X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

ভাই বাস চালক, একটু কল্পনা করুন

ধ্রুব নীল
১৭ জানুয়ারি ২০১৬, ১৪:২০আপডেট : ২৪ জানুয়ারি ২০১৬, ১১:৫৫

ধ্রুব নীল ও বাস চালক ভাই.. আপনি তো ঢাকায় বাস চালান অনেক দিন। আপনার রুট কোনটা? গাবতলী মিরপুর যাত্রাবাড়ী থেকে মোহাম্মদপুর শ্যামলী? মনে হয় এমনই। বাসায় বউ আছে বাচ্চা আছে। আহারে বাচ্চাটার সঙ্গে সারা দিনে একবার দেখা হয় রাতের দিকে। মেয়ে স্কুলে যায়। কী নাম? ও আমার মা লিমা, টুকটুকি জান, রূপকথার পরী, জেবু ও জেবু... ছেলে? কখনও পল্টু, কখনও মোতালেব আব্বাজান, কখনও বাপধন সজীব। নীল সাদা স্কুলড্রেস গায়ে কী সুন্দর করে স্কুলে যায় দেখো!
মেয়েটা ঢাকায় বেড়াতে এসেছে। শহরের এত এত নিয়মকানুন তার এখনও জানার কথা নয়। সে জানে না গাবতলী টু মিরপুর রুট কত প্রতিযোগিতায় থাকে। কত টেনশনে থাকা লাগে এই রুটের গাড়ি চালকদের। একটু এদিক সেদিক হলে সিরিয়াল হারাতে হয়। সিরিয়াল গেলে এক ট্রিপ কম। এত নিয়মকানুন ওই ছোট্ট মেয়েটা জানবে কোত্থেকে! এসবতো আপনি জানেন। আপনি জানেন বলে একটু টেনশনেও থাকেন। আপনার স্কুল ড্রেস পরা টুকটুকিটা আজ স্কুল থেকে ফেরার পর কোন কোন রাস্তা পার হবে? ওই রাস্তায় যদি ওভারব্রিজ না থাকে? আর ওই পথে আপনার গাবতলী রুটের কোনও সহকর্মী যদি বাস হাঁকিয়ে ছুটে আসে! সে যদি থাকে ভীষণ বেপরোয়া। তার আর কোনও কিছুর পরোয়া নেই। আছে কেবল সিরিয়াল ধরার তাড়া। একটা বাড়তি ট্রিপ বনাম আপনার মেয়ে। একটা বাড়তি ট্রিপ বনাম আপনার..। আপনার কি রাগ লাগছে খুব? হতাশ লাগছে? কষ্ট হচ্ছে? প্রেশারের সমস্যা থাকলে সেটাও মনে হয় বেড়ে গেছে।
মেয়েটার ফিরতে দেরি হচ্ছে? বান্ধবীদের সঙ্গে আবার শিশুপার্কের দিকে যায়নি তো? শাহবাগ! শিশুপার্ক থেকে বের হয়ে তো রাস্তা পার হতে হবে! এখন তো বিকেল! সিগনালে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তো তার মতো অন্য চালকরাও বিরক্ত হয়। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ‘নাম্বারের গাড়ি’র সঙ্গে পাল্লা দিতে গেলে হ্যাঁচকা টান দিতেই হয়। পড়িমড়ি করে ছুট লাগাতে হয়। মানুষজন তো জানে এই রাস্তার অবস্থা। মেয়েটাতো জানে না! আহারে নীল টুকটুকে স্কুলড্রেস পরা মেয়েটা আমার রাস্তা পার হতে তো পারে না। ও চালক ভাই... সবাই তো আপনাকে ওস্তাদ ডাকে, আর টুকটুকি ডাকে আব্বা। টুকটুকি ঠিকমতো রাস্তা পার হতে পারবে তো?
বাস চালক ভাই, আমি বলবো না যে গত ১৬ জানুয়ারি যে দুই স্কুলছাত্রী বাসচাপায় মারা গেছে তাদের জায়গায় নিজের টুকটুকিকে কল্পনা করতে। আমি জানি এটা অসম্ভব অনুরোধ হয়ে যাবে। তবু আমরা সবাই তো কল্পনা করি। যাদের ঘরে একটা করে সোনালী আর মিতু আছে, তাদের মনের কুঠুরিতে অজান্তেই ভেসে আসছে নানা ছবি, ভীতিকর ছবি, মৃত্যুর অবসাদে আচ্ছন্ন করে রাখার মতো ছবি। একা একা স্কুল ব্যাগ কাঁধে একটা কোমল মুখ রাস্তা পার হতে গিয়ে ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসছে বার বার। আর পেছনে দুদ্দাড় গতিতে ছুটে আসছে যাত্রাবাড়ী টু গাবতলী কিংবা মিরপুর। রক্তাক্ত মুখ আমরা কল্পনা করতে পারি না। চালক ভাই, আমি জানি আপনিও পারেন না। মানুষ পারে না। এই একটি কল্পনায় আমি আপনি এক।
আপনাদের মধ্যেই আছেন কেউ কেউ। তারা কল্পনা করতে পেরে শিহরিত হয়েছেন। ভুগেছেন আত্মগ্লানিতে। আর তাই ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে যশোরের চৌগাছা-মহেশপুর সড়কে একটি স্কুলশিক্ষার্থীবাহী বাস পানিতে পড়ে ৭ শিশু মারা যাওয়ার পর ঘুমাতে পারেননি ওই চালক আর হেলপার। চৌগাছা থানায় আত্মসমর্পণ করেছিলেন দুজনই।
দুর্ঘটনা তো দুর্ঘটনাই। হাজারটা কারণে ঘটতে পারে। ব্যস্ত রাস্তায় ভুল করে কেউ আচমকা গাড়ির সামনে চলে আসলেও আপনার মতো চালকদের কিছু করার থাকে না জানি। কিন্তু সিরিয়াল ধরার নেশায় দিনের পর দিন বেপরোয়া চালাতে চালাতে মনের পরিবর্তন আসে। আপনি হয়তো ভাবছেন, আপনি তো গাড়ি চালাতে বেশ পটু। অনায়াসে ডানে বামে কেটে তরতরিয়ে এগিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু এই অভ্যাসই যদি আপনার ধরন বদলে দেয়, আপনার ভেতর পুঁতে দেয় কোনও একদিন প্রাণঘাতি হওয়ার বীজ? উদাহরণ ৮ নম্বর গাড়ি। এই ৮ নম্বর যেন সাক্ষাৎ ৮ নম্বর বিপদ সংকেত। সম্ভবত এই রুটে গাড়ির সিরিয়াল ধরার তাগাদা বেশি। গতকাল পর পর দুটো মৃত্যু। এর আগেও পাল্লা দিতে গিয়ে বহু দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে যাত্রাবাড়ী-গাবতলীর ৮ নং বাস। গত বছরের ৩ জুন কারওরানবাজারে পাল্লা দিতে গিয়ে একটি বাস সড়ক বিভাজকের ওপর উঠে গিয়েছিল। মারা গিয়েছিল ১ জন, আহত ১২ জন। সবাই ওই একটি ‘বাড়তি ট্রিপে’র বলি। আমার পরিচিত এ রুটের নিয়মিত কয়েকজন যাত্রীও বলেছেন, এ বাস মানেই চাপা আতঙ্ক। যাত্রী বেশি হওয়ার কারণে বেশি বেশি ট্রিপ দিতে চায় ড্রাইভাররা। সামনের গাড়িকে পেছনে ফেলে পরের স্টপেজ ধরতে পারলেই একটু বেশি রোজগার। একটু বেশি রোজগারের নেশা = সোনালী কিংবা মিতু কিংবা আরও অনেকের লাশ।

একটু বাড়তি অর্থ, খানিকটা সময় বাঁচানো কিংবা একটুখানি অসচেতনতার জন্য কত হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে সে হিসাব এখন অনেকেই রাখে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ প্রতিবদেন-২০১৫ এর মতে গতবছর সড়ক দুর্ঘটনায় মোট নিহত হয়েছে ৮৬৪২ জন। যাদের মধ্যে ১১২২ জন ছিল শিশু আর ১০৮০ জন ছাত্র-ছাত্রী। একটা কাজ করুন, ওই বাইশশ শিশুর পিষ্ট মরদেহকে এক সারিতে কল্পনা করার চেষ্টা করুন। সারির এ মাথা থেকে ও মাথা দেখা যাচ্ছে না। দূরের কোথাও থেকে থেমে থেমে আহাজারি কানে আসছে? পাশাপাশি এটাও কি কানে বাজে- একটা বাড়তি ট্রিপ.. একটুখানি দ্রুত যাওয়া.. একটা গাড়িকে ওভারটেক...।ওই প্রতিবেদন আরও একটি তথ্য জানিয়েছিল- নিহতদের ৫২ শতাংশই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। মানে এই দুর্ঘটনায় শুধু মানুষ নয়, মারা গিয়েছিল সাড়ে চার হাজার পরিবারের স্বপ্নও।

এসব পরিসংখ্যান সম্ভবত এখন আমাদের খুব একটা নাড়া দেয় না। কিন্তু যখন শুনি কোনও শিশু রাস্তা পার হতে গিয়ে মারা গেছে, তখন আমরা বাদবাকি সব পরিসংখ্যান ভুলে যায়। আমরা আমাদের ঘরে আদরে জড়িয়ে রাখা কোমলমতি ওই সোনালী মিতুদের থেঁতলানো, চাকায় পিষ্ট মুখ কল্পনা করতে পারি না। আমাদের চোখের সামনে শুধু কিছু সংবাদ ভাসে। রাস্তা পার হতে গিয়ে সোনালী-মিতু নিহত। নরম ওই তুলতুলে শরীরটায় ঠিক কত জোরে বাসের ধাতব বাম্পারের ধাক্কাটা লেগেছিল আমরা সেটা অনুভব করতে পারি না। ওইখানে আমাদের কল্পনায় মাথার শিরা উপশিরা দপ দপ করে। চালক ভাই আপনি ব্যাপারটা টের পাচ্ছেন? আপনার কি আরও রাগ লাগছে? বাম্পারে তুলতুলে শরীরটা লাগলে কি ঠং করে শব্দ হয়? নাকি একটা কিছু লাগলো বলে মনে হয়। নাকি কিছুই মনে হয় না? ও চালক ভাই, একটু কল্পনা করার চেষ্টা করবেন নাকি। আপনার টুকটুকি, লিমা, জেবু কিংবা পরীর তুলতুলে.. না ভাই.. কল্পনা করবেন না। কল্পনা করা যায় না।

লেখক: শিশু সাহিত্যিক, সাংবাদিক।

ইমেল: [email protected]

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
দক্ষিণখানে ভবনের চার তলা থেকে পড়ে নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু
দক্ষিণখানে ভবনের চার তলা থেকে পড়ে নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু
ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল গ্র্যাজুয়েট হলেন ১৯ জ্যেষ্ঠ রাজনীতিক
ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল গ্র্যাজুয়েট হলেন ১৯ জ্যেষ্ঠ রাজনীতিক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ