X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য থেকে কি আমরা সরে যাচ্ছি?

জোবাইদা নাসরীন
৩১ অক্টোবর ২০২১, ১৬:৪৯আপডেট : ৩১ অক্টোবর ২০২১, ১৬:৪৯
জোবাইদা নাসরীন সাম্প্রতিক সময়ে বডিশেমিং বিষয়টি খুব বেশি আলোচনায় এলেও সেটি সেভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেনি। অর্থাৎ কোনও প্রতিষ্ঠান নোটিশ দিয়ে বডিশেমিংকে সামনে আনেনি কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর শরীরকে কেন্দ্র করে বৈষম্যের লিপিবদ্ধ বিষয়ও এতদিন চোখে পড়েনি। তবে এই বডিশেমিংয়ের কারণে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা কিংবা দীর্ঘদিন বডিশেমিংয়ের শিকার কিংবা শরীর, চেহারা, গায়ের রঙ নিয়ে নানা ধরনের বুলিংয়ের শিকার হয়ে  নিজেকে সমাজের কাছে কাঙ্ক্ষিতভাবে উপস্থাপন করতে গিয়ে নির্মম মৃত্যু, এগুলোর সঙ্গে ইতোমধ্যে আমরা পরিচিত হয়েছি। তবে খুবই সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি খবরে চোখ আটকে যায়। খবরটি হলো, ঢাকায় অবস্থিত মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ তাদের ২০২২ সালে প্লে গ্রুপে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের জন্য  সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা ও নিয়মাবলি বেঁধে দিয়েছে।  তবে এই যোগ্যতা কিন্তু তার মেধা, সৃজনশীলতা কিংবা তার শিক্ষার সঙ্গে জড়িত কিছু নয়। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, ‘শিক্ষার্থীর যোগ্যতা’ হিসেবে সেখানে আনা হয়েছে শিক্ষার্থীর উচ্চতা,  ওজন। এছাড়াও  প্রাধান্য পেয়েছে দুধদাঁত, শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা সংক্রান্ত আরও কয়েকটি বিষয়।

এই প্রতিষ্ঠানটির প্লে গ্রুপে ভর্তি হওয়া বিজ্ঞাপনে আরও যা যা ছিল বলে জানা যায় তা হলো, শিক্ষার্থীকে ১ জানুয়ারি ২০২২ সালে বয়স চার থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে হতে হবে। উচ্চতার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে শিক্ষার্থীর উচ্চতা  তিন ফুট থেকে তিন ফুট আট ইঞ্চির মধ্যে হতে হবে। এর পরের বিষয়টি আরও বেশি ভয়াবহ, সেখানে শিক্ষার্থীর ওজনও বেঁধে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীকে ১৩ থেকে ২১ কেজির মধ্যে হতে হবে। এখানেই থেমে  থাকেনি শর্তের বহর। শিক্ষার্থীর সব দুধদাঁত থাকতে হবে। তাকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ হতে হবে এবং কোনও ছোঁয়াচে রোগ থাকলে সেই শিক্ষার্থী ভর্তির অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। গণমাধ্যমে এই বিজ্ঞপ্তির বিষয় প্রচার  হওয়ার পর স্কুল গভর্নিং বডি থেকে জানানো হয়েছে যে ‘মূলত শিশুদের বয়স যাচাইয়ের জন্য এসব শর্ত দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এর মাঝে কিছু শর্তে ভাষা ব্যবহারে ভুল ও কিছু শর্ত বিতর্কিত হওয়ায় তারা সেগুলো থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’

এখানে অনেক প্রশ্ন এবং দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, যা বিশ্লেষণে আনা খুবই জরুরি। একজন শিক্ষার্থীর দৃষ্টিভঙ্গি  ও মনমানসিকতা গড়ে দেওয়ার পেছনে যেখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অনেকখানি,  সেখানে ভর্তির সময়ই  একজন শিক্ষার্থীকে বৈষম্যের পথ মাড়িয়ে ঢুকতে হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে?

শুধু তা-ই নয়, একটি শিশুর স্বাভাবিক বিকাশকেও বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। কারণ, এখন অভিভাবকেরা একেবারেই শিশু বয়স থেকেই বাচ্চাদের কম খাওয়ানোর চেষ্টা করবেন। কারণ, তারা অবচেতনভাবেই মাথায় রাখবেন বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করাতে হলে তাকে একরকম শারীরিক মাপকাঠি দিয়ে মাপা হবে। কী অমানবিক, কী অনাকাঙ্ক্ষিত সব চাওয়া!

বাচ্চারা স্কুলে শিক্ষাগ্রহণ করতে যায়। সে বাচ্চা মোটা না শুকনা, তার দাঁত আছে কী নেই, সে লম্বা না বেটে, সে ছেলে, মেয়ে নাকি ট্রান্সজেন্ডার, সে কালো না ফর্সা এগুলো দিয়ে স্কুল কমিটির কী কাজ?

ঢাকা শহরের অনেক বেসরকারি এবং ইংরেজি মাধ্যম স্কুল আছে, যেখানে ভর্তি হতে হলে অভিভাবকদের পেশা এবং উপার্জন  গুরুত্ব পায়। কারণ, সেখানে পড়ানোর সামর্থ্য অভিভাবকদের আছে কিনা সেটি যাচাই করা হয়। কিন্তু এখানে যাচাই করা হচ্ছে শিক্ষার্থীর বয়স, উচ্চতা এবং ওজন।

তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, অনেক অভিভাবক বয়স কিছুটা কমিয়ে বাচ্চাকে একটি ‘নামকরা’ স্কুলে ভর্তি করাতে চান। এবং সেক্ষেত্রে হয়তো একই ক্লাসে বিভিন্ন বয়সী বাচ্চা থাকতে পারে।  সেখানে একজন শিক্ষক বা স্কুল কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব কী হবে? যাদের বয়স তুলনায় এক আধ বছর বেশি তাদের বের করে দেওয়া? নাকি সবাইকেই বুঝিয়ে বলা যে যেকোনও বয়সেই মানুষ পড়াশোনা করতে পারে এবং একে অপরের বন্ধু হতে পারে। সেখানে সবাইকে গ্রহণ করার মতো মানসিকতা তৈরি করাই একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাজ।

অন্যদিকে  শারীরিকভাবেও সবাই এক হবে না, কারও সাথে কারও মিলবে না। সেই অমিলটাকে সৌন্দর্য হিসেবে দেখাটাই শিক্ষার উদ্দেশ্য। এই অমিলকে নিয়ে কারও প্রতি কোনও ধরনের বৈষম্য প্রদর্শনের সুযোগ একেবারেই নেই। শারীরিক এবং মানসিকভাবে বাচ্চা যদি সুস্থ না হয় তাহলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব তো আরও বেশি। সেখানে তাদের প্রতি আরও মনোযোগ দেওয়ারই কথা। তাদের প্রতি বাড়তি মনোযোগের লোক নেই, এ ধরনের যুক্তি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না। জনবল না থাকলে সেটির ব্যবস্থা করতে হবে। এটি না করে ওজন মেশিন বসিয়ে, ফিতা, কাঁচি কিংবা দাঁত পরীক্ষা করে শিক্ষার্থী ভর্তির নিয়ম একটি প্রতিষ্ঠানের ‘অসুস্থ’ ভর্তি চর্চাকেই ইঙ্গিত করে।

একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছে আমরা কী আসা করি? সেখানে শুধুমাত্র শ্রেণিভিত্তিক পাঠদান কিংবা পাঠ্যবই পড়ানো হবে তা কিন্তু নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সব শিক্ষার্থীকে একইভাবে দেখবে এবং কারও প্রতি কোনও ধরনের বৈষম্য প্রদর্শন করবে না এবং শিক্ষার্থীরা নৈতিক শিক্ষার অনেকটাই পায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে। কিন্তু এই ভাবনার বিপরীতে গিয়ে বৈষম্যের দাঁড়িপাল্লায় মেপে মেপে শিক্ষার্থী ভর্তি করার ঝোঁক শিক্ষার মূল্যবোধের বিপরীতেই কাজ করে। শুধু মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলই নয়, অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই  বিজ্ঞপ্তি  বা অনানুষ্ঠানিকভাবে এই ধরনের বৈষম্যের চর্চা  আছে, যা কিনা আমরা অনেক শিক্ষার্থী থেকেই শুনি। শিক্ষার পরিবেশ ভালো রাখার দোহাই দিয়ে যারা বলেন, ‘মোটা বাচ্চা মানেই দুষ্ট, ভালো না, তাদের বিনীতভাবেই বলতে চাই, ওই বাচ্চারা নয়, শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করছেন আপনারাই।  শারীরিক মাপকাঠিতে শিক্ষার্থীকে বিচার করার এই চর্চা ক্রমশই অসুস্থ করে তুলছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে।

তবু মন্দের ভালো হলো স্কুল কর্তৃপক্ষ সেই বিজ্ঞপ্তি তুলে নিয়েছেন। তবে আমরা কম বেশি জানি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রতিনিয়তই যে বুলিংয়ের চর্চা হয় এবং সেখানে শাস্তি কিংবা কাউন্সিলিংয়ের বিপরীত শিক্ষকরাও সেই বুলিংয়ে অংশগ্রহণ করেন অথবা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য যদি হয় মানুষের মর্যাদা নিশ্চিত এবং সম-অধিকার এবং বৈষম্যহীন, তাহলে এই বুলিং চর্চা নিশ্চিতভাবেই শিক্ষার উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করছে।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: [email protected]
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আঙুরের গোড়া কালো হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন টিপস
আঙুরের গোড়া কালো হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন টিপস
টেকনাফে ১০ জন কৃষক অপহরণের ঘটনায় ২ জন আটক
টেকনাফে ১০ জন কৃষক অপহরণের ঘটনায় ২ জন আটক
এরদোয়ানের যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা জানা গেলো
এরদোয়ানের যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা জানা গেলো
যুক্তরাষ্ট্রের টি-টোয়েন্টি দলে নিউজিল্যান্ডের সাবেক অলরাউন্ডার
যুক্তরাষ্ট্রের টি-টোয়েন্টি দলে নিউজিল্যান্ডের সাবেক অলরাউন্ডার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ