাষ্ট্র নিয়ে গেছে? যখন মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশের সম্পদ, বা জমি তাদের চাহিদার অতিরিক্ত আছে, যখন তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, চাষ আবাদ থেকে শুরু করে গৃহপরিচারিকা, ড্রাইভার, মালি, দোকানপাটের সেলসম্যান পর্যন্ত সবই বিদেশি শ্রমিকদের ওপরে ৮০ ভাগ বা তার ঊর্ধ্বে নির্ভরশীল?

যখন সংযুক্ত আরব আমিরাতে ভিনদেশের অভিবাসীর সংখ্যা তার নিজস্ব নাগরিকের চেয়ে অনেক বেশি।

খুবই দুঃখজনক হলেও কথাটা সত্য; যতই আমরা ইসলাম বা মুসলিমত্ব নিয়ে বড়াই করি না কেন, অঢেল ধন সম্পদ, তেল, স্বর্ণ, হীরা, জহরত এমন কি সুলাইমান নবীর গুপ্তখনি আরব দেশে আবিষ্কার হয়েছে এ গুজব থাকলেও, অন্য মুসলিমের বিপদে এসব মুসলিম সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে, তেমনটা দেখা যায় না।

অতি সম্প্রতি ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান ইত্যাদি দেশগুলোর মুসলিম জনসাধারণ যুদ্ধ থেকে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে পায়ে হেঁটে হলেও হাজার হাজার মাইল পথ ধরে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা তার জাতশত্রু ‘ইহুদি, খ্রিষ্টান, নাসারা’র দেশ তথা ইউরোপ বা আমেরিকাতে ছুটবে। ভুলেও দেখবেন না তার পার্শ্ববর্তী কোনও মুসলিম রাষ্ট্র স্থায়ীভাবে তাদের থাকার কোনও সুবিধা করছে বা তার কষ্টের ভাগ নিচ্ছে।

গেলো মাসেই আমরা দেখলাম ১ লাখ ২০ হাজারের ও বেশি আফগান মুসলিম প্রাণ নিয়ে কাবুল থেকে ইউরোপ ও আমেরিকার বিমানে চড়ে পালিয়েছে– কোনও মুসলিম দেশে নয়।

ধর্ম আজ রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহার হচ্ছে, কিন্তু ইসলামসহ প্রতিটি ধর্ম আদতে এসেছে মানব কল্যাণের উদ্দেশ্যে।

ধর্মীয় শিক্ষা, ধর্মীয় অনুভূতি, ধর্মীয় অনুশাসন, ধর্মীয় জিহাদ, এমনকি ‘ইসলামিক রাষ্ট্র’ আমরা মুখে মুখে ঠাওরালেও ধর্মের মূল বাণী থেকে পশ্চিমা প্রহসন, উসকানি ও বেকুবির কারণে আমরা বহু দূর সরে গেছে।

আজ পশ্চিমা দেশগুলোর শক্তির মূল সম্বল ও সম্মান তার জনগণের আর্থিক সচ্ছলতা।

যদিও পবিত্র কোরআন বলছে, ‘সৃষ্টিকর্তা ব্যক্তিদারিদ্র্য বরদাশত করেন না’– এই সমমাত্রিক মূল বাণীটি মুসলিম নয়– অমুসলিম ইউরোপীয় দেশগুলো (কানাডা) কাজে লাগিয়ে - সৃষ্টি করেছে ‘সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার স্টেট’ বা সামাজিক কল্যাণ রাষ্ট্র।

প্রতিটি নাগরিকের জীবন, জীবিকা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা সুনিশ্চিত করে রাষ্ট্র। তার ওপরে আছে বেকারত্বের ভাতা।

তেমন সামাজিক কল্যাণ রাষ্ট্র কোনও মুসলিম দেশে আজ ১৫০০ বছরেও দেখা যায়নি।

মুসলিম প্রধান বাংলাদেশ কি সে রকম একটা রাষ্ট্র সৃষ্টি করে সমগ্র বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিতে পারবে না?

আমি মনে করি, সদিচ্ছা থাকলে ইনশাআল্লাহ পারবে!

(চলবে)

লেখক: সংগীত শিল্পী

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ব্যাংক ডাকাতি রোধে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে
ব্যাংক ডাকাতি রোধে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে
রাজনৈতিক সম্পর্ক জোরালো হয়েছে ঢাকা ও দোহার মধ্যে
কাতারের আমিরের সফররাজনৈতিক সম্পর্ক জোরালো হয়েছে ঢাকা ও দোহার মধ্যে
পুড়ছে সড়ক, তবু অবিরাম কাজ তাদের
পুড়ছে সড়ক, তবু অবিরাম কাজ তাদের
ঘুষ মামলায় আদালতের আদেশ লঙ্ঘন, ট্রাম্পের শাস্তি চান প্রসিকিউটররা
ঘুষ মামলায় আদালতের আদেশ লঙ্ঘন, ট্রাম্পের শাস্তি চান প্রসিকিউটররা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ