X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

পাঁচশ’র কমে মেলে না ৫০ টাকার জন্মনিবন্ধন সনদ

আতাউর রহামান জুয়েল, ময়মনসিংহ
০৮ নভেম্বর ২০২১, ১৩:০০আপডেট : ০৮ নভেম্বর ২০২১, ১৩:০৯

‘স্কুলে ভর্তির সময় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে বাবা জন্মনিবন্ধন করে দিয়েছিলেন। তখন হাতে লেখা জন্মনিবন্ধন সনদ ছিল। এখন করোনার টিকার জন্য স্কুলের স্যাররা আগেরটা বাদ দিয়ে অনলাইন জন্মনিবন্ধন চাইছেন। গত সপ্তাহে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে সনদের জন্য গেলে সরকারি ফিসহ অন্যান্য খরচ বাবদ সেন্টারের উদ্যোক্তা কামরুজ্জামান সুমন ৬০০ টাকা চান। সঙ্গে টাকা না থাকায় বাড়ি ফিরে আসি। পরে বাবার কাছ থেকে টাকা এনে জন্মনিবন্ধনের জন্য কামরুজ্জামানকে ৫০০ টাকা দিই। কাগজপত্র জমা রেখে এক সপ্তাহ পরে আসতে বলেছেন তিনি।’

ময়মনসিংহ সদরের ঘাগড়া ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল সেন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিলো মাইজহাটি গ্রামের কৃষক মিজানুর রহমানের ছেলে মো. রাসেল। সে রওশন কাদের উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে।

রাসেলের অভিযোগ, তার সহপাঠীরা ডিজিটাল সেন্টারে এসে সরকার নির্ধারিত ফি’র বাইরে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে সনদ নিয়েছে। ৫০০ টাকা ছাড়া জন্মনিবন্ধন করে দেন না কামরুজ্জামান সুমন।

ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই

রাসেলের অভিযোগ অনুসন্ধান করতে গিয়ে সত্যতা পেয়েছেন বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিনিধি। ঘাগড়া ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল সেন্টারে ৫০০-৬০০ টাকা ছাড়া অনলাইন জন্মনিবন্ধন মেলে না।

একই সঙ্গে সদরের দাপুনিয়া ইউনিয়ন, ত্রিশাল সদর ইউনিয়ন, ত্রিশালের বইলর ও ফুলবাড়িয়া উপজেলার দেওখোলা ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে গিয়েও একই চিত্র দেখেছেন প্রতিনিধি।

১২ থেকে ১৮ বছরের শিক্ষার্থীদের জন্মনিবন্ধন সনদের মাধ্যমে করোনার টিকা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। এ অবস্থায় টিকা নিতে অনলাইন জন্মনিবন্ধন সনদের জন্য ইউনিয়ন পরিষদ ডিজিটাল সেন্টারে হুমড়ি খেয়ে পড়ে স্কুল ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা। জন্মনিবন্ধন সনদের জন্য সরকার নির্ধারিত ফি ৫০ টাকা। অথচ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ৫০০-৭০০ টাকা নেন ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের কর্মকর্তারা। সেই সঙ্গে ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তারা স্থানীয়ভাবে দালাল চক্র গড়ে তুলেছেন।

টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন উদ্যোক্তা উবায়দুর রহমান ফাহাদ

কাতলাসেন এলাকার বাসিন্দা শাহজাহান বলেন, ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে এসে কেউ ৫০০ টাকা না দিয়ে জন্মনিবন্ধন সনদ নিতে পারছেন না। স্থানীয় দালাল চক্রের মাধ্যমে জন্মনিবন্ধনের জন্য ৫০০-৬০০ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন উদ্যোক্তারা। টাকা দিয়েও দিনের পর দিন ঘুরতে হয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

দাপুনিয়া এলাকার বাসিন্দা স্নাতকের শিক্ষার্থী মাহবুব আলম বলেন, দাপুনিয়া ও ঘাগড়া ইউনিয়ন পরিষদ ডিজিটাল সেন্টারে অতিরিক্ত টাকা ছাড়া জন্মনিবন্ধন পাওয়া যায় না। টাকা না দিলে দিনের পর দিন ঘুরতে হয়। বাধ্য হয়েই ৫০০-৬০০ টাকা দিয়ে সবাইকে অনলাইন জন্মনিবন্ধন নিতে হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঘাগড়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য (মেম্বার) জানান, ইউনিয়ন পরিষদের সচিবের নেতৃত্বে ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা কামরুজ্জামান সুমন দালালদের সঙ্গে নিয়ে সিন্ডিকেট করেছেন। অনলাইন জন্মনিবন্ধনসহ অন্যান্য সেবা নিতে আসা ব্যক্তিদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিচ্ছেন তারা। টাকা নেওয়ার পরও সময়মতো কাজ করে দিচ্ছেন না। এলাকাবাসী তাদের সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি।

সেন্টারের মেঝেতে পড়ে আছে টাকা সংবলিত আবেদন ফরম

জানতে চাইলে ঘাগড়া ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মনিরা ইয়াসমিন বলেন, জন্মনিবন্ধন করতে সরকারি ফি’র বাইরে টাকা লাগে না। উদ্যোক্তা কামরুজ্জামান সুমন অতিরিক্ত টাকা নেন কিনা আমার জানা নেই।

তবে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে কামরুজ্জামান সুমন বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ সচিবের নির্দেশে অনলাইন জন্মনিবন্ধনসহ নানা ধরনের ডাটা অপারেটিং কাজ করি। অনেক সময় অতিরিক্ত কাজ করতে সরকারি ফি ৫০ টাকার বাইরে বাড়তি টাকা নিতে হয়। এই টাকা নেওয়ার বিষয়টি ইউনিয়ন সচিব জানেন।

রবিবার (৭ নভেম্বর) দুপুরে ফুলবাড়িয়া উপজেলার দেওখোলা ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে গিয়ে দেখা যায়, অনলাইন জন্মনিবন্ধনের জন্য সেন্টারে মানুষের ভিড়। প্রত্যেকের কাছ থেকে ২৫০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে। আবেদনকারীদের ফরমে স্ট্যাপলার দিয়ে টাকা আটকে রাখতে দেখা গেছে। টাকা সংবলিত আবেদন ফরম সেন্টারের মেঝেতে পড়ে আছে।

অনলাইন জন্মনিবন্ধনের সনদ নিতে শিক্ষার্থীদের ভিড়

সেবা নিতে আসা কালিবাজাইল গ্রামের রওশন আরা জানান, তার মেয়ের অনলাইন জন্মনিবন্ধন সনদ নিতে এসেছেন। সেন্টারের উদ্যোক্তা উবায়দুর রহমান ফাহাদের চাহিদার সাড়ে ৭০০ টাকার মধ্যে ৭০০ টাকা দিয়ে সনদ পেয়েছেন দুই সপ্তাহ ঘুরে।

২৫০ থেকে ৫০০ টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করে উদ্যোক্তা উবায়দুর রহমান ফাহাদ জানান, চেয়ারম্যান আতাউর রহমান হাদীর নির্দেশে তিনি অনলাইন জন্মনিবন্ধন সনদের টাকা নিচ্ছেন। তবে এই টাকা ইউনিয়ন পরিষদের কয়েকজন কর্মচারীর মাঝে বণ্টনের কথা জানান তিনি।

এ বিষয়ে চেয়ারম্যান আতাউর রহমান হাদী বলেন, উদ্যোক্তাকে টাকা নেওয়ার কথা আমি বলিনি। আগামী ১১ নভেম্বর ইউপি নির্বাচন থাকায় আমি ব্যস্ত আছি। উদ্যোক্তা জন্মনিবন্ধনের জন্য অতিরিক্ত টাকা নিচ্ছেন কিনা আমার জানা নেই।

এদিকে, ত্রিশালের বইলর ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই সেবাগ্রহীতাদের।

ইউনিয়ন যুবলীগের আহ্বায়ক সফিকুল ইসলামের অভিযোগ, ডিজিটাল সেন্টারে টাকা ছাড়া কোনও সেবা পাওয়া যায় না। বিশেষ করে শিক্ষর্থীদের টিকা দেওয়ার ঘোষণার পরই জন্মনিবন্ধনের চাপ বেড়ে যায়। এই সুযোগে উদ্যোক্তা ও কর্মচারীরা এক হয়ে অতিরিক্ত টাকা নিচ্ছেন। টাকা নিয়েও সময়মতো কাজ করে না দেওয়ায় মানুষের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এ জন্য সম্প্রতি ডিজিটাল সেন্টারে উত্তেজিত জনতা হামলা করেছিল।

 

বইলর ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা রিজন মিয়া বলেন, ২০০ থেকে ২৫০ টাকা নেওয়া হয়। এই টাকা থেকে জন্মনিবন্ধন সনদে স্বাক্ষর করাতে ইউনিয়ন পরিষদ সচিবকে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা দিতে হয়।

এ বিষয়ে জানতে বইলর ইউনিয়ন পরিষদ সচিব আনোয়ার হোসেনকে একাধিকবার ফোন দিলেও রিসিভ করেননি।

স্থানীয় সরকার অধিদফতরের উপ-পরিচালক গালিভ খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ ডিজিটাল সেন্টার থেকে জন্মনিবন্ধন সনদ নিতে সরকারি ফি’র বাইরে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। কেউ অতিরিক্ত টাকা নিলে তদন্তপূর্বক আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

/এএম/
সম্পর্কিত
জয়পুরহাটে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও চট্টগ্রামে কাস্টমসে দুদকের অভিযান
‘দুর্নীতিবাজ’ সেই মাদ্রাসা শিক্ষকের বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে
চাঁদপুর ও ময়মনসিংহে দুদকের অভিযান
সর্বশেষ খবর
প্রথম ধাপে ভোটের হার ৬০ শতাংশ, সর্বোচ্চ পশ্চিমবঙ্গে
লোকসভা নির্বাচনপ্রথম ধাপে ভোটের হার ৬০ শতাংশ, সর্বোচ্চ পশ্চিমবঙ্গে
কুকি চিনকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা: নুর
কুকি চিনকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা: নুর
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
কান উৎসব ২০২৪১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
সর্বাধিক পঠিত
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা   
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা  
ভ্রমণ শেষে ভারত থেকে তিন দিনে ফিরলেন ১৫ হাজার পর্যটক
ভ্রমণ শেষে ভারত থেকে তিন দিনে ফিরলেন ১৫ হাজার পর্যটক