X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

রোজা জামালির কবিতা

পাঠ ও ভাষান্তর : অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়
০৭ নভেম্বর ২০২১, ১০:৫০আপডেট : ০৭ নভেম্বর ২০২১, ১০:৫০

[প্রথানুগ ও ধ্রুপদী সাহিত্যের চিরায়ত চিহ্ন-ছন্দ-উপমা-প্রকরণের রিমেক বর্জন করে ইরানের সমকালীন আভাঁ-গার্দ ফারসি পরীক্ষাকবিতা তার স্বতন্ত্র ভাষ্য নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছে। এটা সম্ভব করেছিলেন ইরানের নব্বুই দশকের কিছু তরুণ কবি। কিন্তু বিগত শতকের (বিংশ শতাব্দী) ওই দশকেই (নব্বুই দশক) এমন এক কবি উঠে এলেন ফারসি কবিতায়, যিনি ধ্রুপদী ফারসি সাহিত্য ও দর্শন থেকে, গ্রিক মিথোলজি, লোককথা আর ক্ল্যাসিক নাটক থেকে হাজারো উপাদান নিয়ে গড়ে তুললেন এমন এক তছনছ করা সিনট্যাক্স, জাক্সট্যাপোজ করে তাদের বসিয়ে দিলেন কবিতায়, যেখানে মানুষের দৈনন্দিন কথার স্বরের ওঠানামার সাথে মিশে গেল ধ্রুপদী ছন্দও। ফারসি কবিতায় সৃজনশীলতার নতুন আরেকটা সম্ভাবনাময় পথ খুলে গেল সেদিন। ভাঙা-বাক্য দিয়ে তিনি তৈরি করে ফেললেন এক সুররিয়াল জগৎ যেখানে শব্দেরা তাদের দৈনন্দিন ব্যবহারিক অর্থ হারিয়ে হয়ে উঠল অস্তিত্ব-সঙ্কটে জেরবার জীবনের তালগোল পাকানো এক-একটা বস্তু। ধ্রুপদী ফারসি কবিতার যে সঙ্গীতময়তা সমকাল থেকে অনেকটা দূরে গিয়ে বসেছিল উঁচুতে, তাকে নামিয়ে পার্থিব হাটে-বাজারের-রান্নাঘরের ভিড়ে-মশলায় মিশিয়ে দিলেন এই কবি, রোজা জামালি। 
কিন্তু সবচেয়ে যেটা আশ্চর্যের, রোজা তাঁর প্রত্যেকটি বই যেন প্রকৃতপ্রস্তাবে আলাদা কলমে লিখলেন। এতক্ষণ ওঁর কবিতার যে বৈশিষ্ট্যগুলোর কথা বললাম, এগুলো সবই ওঁর প্রথম বইয়ের সাপেক্ষে। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে এসে এই কবি হয়ে উঠেছেন কোথাও ন্যারেটিভ, স্ট্রিম-অফ-কনশাসনেসে এক লেখা যেন, কোথাও সেকেলে, প্রথানুগ, কোথাও লৌকিকতা-বর্জিত আড়ম্বরহীন, কোথাও সাংবাদিকের ভাষা, কোথাও বৈজ্ঞানিকের অনুসন্ধান। তৃতীয় কাব্যগ্রন্থে আবার ফিরে গেলেন পুরাণ-কাহিনিমালায়, গ্রিক ট্র্যাজেডিতে। পরীক্ষাধর্মী ফারসি কবিতায় নিঃসন্দেহে এক অনন্য যাপন নিয়ে এলেন রোজা।
বিশ শতকের শেষে এসে যে অতীতহীন, ইতিহাস-চেতনাহীন, স্মৃতিহীন এক অন্যমনস্ক, উদাসীন প্রজন্ম পেল এই পৃথিবী, সবচেয়ে আশা নিয়ে শুরু হয়েছিল যে শতাব্দী, সবচেয়ে স্বপ্নভঙ্গ এবং মেরুদণ্ডহীনভাবে শেষ হল তা; যে প্রজন্ম সিস্টেম আর রাষ্ট্রের শেকল হাতে-পায়ে নিয়ে ঘরবন্দী, আর তার ইড়া-পিঙ্গলা-সুষুম্না-ধমনী ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে হাত থেকে, শরীর থেকে। কোথায় যাচ্ছে? ক্যাসিনোয় জুয়ায় লুঠ হয়ে যাওয়া তার স্মৃতি এখন বিক্রির জন্য বাজারে টাঙানো। ঘরের সবকটা আয়না তাকে একই ছবি দেখাচ্ছে। একটা তালাবন্ধ ঘর। যেখানে থাকতে থাকতে একসময় তার নিজেকেই একটা আস্ত স্মৃতি বলে মনে হয়। বেসিনে পড়ে থাকা গুঁড়ো-গুঁড়ো লবণের মতো ছেঁড়া-ছেঁড়া স্মৃতি। কিন্তু স্মৃতির তো একটা আধার চাই। সে কীসের আধেয় হবে? তার ধমনী তো তার শরীর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। নিজের এই সম্প্রসারিত ‘আমি’র ক্রাইসিস রোজা জামালির কবিতার ভাষায়-আঙ্গিকে ফারসি কবিতার হুডখোলা উত্তরাধিকার। 
কবি, অনুবাদক, থিয়েটার কর্মী রোজার জন্ম, ১৯৭৭ নভেম্বরে। তেহরানের আর্ট ইউনিভার্সিটি থেকে থিয়েটার নিয়ে পড়াশোনা করেছেন।  
প্রথম কবিতার বই, ‘This Dead Body Is Not an Apple, It Is Either a Cucumber or a Pear’ (১৯৯৭), দ্বিতীয় বই, ‘Making a Face’ (১৯৯৭), তৃতীয় বই, ‘Making Coffee To Run A Crime Story’ (২০০২), কাব্যসঙ্কলন—‘The Sand Glass Which Has Fallen Asleep’। এছাড়াও নাটক লিখেছেন। সমসাময়িক বইপত্রের সমালোচনা লিখেছেন। ফারসিতে অনুবাদ করেছেন ইয়েটস-এর কবিতা।]    


বৃষ বৎসর


এই নেংটি ইঁদুর আমার গানের ধারালো পাত্র 
সাউন্ড মিউট করা সারি সারি বাঘ
বরফে মসৃণ এঁটে আছে তাদের থাবা।

২.
ধাতব অন্ধকার
বরফ পিছল
অন্ধকার

আমার ছায়ার ওপর দিয়ে হাঁটছে কুঁচকোনো চাঁদ 
আমি মাছকে কবর দিয়েছি
সিলিং থেকে ঝুলছে প্রাগৈতিহাসের স্মৃতি।

শতাব্দি ধরে হাঁটছি
কথা-বলা মুখোশ
আর তার মূকাভিনয়, অঙ্গভঙ্গি নিয়ে

ধস্ নেমে ভাঙল
গাছের জাফরি
কাগজের ভাঁজ করা নকশা
হাওয়ায় ভেসে গেল
এবং সম্পূর্ণ ভুলে যাওয়া সম্ভব হল তাকে

৩.
কাচের কফিন, জানলার পাশে 
সময় দীর্ঘ হয়ে আছে আমার ওপর
বাটির ওপর ছায়া

ভেঙে খান খান হচ্ছে জানলায়

গতকাল আমাকে কবর দেয়া হয়েছে
এখন আর আঙুল নড়ছে না
সময়কে খামচে ধরেছে তারা

এখানে মেঘের কোনও শেষ নেই
সব রেখাগুলো কুচকুচে
আমার ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আয়নাটা 

জামার বোতামগুলো চিবিয়ে খেয়েছে তারা 

দলে দলে কাক উড়ছে
এই পৃথিবী অতি পরিশ্রমে ক্লান্ত এক করিডর

গণপিঁপড়ে হানা দিয়েছে আমার ঘরে
এখানে সাতশো বছর ধরে বৃষ্টি পড়ছে
রাস্তায় হেঁটে বেড়াচ্ছে একটা অন্ধ লোক
একটা ষাঁড়কে উৎসর্গ করা হচ্ছে এ বছরটা... 

৪.
বাঁ দিক থেকে খরগোশ আসে
শাদা বরফের সাথে তার প্রেম

তার সঙ্গম
আমার ধমনী থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে খরগোশ


এই বাড়ির একমাত্র বাসিন্দা একটি নীরস বাজপাখি 

আমি তালাবন্ধ আছি। আমার রক্তবাহী শিরা দৌড়ে চলে যাচ্ছে।

আমার স্মৃতিগুলো পরিস্থিতির শিকার।
আমার স্মৃতিগুলো জুয়ায় নেমেছে।
এখন বিক্কিরি হবে। 

চোখের পাতার ওপর
একটা
ভারী লোক

সবকটা আয়না আমাকে একই দৃশ্য দেখাচ্ছে
একটা তালাবন্ধ দরজা
পাথরের চাঁই পড়ছে
পরিত্যক্ত। খালি পা।
দিনটা এসবের উপরিভাগ মাত্র

সেই খণ্ডবিখণ্ড স্মৃতি
বিরাট বেসিনে
গুঁড়ো-গুঁড়ো দানাদার লবণ

আমার পালস্ তোমার কাছে
তোমার ধমনীর সাথে জোড়া আমি নিজেই একটা স্মৃতি 

ক্লান্ত
ওরা ড্রাম পেটাচ্ছে
জোরসে
যত জোরে বাজানো যায়
আমি কালা একটা মানুষ

আর এই বাড়ির একমাত্র বাসিন্দা রসকসহীন একটা গুমোট বাজপাখি 


একজন অনিবার্য সম্পর্কে কথা

ধরা যাক আমি অনিবার্য কেউ
আমার ডান হাতের শিরা
এই মুসাবিদা পত্রে তোমাকে শূন্য করছে।
শেষ হয়ে এল আমার মরা চুল।

আমার নরম নখের ওপর 
হাওয়া
আকাশ থেকে নামেনি
তোমাকে বেঁকিয়ে দিচ্ছে
অথবা আমার ডান হাতের শিরা দৌড়চ্ছে
তার দপদপ নিয়ে

তারপর, আঙুলের দিকে রোল হতে হতে
ভ্যানিশ।
এক সেকেন্ডের জন্যেও সে আর কোনওদিন ফিরবে না
প্রথম থেকে
আমি একটা আদ্ধেক

আমার ঘাড় থেকে বেরোনো শিরা আড়াআড়িভাবে কেটে তোমাকে পেরিয়ে চলে যাচ্ছে

আমার দশটা আঙুলের ওম যদি
তোমার নিশ্বাসের টুকরোগুলোর হাতে বাজেয়াপ্ত হয়
একটা স্মৃতিহীন কানাগলিতে 
সবকিছুর তাহলে শেষ হল। 


তেহরানের শেষ রাস্তায় 

এয়ারপোর্টে
এই খিঁচুনি ধরা ভূমিই আমার হাতের ফলাফল 
আমার করতল সমান এর ব্যাস
অবহেলা করে যাচ্ছে এই পেছল সূর্যালোক 
আমাদের সাথে কথা বলবার কোনও সন্ধি শর্ত চুক্তিও নেই সূর্যের 
মরুভূমির দিক থেকে এগিয়ে আসা স্বপ্নেরা নড়িয়ে দিচ্ছে আমার আঙুল
হাওয়া এসে শক্ত করছে দাঁত
বালিভূমির সব ঘূর্ণিবায়ু এসে বইছে আমাদের ঘরদোর জুড়ে

আমার মুখের পাশে আমারই মুখের টুকরো লাগিয়ে হাসাতে চাইছে আমায় 

তোমার হাতের ওপারে আমি কীভাবে লাফাব
কী নির্ভুল অনুমান করেছ তুমি:
ঘুমের জন্য দীর্ঘতম রাতকে জায়গা দেবে
এক বিরাট গোরস্থান  
আমাদের চোখের পাতা থেকে প্রবাসগত ঘুম
ঢেকে দিচ্ছে নদীর পাড়
চোখের জলে ভেজা আমাদের ঠোঁট ভিজিয়ে দিচ্ছে নদী

আমার মুখের পাশে আমারই মুখের টুকরো লাগিয়ে হাসাতে চাইছে আমায় 

কাঁচিতে কিছু কাটছে
বর্ণমালা নুয়ে পড়ছে মাটিতে
আমাদের নামের নিরুদ্দিষ্ট অক্ষরমালা
এই জিজ্ঞাসার ভেতর দিয়ে
শক্তপোক্তভাবে বসেছে মরুভূমির মাঝখানটিতে
তারপর ছড়িয়ে যাচ্ছে
আমার মায়ের তালাবন্ধ নিঃশ্বাস 
তার পায়ের ছাপ মিলিয়ে যাচ্ছে বালিতে...

আমার মুখের পাশে আমারই মুখের টুকরো লাগিয়ে হাসাতে চাইছে আমায় 

তেহরানের শেষ রাস্তায় আর ফিরব না
তোমার জন্য শুধু একপায়ের জুতো ছেড়ে যাচ্ছি এখানে
এটা পরে, আমার পেছন পেছন এসো
আমার হাতের সমান একটা রেখা উঠছে দিকচক্রবালে 
তিন ফুট মতো লাফাবে ওটা
নিঁখুত আমার হাতের মাপে 


বিশেষ কৃতজ্ঞতা : পারহাম শাহরজের্দি (ইরান, ফ্রান্স)   

/জেডএস/
সম্পর্কিত
প্রিয় দশ
প্রিয় দশ
ইচ্ছা
সর্বশেষ খবর
কাপ্তাই হ্রদে পানি স্বল্পতায় কমেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন
কাপ্তাই হ্রদে পানি স্বল্পতায় কমেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
মৌলভীবাজারে ৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা মর্মান্তিক: মানবাধিকার কমিশন
মৌলভীবাজারে ৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা মর্মান্তিক: মানবাধিকার কমিশন
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের বিক্ষোভ
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের বিক্ষোভ
সর্বাধিক পঠিত
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি