X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

ক্ষোভের আগুনে পুড়ুক সব অনিয়ম

প্রভাষ আমিন
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৬:৩৮আপডেট : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ২০:১৮

প্রভাষ আমিন ঢাকায় প্রয়োজনের চেয়ে রাস্তা অনেক কম। আর সেই রাস্তায় ধারণ ক্ষমতার চেয়েও গাড়ি অনেক বেশি। তাই যানজট আমাদের নিত্যসঙ্গী। রাস্তায় নামলেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয়। অপরিসর রাস্তা, অপরিকল্পিত যান চলাচল, আর অতিরিক্ত মানুষ ও যানবাহনের চাপে ঢাকা পরিণত হয়েছে একটি স্থবির মহানগরে। বাসযোগ্যতার নানান সূচকেও ঢাকার অবস্থান তলানিতে। নানান চেষ্টা, উদ্যোগ নেওয়া হলেও পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আনা যায়নি। বাসে বাসে টক্কর আর আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় ঢাকার রাস্তায় রচিত হয়েছে অনেক বেদনার উপাখ্যান। অ্যাপভিত্তিক যান আসার পর কিছুটা শৃঙ্খলা আসার আশা করা হলেও শুরুতেই শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ না করায় পুরো সুফল পায়নি জনগণ।

ঢাকার রাস্তার এই অনিয়ন্ত্রিত যান চলাচলের সবচেয়ে বড় কারণের নাম মোটরসাইকেল। সাধারণ মানুষ মজা করে মোটরসাইকেলকে বলে রাস্তার রাজা। তাদের যেন নিয়ম-কানুন বা লেনের কোনও বালাই নেই। পুরো রাস্তাটাই যেন তাদের। যখন যেদিকে ইচ্ছা সেদিকেই চলেন তারা। ফুটপাত করা হয়েছে পথচারী চলাচলের জন্য। কিন্তু ঢাকার অধিকাংশ ফুটপাত থাকে মোটরসাইকেলের দখলে। মোটরসাইকেল ঠেকাতে ফুটপাতে রীতিমতো প্রতিবন্ধকতা বসাতে হয়েছে অনেক জায়গায়। তারপরও ঠেকানো যায় না। বাংলাদেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা কম বেশি চার লাখ। তবে ধারণা করি আরও অনেক মোটরসাইকেল চলে রাস্তায়। কারণ, নম্বর প্লেটে ‘আবেদিত’ লেখা অনেক মোটরসাইকেলও দেখি রাস্তায়। এরমধ্যে ঢাকায় কত মোটরসাইকেল চলে, সে সংখ্যাটা জানি না। কাকের সংখ্যার মতো, কম হলে বাইরে চলে গেছে, বেশি হলে বাইরে থেকে এসেছে। মোটরসাইকেলের এই অরাজকতায় নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং বাইক। এখন রাস্তার মোড়ে মোড়ে মোটরসাইকেলের জটলা। সবাই যাত্রী ধরার জন্য বসে থাকে। অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিংয়ের পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবেও অনেকে বাণিজ্যিকভাবে যাত্রী পরিবহন করেন। যদিও এর কোনও অনুমোদন নেই।

মোটরসাইকেল যদি রাস্তার রাজা হয়, তাহলে মহারাজা হলো ট্রাফিক পুলিশ। অনিয়ম দেখলেই তারা আটকায়, অনেক সময় অনিয়ম না থাকলেও আটকায়। তারপর কাগজপত্র পরীক্ষা, মামলা, জরিমানা। এই রাজা আর মহারাজাদের লড়াইয়ে চিড়েচ্যাপ্টা সাধারণ মানুষ।

যানজটের এই শহরে দ্রুত কোথাও যেতে বা একটু সস্তায় পরিবহনের জন্য অনেকেই অ্যাপভিত্তিক মোটরসাইকেল সুবিধা নেন। এই অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং ব্যবস্থা বেকার সমস্যার একটা তাৎক্ষণিক সমাধান নিয়ে এসেছে। বেকার তরুণ, ছাত্ররা কোনও রকমে একটা মোটরসাইকেল কিনে নেমে পড়েন রাস্তায়। তাতে কোনও রকমে চলে যায় দিন। আমরা শুধু আমাদের সমস্যাগুলো বড় করে দেখি। কিন্তু যারা আমাদের রাইড শেয়ারিং সেবা দিচ্ছে তাদের সুবিধা-অসুবিধাগুলো আমাদের চোখেই পড়ে না। রাইড শেয়ার এখন ঢাকার বাস্তবতা। এটাকে অস্বীকার করার বা ঠেকানোর কোনও সুযোগ নেই, উচিতও নয়। তাই রাইড শেয়ারিং ব্যবস্থাকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে হবে। তবে শৃঙ্খলার মধ্যে আনার নামে যেন আমরা তাদের শৃঙ্খলিত না করি। আগেই যেমন বলেছি, ঢাকার রাস্তার মোড়ে মোড়ে রাইড শেয়ারিংয়ের মোটরবাইকের জটলা থাকে। যেটা যানজট বাড়ায় এবং বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। তাই পুলিশ ভুল জায়গায় দাঁড়াতে দেখলেই আটক করে, মামলা দেয়। এখন ট্রাফিক আইন ভঙ্গের সাজা বেশ কঠিন। জরিমানা হয় মোটা অঙ্কের। মাসে একাধিকবার মামলা খেতে হলে সেই চালকের আর্থিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। তাদের লাভের গুড় পিঁপড়ায় খায়। তাই মামলা দেওয়ার আগে তাদের দাঁড়ানোর জন্য কিছু জায়গা ঠিক করে দিতে হবে। তারপরও কেউ নিয়ম ভাঙলে তখন মামলার বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। মোটরসাইকেল চালকদের যেমন নিয়ম-কানুন না মেনে যা ইচ্ছা তাই করার অধিকার নেই, আবার পুলিশেরও কথায় কথায় মামলা দেওয়া উচিত নয়। পেটের দায়ে রাস্তায় নামা রাইড শেয়ারিংয়ের চালকদের বিষয়টি অবশ্যই সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। ট্রাফিক পুলিশের ওপরও মামলার টার্গেট থাকে। তাই তারাও মামলা করার জন্য খুঁত খুঁজে বেড়ান। লঘু পাপে দিয়ে দেন গুরু দণ্ড।

গত আগস্ট মাসেই সারাদেশে ৮০ হাজারের ওপর মামলা হয়েছে। জরিমানা হয়েছে ২৫ কোটি টাকার ওপরে। এক মাসে রাস্তা থেকে সরকারের আয় ২৫ কোটি টাকা! কোটি টাকা দামের গাড়ি যখন নিয়ম ভেঙে চোখের সামনে দিয়ে চলে যায়, পুলিশ অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকে। আর সস্তা গাড়ি বা মোটরসাইকেলকে বেছে নেয় টার্গেট পূরণের হাতিয়ার হিসেবে। আইন হতে হবে সবার জন্য সমান।  

যেমন বলছিলাম, রাইড শেয়ারিং বেকার সমস্যার এক তাৎক্ষণিক সমাধান। তেমনই এক সমাধান বেছে নিয়েছিলেন কেরানীগঞ্জের শওকত আলী। করোনার আগে তিনি স্যানিটারি সামগ্রীর ব্যবসা করতেন। তা দিয়ে সংসার চলছিল ভালোই। কিন্তু করোনা আসায় সব তছনছ হয়ে যায়। ৯ লাখ টাকা লস দিয়ে তার পথে বসার উপক্রম হয়। তখন তিনি শেষ অবলম্বন হিসেবে একটি মোটরসাইকেল কিনে রাস্তায় নেমে পড়েন। এটাই তার সংসার চালানোর একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু অ্যাপ কোম্পানির বাড়তি কমিশন আর পুলিশের হয়রানিতে অতিষ্ঠ হয়েছিলেন।

সোমবার সকালে রাজধানীর বাড্ডা লিংক রোড এলাকায় পুলিশ তার গাড়ির কাগজপত্র নিয়ে নেয়। অনুরোধ করেও ফিরে না পেয়ে রাগের-ক্ষোভে নিজের মোটরসাইকেল আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন শওকত। একজন মানুষ কতটা ক্ষুব্ধ হলে নিজের বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বনটি পুড়িয়ে দিতে পারেন, আমরা কি সেটা একটু হৃদয় দিয় অনুভব করতে পারি। ক্ষুব্ধ শওকত আলী সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘রাইড শেয়ারিং অ্যাপগুলো প্রতি রাইডে ২৫ ভাগ টাকা কেটে নেয়। যাত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার কাজটুকু শুধু করে অ্যাপগুলো। এ জন্য তারা এই টাকা কেটে নেয়। অ্যাপে চালালে মামলা দেয় না পুলিশ, কিন্তু অ্যাপে না চালিয়ে যাত্রী বহন করলে মামলা খেতে হয়। অ্যাপের জন্য কেন আমি মামলা খাবো? আমি কি রাস্তায় চুরি করতে নেমেছি?’

শওকত আলীর এই প্রশ্নের জবাব কি দিতে পারবেন পুলিশ, অ্যাপ প্রতিষ্ঠান বা নীতিনির্ধারকরা?

শওকত আলীর এই ক্ষোভের আগুন সামনে এনেছে অনেক দিক। ক্ষোভের কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘করোনায় ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সংসার চালাতে ও পেটের দায়ে মোটরসাইকেল নিয়ে রাস্তায় নামি। কিন্তু রাইড শেয়ারিং অ্যাপের কারণে রাস্তায় প্রায় সময় মামলা খেতে হয়। দুই সপ্তাহ আগেও মামলা খেয়েছি। সারা দিন রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে যাত্রী আনা-নেওয়া করি। আর যাত্রীদের সঙ্গে শুধু যোগাযোগ করিয়ে অ্যাপগুলো নেয় ২৫ ভাগ টাকা। অ্যাপে চললে মামলা খাবো না, না চললে খাবো এ কেমন অন্যায়।'

শওকত আলী যেদিন তার মোটরবাইকটি পুড়িয়ে দেন, তার পরদিনই সারাদেশে প্রেসক্লাবের সামনে রাইড শেয়ার চালকদের বিক্ষোভ কর্মসূচি ছিল। শওকত আলীর ক্ষোভের সঙ্গে তাদের সম্মিলিত বিক্ষোভের কোনও সম্পর্ক নেই। বিষয়টি নিছকই কাকতালীয়। তবে শওকত আলীর এই আগুন দেওয়া, তাদের বিক্ষোভকে আরও যৌক্তিক করেছে এবং তাদের বঞ্চনার কথা সবার কানে পৌঁছে দিয়েছে। রাইড শেয়ারের চালকরা অ্যাপ কোম্পানির কমিশন ২৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা, পুলিশি হয়রানি বন্ধ, তাদের দাঁড়ানোর জন্য নির্ধারিত জায়গা, আগাম আয়করমুক্ত রাখা এবং শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি চেয়েছেন। শওকত আলীর মতো অনেকে আবার আগ বাড়িয়ে অ্যাপভিত্তিক সেবা তুলে দেওয়ারও দাবি করেছেন।

অ্যাপভিত্তিক সেবা তুলে দেওয়াটা কোনও সমাধান নয়। কমিশন যৌক্তিক করতে হবে, দাঁড়ানোর জায়গা দিতে হবে, হয়রানি বন্ধ করতে হবে। সব মিলিয়ে ঢাকার এই বাস্তবতাকে শৃঙ্খলায় আনতে হবে। তবে শৃঙ্খলার নামে যেন তাদের শৃঙ্খলিত করা না হয়। রাস্তায় শৃঙ্খলা আনতে আইনের কঠোর প্রয়োগ আমরাও চাই। তবে তা যেন মানবিক হয়। শওকত আলীর ক্ষোভের আগুন যেন পুড়িয়ে দেয় এই খাতের সব অনিয়ম, বঞ্চনা আর বিশৃঙ্খলা।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিন-রামাফোসার ফোনালাপ
ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিন-রামাফোসার ফোনালাপ
ভিসা-পাসপোর্ট হারিয়ে প্রবাসী অজ্ঞান, ৯৯৯-এ কলে উদ্ধার
ভিসা-পাসপোর্ট হারিয়ে প্রবাসী অজ্ঞান, ৯৯৯-এ কলে উদ্ধার
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ