X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

নিম্ন আয়ের মানুষকে টার্গেট করে ‘মাল্টিপারপাস প্রতারণা’

বাংলা ট্রিবিউন রিপোর্ট
২৬ অক্টোবর ২০২১, ১৬:৫৪আপডেট : ২৬ অক্টোবর ২০২১, ১৭:২১

মাসে ১ হাজার করে পাঁচ বছরে জমা হবে ৬০ হাজার টাকা, তবে মেয়াদ শেষে ফেরত দেওয়া হবে ৯০ হাজার টাকা। আর কথিত এই ডিপিএসকারী ব্যক্তিকে যিনি সংগ্রহ করে দেবেন তিনি প্রথম বছর প্রতি মাসে ২০০ টাকা এবং পরবর্তী চার বছর প্রতিমাসে ১০০ টাকা করে লভ্যাংশ পাবে। শুধু তাই নয়, কোম্পানির কোনও সদস্য কাউকে ১ লাখ টাকার ‘এফডিআর’ (এককালীন জমা) করাতে পারলে ‘টার্গেট’ সংগ্রহকারীকে মাসে ১ হাজার টাকা এবং এফডিআরকারী সদস্যকে মাসে ২ হাজার টাকা প্রদান করা হবে। রাজধানীর পল্লবীতে এমন আর্থিক প্রলোভন দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ‘কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।

প্রতিষ্ঠানটির  প্রকল্প পরিচালক শাকিল আহম্মেদসহ ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। মঙ্গলবার (২৬ অক্টোবর) সকালে র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক মোজাম্মেল হক রাজধানীর কারওয়ান বাজারে এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানান। তিনি জানান, গতকাল সোমবার (২৫ অক্টোবর) দুপুর থেকে আজ সকাল পর্যন্ত র‌্যাবের অভিযানে  ‘কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লি.’-এর চেয়ারম্যানের অন্যতম সহযোগী এবং প্রকল্প পরিচালক মো. শাকিল আহম্মেদসহ (৩৩) মোট ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তবে কমিটির সভাপতি জসিমসহ অনেকে এখনও পলাতক।

গ্রেফতারকৃতরা হলো মো. শাকিল আহম্মেদ (৩৩), মো. চাঁন মিয়া (৩৮),  এ কে আজাদ (৩৫), মো. রেজাউল (২২), মো. তাজুল ইসলাম (৩১), মো. শাহাবুদ্দিন খাঁন (২৮), আব্দুস ছাত্তার (৩৭), মো. মাসুম বিল্লা (২৯), মো. টিটু মিয়া (২৮) ও মো. আতিকুর রহমান (২৮)।

অভিযানকালে জব্দকৃত মালামালা

প্রতিষ্ঠানটির অফিস থেকে ১৭টি মুদারাবা সঞ্চয়ী হিসাব বই, ২৬টি চেক বই, দুইটি ডিপোজিট বই, তিনটি সীল, ১২০টি ডিপিএস বই, একটি রেজিস্টার বই, একটি নোটবুক, একটি স্যালারি শিট, ৩০টি জীবন-বৃত্তান্ত, পাঁচটি ক্যালেন্ডার, আট পাতা ডিপিএস-এর মাসিক হিসাব বিবরণী, তিনটি পাসপোর্ট, একটি ডিভিআর মেশিন, ভুক্তভোগীদের অভিযোগ কপি ২৮ পাতা, একটি ব্যানার এবং নগদ ৪ লাখ ২২ হাজার ৮০ টাকা জব্দ করা হয়েছে।

টার্গেট নিম্ন আয়ের মানুষ

র‌্যাব বলছে, এই প্রতারক চক্রটির মাঠ পর্যায়ের কর্মী বা সদস্য রয়েছে। এরা রাজধানীর মিরপুরস্থ বিভিন্ন বস্তি এলাকার পোশাক কারখানার কর্মী, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, অটোচালক, সবজি ব্যবসায়ী, ফল ব্যবসায়ী, গৃহকর্মী ও নিম্নআয়ের মানুষদের টার্গেট করে স্বল্প সময়ে মাসিক মেয়াদ শেষে অধিক মুনাফা লাভের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের কোম্পানিতে কথিত বিনিয়োগ বা ডিপিএস করতে উদ্বুদ্ধ করতো। ভিকটিমদের প্রলুব্ধ করে এবং তথ্যাদি সংগ্রহ করে ভুলিয়ে নানান কৌশলে প্রতারক চক্রের অফিস কার্যালয়ে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হতো। এদের প্রতি গ্রাহক বা টার্গেট সংগ্রহের জন্য নির্দিষ্ট অংকের টাকা দেওয়া হতো।  

স্বল্প সময়ে অধিক মুনাফা প্রদানের প্রলোভন

গ্রেফতারকৃত মো. শাকিল আহম্মেদ (৩৩) ও মো. চাঁন মিয়া (৩৮) ভুক্তভোগীদের বিভিন্নভাবে প্রলোভন দেখিয়ে স্বল্প সময়ে অধিক মুনাফা প্রদানের নিশ্চয়তা প্রদান করে কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডে বিনিয়োগ বা ডিপিএস করতে আগ্রহী করতো। এভাবে প্রলুব্ধ হয়ে নিম্নআয়ের মানুষেরা প্রতিষ্ঠানটিতে বিনিয়োগ করতো। প্রতিষ্ঠানে প্রতি সদস্য মাসিক একশো, দুশো, তিনশো, চারশো, পাঁচশো ও ১ হাজার টাকা করে কথিত ডিপিএস জমা করতো। যা তিন বছরে ৩০ শতাংশ এবং পাঁচ বছরে ৫০ শতাংশ মুনাফা প্রদানের নিশ্চয়তা দেওয়া হতো। কিন্তু ভুক্তভোগীদের বক্তব্য অনুযায়ী তাদের নিয়মিত লভ্যাংশ প্রদান করা হতো না এবং ডিপিএসের মেয়াদ পূর্ণ হলেও পাওনা টাকা পরিশোধ করা হতো না।

সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক মোজাম্মেল হক

প্রতারণার কৌশল

র‌্যাব বলছে, প্রতিষ্ঠানটি প্রাথমিকভাবে কোনও এলাকার মানুষকে বোঝানোর জন্য সেই এলাকার মানুষকেই কমিটির ভুয়া সদস্য হিসেবে নিয়োগ করতো। তারা সাধারণ মানুষকে বলতো যে, আমরা কোম্পানিতে বিনিয়োগ বা ডিপিএস করেছি এবং স্বল্প সময়ে অধিক মুনাফা পেয়েছি। সাধারণ মানুষ তাদের কথা বিশ্বাস করে কোম্পানিতে বিনিয়োগ বা ডিপিএস করতে আকৃষ্ট হতো। আর এ সুযোগে কোম্পানির অন্য সদস্যরা ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে কোম্পানির ভর্তি ফরম পূরণ করিয়ে তাদের সদস্য বানাতো। ভুক্তভোগীরা নিয়মিত ডিপিএস-এর টাকা জমা দিলেও কোম্পানির প্রতিশ্রুতিকৃত মাসিক লভ্যাংশ ও মেয়াদ শেষে মুনাফা প্রদান করতো না, এমনকি ভুক্তভোগীদের জমাকৃত মূল টাকাও ফেরত দিতো না। ভুক্তভোগীরা লাভের টাকা চাইতে গেলে হুমকি-ধমকি প্রদর্শন করা হতো। এছাড়া সমিতির নারী সদস্যদের প্রতি অশালীন মন্তব্য করা এবং পুরুষ সদস্যদের টর্চার শেলে নিয়ে গিয়ে মারধর করা হতো বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযান পরিচালনাকালে শাকিলের অফিসের টর্চারসেল থেকে মারধরের সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা হয়েছে বলেও জানিয়েছে র‌্যাব।

র‌্যাব-৪ অধিনায়ক মোজাম্মেল হক জানান, মূল অভিযুক্ত পলাতক আসামি জসিম উদ্দিনের বাড়ি মুন্সিগঞ্জ জেলায়। সে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স পাস করেছে। তার দুই স্ত্রী এবং দুই পুত্র সন্তান রয়েছে। পূর্বে একটি ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে রিপ্রেজেন্টিটিভ হিসেবে কর্মরত ছিল। পরবর্তী সময়ে ২০০৩ সালে সে অল্প সময়ে অধিক মুনাফা লাভের আশায় ‘কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’ প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু সমবায় অধিদফতরের নিবন্ধন লাভ করে ২০০৬ সালে। ২০১৩ সালে সমিতিটির পুনর্নিবন্ধন হয়। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮/২০১৯ সালের তাদের মোট সদস্য সংখ্যা ৫৩৭ জন কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নিয়মবহির্ভূতভাবে ২৫-৩০ হাজার সদস্য গ্রাহক সংগ্রহ করেছে।

কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের আনুমানিক ২৫-৩০ হাজার গ্রাহক রয়েছে, যারা ডিপিএস ও এফডিআর-এর মাধ্যমে বিনিয়োগ করেছে এবং যার পরিমাণ আনুমানিক শত কোটির উপরে বলে অনুসন্ধানে জানা যায়। টাকা চাইতে গেলে গ্রাহকদের হুমকি-ধমকি, মারধর করা ও মামলার ভয় দেখানো হতো। জসিমের নির্দেশে গ্রেফতারকৃত শাকিল ও চাঁন মিয়া ভুক্তভোগীদের মারধরসহ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতো। জসিমের নামে আটটি নামসর্বস্ব কোম্পানির সন্ধান পাওয়া যায়। কোম্পানিগুলো হলো- কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, জসিম মডার্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার, কর্ণফুলী রিয়েল এস্টেট লিমিটেড, জসিম ইন্টারন্যাশনাল ওভারসিস লিমিটেড, জসিম স্টুডেন্ট কনসালটেন্সি ফার্ম লিমিটেড,  জসিম ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস, জসিম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন এবং জসিম নিট কম্পোজিট লিমিটেড।

র‌্যাব জানিয়েছে, কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড ছাড়া বাকি সাতটি কোম্পানির কোনও অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠানের সব আয়ের উৎস হচ্ছে কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডে ভুক্তভোগীদের কথিত ডিপিএস বা এফডিআরের টাকা।

সমিতির সভাপতি জসিম নিজে, সহ-সভাপতি তার শ্বশুর মোতালেব সরকার, সাধারণ সম্পাদক তার প্রথম স্ত্রী লাকী আক্তার এবং কোষাধ্যক্ষ তার শ্যালিকা শাহেলা নাজনীন, এমনকি যুগ্ম সম্পাদক তার নিকট আত্মীয় লাভলী আক্তার। প্রতারণার মাধ্যমে অর্জিত টাকায় জসিমের নামে জমি, ফ্ল্যাট, গাড়ি, বাড়ি, ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থের সন্ধান পাওয়া গেছে।

সমিতির সব কার্যক্রম প্রতারণামূলক
সমিতিটির সমবায় অধিদফতরের নিবন্ধন রয়েছে। তবে শুধু সমিতির সদস্যদের কাছ থেকে সমিতি পরিচালনার জন্য টাকা নেওয়ার অনুমোদন রয়েছে। কোম্পানির আর্থিক লেনদেন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমোদিত নয়। এনজিও হিসেবে এবং মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরির আর্থিক লেনদেনের জন্যও অনুমোদিত নয়।

/এআরআর/ইউএস/
সম্পর্কিত
সাবেক সেনাসদস্যের ‘প্রতারণায়’ নিঃস্ব বহু ট্রাভেল ব্যবসায়ী
ভুয়া দলিলে কয়েকটি ব্যাংক থেকে ৫০ কোটি টাকা ঋণ
পুলিশে চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণা, গ্রেফতার ২
সর্বশেষ খবর
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া