X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

সাম্প্রদায়িক হামলার রাজনৈতিক-সামাজিক অর্থনীতি

জোবাইদা নাসরীন
২০ অক্টোবর ২০২১, ১৩:৫৩আপডেট : ২০ অক্টোবর ২০২১, ১৩:৫৩

জোবাইদা নাসরীন বেশ কয়েক দিন ধরেই দেশের বিভিন্ন জেলায় চলছে সাম্প্রদায়িক হামলা। প্রাণহানি ঘটেছে। এখন পর্যন্ত এই হামলার সর্বশেষ স্থান ছিল রংপুরের পীরগঞ্জ। প্রতিবছরই পূজার সময় প্রতিমা ভাংচুরের ঘটনা আমাদের অনেকটাই যেন গা সওয়া হয়ে গেছে। এগুলোকে আমরা ‘বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত  ঘটনা’ হিসেবে উপস্থাপন করে বছরের পর বছর সাম্প্রদায়িকতার চাষাবাদকে উসকে দিয়েছি, সেই দায়ভার নিতেই হবে।

বাংলাদেশের গত দশ বছরে সাম্প্রদায়িক হামলাগুলোর সূত্রপাতের অভিনব ধরন তৈরি হয়েছে। সেখানে এতদিন ধরে কেন্দ্রে ছিল ‘আজগুবি’ এবং হাওয়া থেকে আসা ফেসবুক স্ট্যাটাস, যার বেশিরভাগই ভুয়া আইডি থেকে দেওয়া; এবার সেখানে জায়গা পেয়েছে মণ্ডপে কোরআন শরিফ রেখে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা।

বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছরই এই ধরনের হামলার ঘটনা ঘটছে। এবার এই সাম্প্রদায়িক হামলার সময় হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজাকে।  এবারই সম্ভবত একসঙ্গে এত জেলায়  সাম্প্রদায়িক হামলা শুরু হয় এবং এখনও তা অব্যাহত আছে। পাঠক লক্ষ করবেন, প্রতিটি হামলার প্রেক্ষাপট কিন্তু কাছাকাছি। হয় কোনও ফেসবুক স্ট্যাটাস, নয় কোনও ধরনের সাজানো ইস্যু। এই হামলাগুলো যে পরিকল্পিত তা স্পষ্টভাবেই খালি চোখেই বোঝা যায়।

হামলার বিষয়ে আমরা অনেকটাই জেনেছি। তাই হামলা কীভাবে হচ্ছে , কোথায় কোথায় হচ্ছে, কারা কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সেসব ন্যারেটিভের চেয়ে  গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হলো, কারা, কী জন্য এই হামলাগুলো করেন বা করান? এর পছনে কী উদ্দেশ্য থাকে? একই সঙ্গে অনেক এলাকায় এই ধরনের হামলা চালানোর পেছনে আসলে কী ধরনের রাজনীতি কাজ করে সেটি দেখা প্রয়োজন।

প্রায় প্রতি বছরই ঘটে যাওয়া এবং এবারের সিরিজ হামলার কারণ বিশ্লেষণ করে আমরা গবেষণায় দেখতে পেয়েছি, এই হামলাগুলো ঝোঁকের মাথায় নিছক ঘটে যাওয়া কোনও হামলা নয়। এর পেছনে প্রথমত থাকে  জমি/ভূমি  দখলের রাজনীতি। কারণ, হামলাকারীরাও ‘সাধারণ’ কোনও মানুষ নয়, ধর্মীয় অনুভূতির  মিথ্যা 'ফানুস' উড়িয়ে সাম্প্রদায়িক হামলা চালিয়ে এদের মূল লক্ষ্য থাকে ভূমি দখলের রাজনীতি। অন্যদিকে অনেক কারণের মধ্যে আরও গুরুত্ব পাচ্ছে সামনের জাতীয় নির্বাচন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক হামলা খুব বেশি নতুন নয়। বরং নির্বাচনি সময়ের আশপাশে এবং নির্বাচনের পরেও সাম্প্রদায়িক হামলা বাংলাদেশের জন্য দগদগে দুঃসহ স্মৃতি। কিন্তু  এই সাম্প্রদায়িকতার চাষাবাদ থেমে নেই।

আরও একটি কারণ হিসেবে বর্তমান সময়ে গুরুত্ব পাচ্ছে, প্রতিবেশী ভারতে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক। এই দুটো দেশেই সংখ্যালঘু এবং সংখ্যাগুরুর সম্পর্কের টানাপড়েন মুহূর্তেই ছড়িয়ে যায় এবং সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠরা সংখ্যালঘুর ওপর হামলা চালায়। এই বিষয়টি নিয়ে আমরা ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে সতর্ক করার কথা গণমাধ্যমে জানতে পেরেছি। সুতরাং ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এবং নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভারতের সমর্থন এবং অসমর্থন সবকিছুই এর সঙ্গে যুক্ত। তাই রংপুরের পীরগঞ্জ, নোয়াখালীর চৌমুহনী, কুমিল্লাসহ আরও যেসব জেলায়  এই আক্রমণগুলো হচ্ছে সেক্ষেত্রে এটি ভাবার কোনও কারণ নেই যে এটি কয়েকজন মানুষের সাময়িক ধর্মীয় উত্তেজনার পেছনে যুগ যুগ ধরে গেড়ে থাকা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতিসহ আরও অনেক ধরনের  রাজনৈতিক অর্থনীতি জড়িত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা দেখতেই পেয়েছি যে এসব ক্ষেত্র রাষ্ট্রের নিশ্চুপতায় হামলাকারীরা প্রশ্রয় পায়। এর পাশাপাশি ধর্মকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর সুকৌশল নড়াচড়াও এই প্রশ্নকে অনেকটা এগিয়ে নেয়। এবারও আমরা দেখতে পেয়েছি হাজার হাজার লোককে আসামি করে মামলা করা হয়েছে। এসব মামলা যে আসলে কোনও কার্যকর মামলা না তা আমরা জানি। তাই প্রতিকারের পথগুলোও বন্ধ।

তবে অন্যবারের চেয়ে এবার প্রতিরোধের স্বরগুলোও ক্ষীণ। সরকারের বিরোধী দলকে দোষারোপের সুরের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের প্রতিরোধও তেমন জোরালো নয়। এই জায়গাটিই সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হয়ে হাজির হচ্ছে।

কী কী হবে এই মামলার পর? আক্রান্তদের প্রতি হয়তো আরও ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করতে থাকে, যে পর্যন্ত তারা ভূমি থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত না নেয়। অনেক সময় সেই হামলাকারীদের কাছেই নামমাত্র মূল্যে জমিটি বিক্রি করে দেন তারা। কারণ, ক্ষমতার ক্রমাগত চাপে এবং তাপে ততদিনে জেনে যায় সেখানে তারা আর থাকতে পারবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল বারাকাত (২০১৬ ) তাঁর কাজে উল্লেখ করেছেন, “আগামী ৩০ বছরে হয়তো বাংলাদেশে কোনও হিন্দু জনসংখ্যা থাকবে না।” অধ্যাপক বারাকাত তাঁর গবেষণায় দেখান,  ১৯৬৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ধর্মীয় সহিংসতার শিকার হয়ে ১ কোটি ১৩ লাখ হিন্দু বাংলাদেশে ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। পূর্বের সাম্প্রদায়িক হামলাগুলোর মিল সবচেয়ে বেশি হলো, প্রত্যেকটি হামলার পরপরই সেই এলাকা থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা চলে যায়। কখনও এলাকা ছাড়ে, আবার কখনও বা ছাড়ে দেশ। এমনকি এর আগে  ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ক্ষেত্রে সরকার যখন ঘোষণা করলেন যে যাদের ঘরবাড়ি ভেঙে দেওয়া হয়েছে, তাদের সেই ভেঙে যাওয়া ঘরবাড়ির চেয়ে ‘ভালো’ ঘরবাড়ি তাদের তৈরি করে দেওয়া হবে। তখন তাদের অনেকেই বলেছেন সেই নতুন ঘরবাড়ি তারা চান না। কারণ, এটি তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে না, তাদের যে ভয়ের স্মৃতি তা মুছে দিতে পারবে না। আরও কিছু যদি বিষয় আমরা বিশ্লেষণের উপকরণ হিসেবে আমলে নিই তাহলে দেখতে পাই যে সেখানে প্রত্যেকটি হামলাতেই নারীর প্রতি সহিংসতাও গুরুত্ব পায়। এবং এটি যখন হয় তাহলে আরও ভীত হয়ে পড়ে আক্রান্ত পরিবারগুলো। তখনই তারা দেশ কিংবা সেই এলাকা ছাড়ার কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়।

অনেকেই বলেন, হিন্দুরা তো দেশ ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু এটি বলার আগে একবার কী ভেবে দেখেন কেন সংখ্যালঘুরা দেশ ছাড়ে বা ছাড়তে বাধ্য হয়? কারণ, হামলার আগে এলাকায় সব সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে যে সুসম্পর্ক ছিল সেটি আর ফিরে আসে না। নষ্ট হয়ে যায় একে অপরের প্রতি আস্থা বা বিশ্বস্ততার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিও। এ কারণে সেই জায়গা কোনোভাবেই তাদের জন্য স্বস্তির এবং নিরাপদ হয়ে ওঠে না। তাই তারা শুধু জীবনের নিরাপত্তার জন্য  চুপি চুপি, আর কেউ কেউ রাতের অন্ধকারে দেশ ছাড়ে। সকালে ঘুম থেকে হয়তো প্রতিবেশীরা দেখতে পান সেই ঘরে কেউ নেই। আর আমরাই এই দেশটির চিত্র এমন করছি।

ধর্মকে ব্যবহার করেই রাজনীতি করছে বাংলাদেশের প্রধান দুটো রাজনৈতিক দল: আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি। তাই তারাও নিশ্চুপ থেকে এই হামলায় রাজনৈতিক আসকারা দেয় এবং এর মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িকতা আরও প্রসারিত হতে থাকে।

‘তাই ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ কিংবা ‘রাষ্ট্র সবার’ এই ধরনের কথাবার্তা আসলেই শুধু বুলি ‌এবং কতটা ফাঁপা তা প্রায় প্রতিবছরই ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক হামলাগুলো আমাদের আঙুল উঁচিয়ে দেখায়। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ‘ভুতুড়ে’ অ্যাকাউন্ট থেকে দেওয়া ফেসবুক স্ট্যাটাসের উৎস খুঁজে বেড়ানো, কিংবা গুজব চর্চায় মনোযোগী না হয়ে হামলাকারীদের পরিচয় শনাক্ত করতে আগ্রহী হোন, তাহলেই বুঝতে পারবেন, হামলার মূল জায়গা ফেসবুক স্ট্যাটাস কিংবা  গুজব নয়; এটির পেছনে রয়েছে মানুষকে ভূমি ছাড়া করা এবং সেই ভূমি দখলের ভয়াবহ পরিকল্পনা। এর পেছনের রাজনীতি সম্পর্কে বোঝাপড়াটা জরুরি এবং তাই সরকার কী করলো তার আগেই আপনার প্রতিবেশী কিংবা এলাকার কোনও মানুষ যেন এই ধরনের হামলার শিকার না হয়, সেই বিষয়ে প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ করার জন্য নিজেদের প্রস্তুতিই এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনের বিদ্যুৎ সুবিধা ক্ষতিগ্রস্ত
রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনের বিদ্যুৎ সুবিধা ক্ষতিগ্রস্ত
২৪ ঘণ্টার মধ্যে মেট্রোরেল লাইনের ওপর থেকে ক্যাবল সরানোর অনুরোধ
২৪ ঘণ্টার মধ্যে মেট্রোরেল লাইনের ওপর থেকে ক্যাবল সরানোর অনুরোধ
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে অসন্তোষ জানালেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে অসন্তোষ জানালেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী
ইতিহাস বিকৃতিতে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি আবোল-তাবোল বলছে: হাছান মাহমুদ
ইতিহাস বিকৃতিতে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি আবোল-তাবোল বলছে: হাছান মাহমুদ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ