X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

বৈঠকেই ‘কাউন্সিল’ সেরে নিয়েছে বিএনপি!

সালমান তারেক শাকিল
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ২১:৫৭আপডেট : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ২২:৩৭

চলতি সেপ্টেম্বরে দুই দফায় ছয় দিনে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি। এতে দলটির নেতারা সংগঠনকে শক্তিশালী করে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি আদায়ে রাজপথে সক্রিয় হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। অনেকটা কাউন্সিলের আদলে করা এসব বৈঠক থেকে শীর্ষ নেতৃত্বও ‘পরিকল্পনা মাফিক সন্তুষ্টি’ অর্জন করেছেন। যে কারণে সময়সীমা পার হলেও আগামী নির্বাচনের আগে আর সপ্তম কাউন্সিলের পথে যাচ্ছে না বিএনপি। এর আগে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনি বৈতরণী পার হতে চায় দলটি।

প্রথম দফায় ১৪-১৬ ও দ্বিতীয় দফায় ২১-২৩ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্যদের বৈঠকে অংশগ্রহণ করা অন্তত এক ডজন নেতার সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, বৈঠকে ৪৯১ জন অংশগ্রহণকারীর মধ্যে অন্তত তিন শতাধিক নেতা বক্তব্য দেন। বক্তব্যে বিশেষভাবে শীর্ষ নেতৃত্বের সন্তুষ্টি অর্জনে নিজেদের অবস্থান ব্যক্ত করলেও খালেদা জিয়ার মুক্তি, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন আদায়, সাংগঠনিক কার্যক্রম শেষ করা, জোটভিত্তিক রাজনীতির চেয়ে যুগপৎ কর্মসূচির বিষয়গুলো উঠে এসেছে।

চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ড. ইনামুল হক চৌধুরী বলেন, ‘ছয় দিনের বৈঠক থেকে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক উভয় বিষয়েই প্রাপ্তি রয়েছে। বিএনপি দেশে গণতন্ত্র ফেরানোর কথা বলে, দলের ভেতরেও গণতন্ত্রচর্চা হচ্ছে—এ বিষয়টি সামনে এসেছে।’

মঞ্চে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা সাংগঠনিকভাবে বহুবিধ  প্রত্যাশা ও দাবি এসেছে উল্লেখ করে ইনামুল হক চৌধুরী বলেন, ‘এগুলো পরস্পরকে সংঘবদ্ধ করে সামনের দিনে স্বৈরাচারের পতন আন্দোলনে সাহায্য করবে। নেতাকর্মীরা প্রস্তুত, দলের শীর্ষ নেতৃত্ব, স্থায়ী কমিটি এখন যা সিদ্ধান্ত দেবেন, সবাই তা বাস্তবায়ন করবে।’

নির্বাহী কমিটির সদস্য, ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান বলেন, ‘সবার মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে। ভালো কিছু একটা হবে—এই আশায় মানুষের মধ্যেও আশার সঞ্চার করেছে। বৈঠকে যেসব ইতিবাচক প্রস্তাব এসেছে সেগুলো সাংগঠনিকভাবে পূরণ করা গেলে আন্দোলন কার্যকর হবে।’

জানতে চাইলে দলের স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমাদের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সুনির্দিষ্ট মতামত জেনেছি। রাজনীতি, ভবিষ্যৎ, গণতন্ত্র এবং সাম্প্রতিক পরিস্থিতি মিলিয়ে এসব মতামতে আমরা উপকৃত হয়েছি। রাজনৈতিক চিন্তা, আন্দোলন চিন্তা ও সাংগঠনিক চিন্তায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানসহ পলিসি মেকারদের সঙ্গে নির্বাহী কমিটির সমন্বয় করার খোরাক পেয়েছি।’

চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের ঘনিষ্ঠ দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, ধারাবাহিক বৈঠকগুলো যে উদ্দেশ্যেই করা হোক, আপাতত দলের অভ্যন্তরীণ দৃষ্টিতে তা সফল। বিশেষভাবে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে তারেক রহমান দায়িত্ব নেওয়ার পর নির্বাহী কমিটির নেতাদের বড় পরিসরে মতামত নিয়েছেন এই প্রথম। ফলে, দলের তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সরাসরি সবার বক্তব্য শুনেছেন তিনি। তবে জাতীয়ভাবে সফলতা পাবে কিনা, সেজন্য আরও সময় লাগবে।

বৈঠকেই কাউন্সিল সেরে নিয়েছে বিএনপি

বৈঠকে অংশ নেওয়া নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, করোনাভাইরাসের কারণে দেড় বছর সাংগঠনিক কার্যক্রম বন্ধ থাকার পর সেপ্টেম্বর থেকে নতুনভাবে কাজ শুরু করেছে বিএনপি। চলতি বছরের বাকি সময়টুকু পার করলেই আগামী বছরের শুরুতে নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাজনীতি সরগরম হবে। এই ডামাডোলের মধ্যেই আসবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যস্ততা। আর এ কারণে আর কাউন্সিলের দিকে যাওয়ার সুযোগ নেই নেতৃত্বের সামনে।

২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। ওই কাউন্সিলের পর কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির মেয়াদ শেষ হয় তিন বছর পর ২০১৯ সালের মার্চে। এরপর কাউন্সিল নিয়ে কোনও ‘রা’ করেনি বিএনপি। ২০২০ সালের শুরুতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দিলে একাধিকবার সংগঠনের কাজ স্থগিত রাখা হলেও এ বিষয়ে কোনও আলোচনাতেই যাননি দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব।

১৪ সেপ্টেম্বর বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্যরা

নির্বাহী কমিটির বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক নেতার ভাষ্য—কাউন্সিলের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় নেতৃত্বের শূন্যতা দেখা দিলে। বিএনপিতে এখন সেটা নেই। যেসব সংগঠনের মেয়াদ শেষ, যেসব পদে নিয়োগ দরকার। এগুলো দ্রুত নিষ্পন্ন করার চিন্তা বৈঠকের আলোচনায় পরিষ্কার হয়েছে। সাংগঠনিক সম্পাদকদের প্রায় প্রত্যেকেই সংগঠন গুছিয়ে কর্মসূচির দিকে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

এ বিষয়ে খন্দকার মোশাররফ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের দলের চেয়ারপারসন গৃহবন্দি, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশের বাইরে। তারা কাউন্সিলের জন্য অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের ছাড়া তো কাউন্সিল হয় না। আমাদের আলোচনায় এ বিষয়টি আসেনি।’

স্থায়ী কমিটির শূন্য পদে নিয়োগ!

স্থায়ী কমিটির ১৯ সদস্যের মধ্যে মারা গেছেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, তরিকুল ইসলাম, এম কে আনোয়ার, আ স ম হান্নান শাহ। দল ত্যাগ করেছেন মাহবুবুর রহমান। এই পাঁচটি শূন্যপদ পূরণে শীর্ষ নেতৃত্ব সহসাই সিদ্ধান্ত নেবেন, এমন আলোচনা এখন দলে আছে। এছাড়া কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বিছানায় শয্যাশায়ী। দীর্ঘদিন ভারতে বিচারাধীন অবস্থায় রয়েছেন সালাহউদ্দিন আহমেদ।

২১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠকে অংশ নেওয়া নির্বাহী কমিটির একজন সদস্য বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, কাউন্সিল না হওয়ার কারণে শূন্য পদগুলোতে পদায়ন করা হবে। আর এই শূন্য পদগুলো দলের ধারাবাহিক সভার প্রথম দিনে অংশ নেওয়া বেশ কয়েকজন নেতাকে দেওয়া হবে, এমন আলোচনা আছে। তবে স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, এটা নিয়ে মিটিংয়ে কোনও আলোচনা হয়নি।

হরতাল-অবরোধে অনীহা

ছয় দিনের ধারাবাহিক বৈঠকের পর কী সিদ্ধান্ত আসছে—এ প্রসঙ্গে বৈঠকে অংশ নেওয়া নেতারা জানান, প্রথমত এককভাবে বিএনপিকে নেতৃত্ব দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে রাজনৈতিক দাবি আদায়ের জন্য রাজপথে সক্রিয় হতে হবে। এক্ষেত্রে হরতাল-অবরোধের চেয়ে যুগপৎভাবে কর্মসূচি এগিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বৈঠকে। বিশেষ করে নির্বাচনি জোট হলেও দাবি আদায়ে একক শক্তি প্রদর্শন ও কার্যকর নেতৃত্ব দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা এখন বেশি বলে জানিয়েছেন নেতারা।

বৈঠকে অংশ নেওয়া এক নেতা বলেন, জামায়াত ছাড়তে সবক’টি বৈঠকেই দুয়েকজন প্রস্তাব করলেও অধিকাংশের মত হচ্ছে—গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে একমঞ্চে না গিয়ে যুগপৎভাবে রাজপথে থাকা নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ২০১৮ সালে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে কোনও নেতাই ইতিবাচক কিছু বলেননি, সবার কণ্ঠেই বিরোধিতা ছিল।’

 ১৫ সেপ্টেম্বর মহাসচিব, যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক ও সম্পাদক পর্যায়ের বৈঠক

বিএনপি চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইং সদস্য শায়রুল কবির জানান, দুই দফার ধারাবাহিক সভায় ৪৯১ জন সদস্য অংশ নেন। তাদের মধ্যে ৩০০ জন বক্তব্য রাখেন। বৈঠক হয়েছে প্রায় ৩৫ ঘণ্টাব্যাপী।

আরও বৈঠক করার সিদ্ধান্ত

বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাহী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে ছয় দিনের ধারাবাহিক বৈঠকের পর আরও কিছু বৈঠক করবে বিএনপি। আগামীকাল শনিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) স্থায়ী কমিটির নিয়মিত বৈঠকে এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হবে। এরপর এককভাবে দেশের মানুষের সামনে নতুন পরিবর্তনের রাজনীতির ঘোষণা আনবে বিএনপি।

একাধিক সদস্য বলছেন, কর্মসূচি প্রণয়ন ও আগামী দিনের রাজনৈতিক রোডম্যাপ বাস্তবায়নে আরও কিছু হোমওয়ার্ক বাকি রয়েছে। সেগুলো শেষ করেই পরিবর্তিত বার্তা তুলে ধরবে বিএনপি।

জানতে চাইলে স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কবে নাগাদ বিএনপির রোডম্যাপ আসবে, এটার সময় বলতে পারবো না। টানা বৈঠক হয়েছে। সবার মতামত শুনেছি। সেগুলো কম্পাইল করে স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা হবে। ফল, কী কর্মসূচি আসবে, কী দাবি-দাওয়া আসবে, তা সময়ের ব্যাপার।’

আরও পড়ুন:

দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে ‘না’: বিএনপির শীর্ষ নেতাদের ওপর ভাইস চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টাদের ক্ষোভ!

পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক: জনসম্পৃক্তদের দায়িত্বে চান বিএনপির মধ্যম সারির নেতারা

৩ দিনব্যাপী বৈঠক অনুষ্ঠিত: নেতাদের ‘চিন্তা বিনিময়’ থেকে কতটা ‘শিক্ষা’ নেবে বিএনপি?

৪২ বছরেও গঠনতন্ত্র পূর্ণাঙ্গ করতে পারেনি ছাত্রদল

নেতাদের সঙ্গে দ্বিতীয় দফার শেষ বৈঠকে বিএনপি

/এপিএইচ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৩০ মামলার বিচার শেষের অপেক্ষা
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৩০ মামলার বিচার শেষের অপেক্ষা
উপজেলা নির্বাচন: ওসির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ
উপজেলা নির্বাচন: ওসির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ
মেলায় জাদু খেলার নামে ‘অশ্লীল নৃত্য’, নারীসহ ৫ জন কারাগারে
মেলায় জাদু খেলার নামে ‘অশ্লীল নৃত্য’, নারীসহ ৫ জন কারাগারে
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা