X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

অজ্ঞাত আসামির ফাঁদ ও পুরুষশূন্য হারাগাছ

আমীন আল রশীদ
০৯ নভেম্বর ২০২১, ১৬:৩৯আপডেট : ০৯ নভেম্বর ২০২১, ১৬:৪২
আমীন আল রশীদ রংপুরের হারাগাছে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পরে তাজুল ইসলাম নামে এক লোকের মৃত্যুর ঘটনা কেন্দ্র করে স্থানীয় বিক্ষুব্ধ জনতা থানায় যে হামলা ও ভাঙচুর চালিয়েছে, তাতে দুটি মামলা করেছে পুলিশ, যেখানে আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাত তিনশ’ জনকে। যেহেতু আসামি অজ্ঞাত, অতএব যে কেউ যেকোনও সময় গ্রেফতার হতে পারেন, এই আতঙ্কে এলাকা পুরুষশূন্য। কারণ, মামলার পর থেকেই হারাগাছের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান ও তল্লাশি চালাতে শুরু করে পুলিশ।

গণমাধ্যমের খবর বলছে, ঘটনার পর হারাগাছ থানা এলাকার আশপাশের পাড়া-মহল্লায় এক ধরনের নীরবতা নেমে এসেছে। চারদিকে তাকালে বয়স্ক লোক ছাড়া যুবক বা কিশোর কাউকেই তেমন একটা চোখে পড়ছে না। সবখানে থমথমে ও ভীতিকর অবস্থা। যদিও পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই বা ছিলেন না এমন কাউকেই গ্রেফতার করা হবে না। তবে পুলিশের এই বক্তব্যে আশ্বস্ত হতে পারছেন না স্থানীয়রা। ফলে গ্রেফতার এড়াতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন পুরুষরা। তারা জানেন, অপরাধী না হলেও একবার গ্রেফতার হলে ছাড়া পাওয়া খুব কঠিন। কারণ, এসব ঘটনায় মামলার এজাহারভুক্ত না হলেও অনেককে ধরে মামলার আসামি করার ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়ের অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে নতুন নয়। বিশেষ করে যেসব মামলায় অজ্ঞাত আসামি থাকে।

পয়লা নভেম্বর সন্ধ্যায় মাদকবিরোধী অভিযানের সময় হারাগাছ থানা পুলিশ পৌর এলাকার দরদী স্কুলসংলগ্ন তেপতি এলাকায় মাদকসহ তাজুল ইসলাম নামে একজনকে আটক করে। আটক অবস্থায় সেখানেই তার মৃত্যু হয়। স্থানীয়রা এ ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ তুলে ঘেরাও করে থানায় হামলা চালিয়ে পুলিশের গাড়িসহ বেশ কিছু আসবাবপত্র ভাঙচুর করে। এ নিয়ে উত্তেজিত জনতার সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। এতে পুলিশ ও সাংবাদিকসহ প্রায় ৩৫ জন আহত হন। পুলিশের দাবি, আটক ব্যক্তিকে নির্যাতন করা হয়নি। বরং ওই লোক মাদকসেবী এবং শারীরিকভাবে দুর্বল থাকায় অভিযানের সময় অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন। তবে তাজুল ইসলামের আসলেই কীভাবে মৃত্যু হয়েছে, তাকে আটকের পর পুলিশের বিরুদ্ধে পিটিয়ে হত্যার যে অভিযোগ উঠেছে এবং এই ঘটনায় পুলিশের ওপর হামলা এবং এ বিষয়ে সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে, তা জানানোর জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। ঘটনা তদন্তে পুলিশের পক্ষ থেকেও চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

তবে হাইকোর্টে দাখিলকৃত পুলিশের প্রতিবেদনে যা-ই বলা হোক না কেন; তাজুলের মৃত্যু যেভাবেই হোক না কেন; ঘটনার পরের পরিস্থিতি আর স্থানীয় মানুষের হাতে নেই। বরং তারা এখন নতুন আতঙ্কে আছেন, যার নাম গ্রেফতার।

স্মরণ করা যেতে পারে, হারাগাছের এই ঘটনার অব্যবহিত আগে কুমিল্লার একটি পূজামণ্ডপে কোরআন শরিফ রাখাকে কেন্দ্র করে ১৬ জেলায় হিন্দুদের বাড়িঘর, পূজামণ্ডপ, মন্দিরে হামলার ঘটনায় দায়ের করা ৮৫টি মামলায় ২৩ হাজার ৯১১ জনকে আসামি করা হয়েছে—যেখানে অধিকাংশ আসামিই অজ্ঞাত। প্রশ্ন হলো, ২৪ হাজার লোক কি এসব হামলায় অংশ নিয়েছে? যেহেতু আসামি অজ্ঞাত, ফলে এসব এলাকায়ও গ্রেফতার এড়াতে বিভিন্ন গ্রাম ও এলাকা পুরুষশূন্য হয়ে গেছে। আসামির তালিকা এত দীর্ঘ হওয়ায় সুষ্ঠু বিচার হবে কিনা, তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদও। সংগঠনটি মনে করে, ৮৫টি মামলায় অন্তত ৫০০ জনকে চিহ্নিত করে তাদের বিচার করা দরকার।

অতীতেও দেখা গেছে, বড় কোনও ঘটনায় মামলায় যখনই অনেক অজ্ঞাত আসামি থাকে, তখনই গ্রেফতার এড়াতে গাঢাকা দেন সংশ্লিষ্ট এলাকার পুরুষরা। এটি এখন মোটামুটি সিস্টেমে পরিণত হয়েছে। আর কোনও একটি সাধারণ পরিবারের মূল উপার্জনকারী ব্যক্তিকে যখন গ্রেফতার এড়াতে এরকম দিনের পর দিন পালিয়ে বেড়াতে হয়, তখন ওই  পরিবারগুলোতে নেমে আসে এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তা। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং প্রশাসনের তরফে বারবারই আশ্বাস দেওয়া হয় যে নিরপরাধ কাউকে হয়রানি করা হবে না। কিন্তু কেউ একবার গ্রেফতার হলে তার নিরপরাধ প্রমাণিত হয়ে বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়া যে কত কঠিন, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কারও পক্ষে আন্দাজ করাও কঠিন। বাস্তবতা হলো, অজ্ঞাত আসামি মানেই গ্রেফতার ও আটক বাণিজ্য। অপরাধ করে ১০ জন, তার মাশুল দেয় হাজারো মানুষ।

রংপুরের পীরগঞ্জে হিন্দুদের ঘরবাড়িতে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের পরে ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান ওই এলাকা পরিদর্শনে গেলে স্থানীয়রা গ্রেফতার আতঙ্কের কথা জানান। এ সময় তিনি নিরপরাধ কাউকে হয়রানি না করতে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেন। রংপুর পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার সরকারও সংবাদমাধ্যমকে বলেন, নিরপরাধ কাউকে হয়রানি করা হবে না। একই কথা বলেন জেলা প্রশাসক আসিব আহসানও। কিন্তু মুশকিল হলো, প্রশাসনের এসব কথায় মানুষ খুব একটা আশ্বস্ত হতে পারেন না। কারণ, অজ্ঞাত আসামির সুযোগ শুধু পুলিশ নয়, বরং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী স্থানীয় লোকজনও এর সুযোগ নিয়ে জায়গা জমি, রাজনীতিসহ নানা বিষয়ে তাদের সঙ্গে বিরোধ রয়েছে, এমন লোকদেরও জড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। অর্থাৎ পুলিশের কাছে মিথ্যা তথ্য দিয়ে অনেক নিরপরাধ লোককেও গ্রেফতার করানো বা হয়রানির চেষ্টা চলে। পুলিশও স্থানীয় মানুষজনের এই বিরোধের সুযোগ নেয়। এখানে অনেক সময়ই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ভিকটিম করার চেষ্টা চলে।

ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে গত ১৭ মার্চ সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামে হামলা চালিয়ে হিন্দুদের অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি ভাঙচুর করা হয়। এ ঘটনায় ৫০ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও দেড় হাজার মানুষের বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়। এরপরই শুরু হয় ধরপাকড়। তখনও গ্রেফতার এড়াতে পালিয়ে যেতে থাকেন পুরুষরা। একটি টেলিভিশন চ্যানেলের খবরে কয়েকজন ভুক্তভোগী নারীর বক্তব্য প্রচারিত হয়েছে এরকম: ‘চাইট্টা পাঁচটা দিন ধইরা পেটে কোনও দানাপানা নাই। ইয়ের পরে তারার বাপ যে কোন দেশে আছে তারও খোঁজ নাই। চুলাত এখন পর্যন্ত আগুন ধরছে না। কে যে কেমনে দিয়া গেছে কোনও খবর নাই। অহন আমরা কী কইরা চলতাম। কী কইরা খাইতাম। তারা অপরাধ না কইরাও অপরাধী।’

এ সময় গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়:  ‘গ্রেফতার এড়াতে পুরুষশূন্য শাল্লার তিন গ্রাম। বন্ধ মসজিদ-মাদ্রাসা। স্বামী-সন্তান কোথায়-কীভাবে আছে খোঁজ নেই কারও কাছে। খাবার সংকট আর আতঙ্ক নিয়ে শিশু ও নারীদের রাত কাটছে নির্ঘুম।’

একটি অদ্ভুত ঘটনার খবর শিরোনাম হয় গত ২০ ফেব্রুয়ারি। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার পঞ্চক্রোশী ইউনিয়নের পূর্ব বেতবাড়িয়া গ্রামে এক তরুণীর মৃত্যু হয় লিভার ক্যানসারে। জানাজার সময় মেয়ের পক্ষ ছেলের পরিবারের বিরুদ্ধে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ তোলে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই পরিবারের লোকজনের মধ্যে হাতাহাতি হয়। মেয়ে পক্ষ থানায় অভিযোগ করলে দুই পক্ষের লোকজন নিয়ে থানায় মীমাংসার জন্য ডেকে পাঠান উল্লাপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)। কিন্তু রাত বেশি হওয়ায় তখন থানায় যাননি কেউ। ওসির ডাকে সাড়া না দেওয়ার খেসারত দিতে শুরু হয়।

হাতাহাতির ঘটনায় কোনও পক্ষ অভিযোগ বা মামলা না করলেও শুরু হয় আটক বাণিজ্য। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, রাত হলেই ওসি পুলিশ নিয়ে গ্রামে হানা দেন। যাকে পান, তাকেই ধরে নিয়ে যান থানায়। এরপর ছাড়িয়ে আনতে হয় টাকা দিয়ে। অথচ কারও বিরুদ্ধে নেই কোনও মামলা। আটকের ভয়ে গ্রামটি পুরুষশূন্য হয়ে যায়। যদিও সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ওসি দাবি করেন, আটক বাণিজ্যের অভিযোগ মিথ্যা।

কিন্তু পুলিশের এই দাবি কি নিঃশর্তভাবে সাধারণ মানুষ মেনে নেয়?

রংপুরের হারাগাছ থানার পুলিশও বলেছিল, আটকের পরে হার্ট অ্যাটাকে তাজুলের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ এটা বিশ্বাস করেনি। তাদের অভিযোগ, পুলিশি নির্যাতনে তার মৃত্যু হয়েছে। রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি মানুষের এই অনাস্থা ও অবিশ্বাস একদিনে তৈরি হয়নি বা কোনও একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে হয়নি। এর পেছনে রয়েছে বছরের পর বছর ধরে চলে আসা সিস্টেম এবং অসংখ্য ঘটনা ও কারণ। ফলে সত্যি সত্যিই যদি হারাগাছের তাজুলের হার্ট অ্যাটাকেই মৃত্যু হয়েও থাকে, সেটি মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না।

এই বিশ্বাস ও আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য জনগণের প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আচরণে যে ধরনের পরিবর্তন আনা প্রয়োজন; আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন এবং তাদের দিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে নানাবিধ অনৈতিক কাজ করানোর প্রবণতা বন্ধ করা প্রয়োজন—যে কাজগুলো সব সরকারের আমলেই হয়ে থাকে। অর্থাৎ পুলিশকে এমন একটি বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা দরকার, যাতে রাষ্ট্রের যেকোনও দল মত পেশা ও অবস্থানের মানুষ বিপদাপন্ন হলে বা কোনও প্রয়োজনে নির্ভয়ে নিকটস্থ থানায় গিয়ে সহায়তা চাইতে পারে। পুলিশ বা থানা যে আতঙ্কের বিষয় নয়, সেই বিশ্বাস ও বোধ রাষ্ট্রের প্রান্তিক মানুষের মনেও গেঁথে দেওয়া দরকার। কিন্তু মুশকিল হলো, পুলিশ যদি সত্যি সত্যিই মানুষের বন্ধুতে পরিণত হয়, তখন সেই বাহিনীকে আর রাজনৈতিক বা আদর্শিক প্রতিপক্ষ তথা ভিন্ন মতের অনুসারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের 'পেটোয়া বাহিনী' হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। তার মানে জনগণের মন থেকে পুলিশভীতি দূর করা তথা পুলিশের ওপর মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস তৈরির জন্য যে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির প্রয়োজন—সেখানে আরও অনেক পথ হাঁটার বাকি আছে।

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ