X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

কলেজের জিনিসপত্র না কিনেই কোটি টাকা আত্মসাৎ

সুমন সিকদার, বরগুনা
০৯ নভেম্বর ২০২১, ২০:৩১আপডেট : ০৯ নভেম্বর ২০২১, ২০:৩১

বরগুনার বেতাগী সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মো. নুরুল আমিনের বিরুদ্ধে কলেজের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে কলেজে সরকারি বরাদ্দের বিভিন্ন খাত থেকে ও নানা অজুহাতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রায় কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে। 

অধ্যক্ষ মো. নুরুল আমিন ২০১৬ সালের ১১ জুলাই বেতাগী সরকারি কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। চলতি বছরের ১১ আগস্ট তিনি বেতাগী সরকারি কলেজ থেকে বদলি হয়ে পটুয়াখালী সরকারি কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। নুরুল আমিন বদলি হওয়ার পর নতুন অধ্যক্ষ যোগদান করলে অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি আলোচনায় আসে।   

বেতাগী উপজেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, গত ২০১৭-২০১৮ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরের জুন মাস পর্যন্ত বেতাগী সরকারি কলেজে বইপত্র ও সাময়িকী কেনা বাবদ দুই লাখ ৪০ হাজার, টেলিফোন বিল বাবদ ৩৫ হাজার, ইন্টারনেট, ফ্যাক্স ও টেলেক্স বাবদ এক লাখ ২০ হাজার, কম্পিউটার কেনা বাবদ এক লাখ ৫৩ হাজার, কম্পিউটার মেরামত বাবদ এক লাখ, ক্রীড়াসামগ্রী কেনা বাবদ দুই লাখ ১৫ হাজার, ডাক বাবদ ১৯ হাজার, ভ্রমণব্যয় বাবদ তিন লাখ, গবেষণা সরঞ্জামাদি কেনা বাবদ ১০ লাখ ৫০ হাজার, শিক্ষা ও শিখন উপকরণ কেনা বাবদ দুই লাখ ৩০ হাজার, অনুষ্ঠান ও উৎসাবদি বাবদ ৯০ হাজার, রাসায়নিক দ্রব্যাদি কেনা বাবদ সাত লাখ ৫০ হাজার, ব্যবহার্য সামগ্রী কেনা বাবদ দুই লাখ ১৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ ছাড়া ভূমি উন্নয়ন কর বাবদ এক লাখ ২৫ হাজার ও পৌরকর বাবদ ১৮ লাখ ৯৫ হাজার টাকা সরকারি বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যে ভূমি উন্নয়ন ও পৌরকরের টাকা পরিশোধ করলেও সরেজমিনে বাকি খাতের জিনিসপত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি।

কলেজে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে সম্প্রতি একটি কক্ষে স্টোর রুম করা হয়েছে। ২০১৭-১৮ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরের সরকারি বরাদ্দের একটি স্টক রেজিস্টার খোলা হয়েছে। কিন্তু স্টক রেজিস্টারের কোনও জিনিসপত্র কলেজের স্টোর রুমে পাওয়া যায়নি।

নতুন অধ্যক্ষ আবদুল ওয়ালিদকে সঙ্গে নিয়ে স্টক রুমে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকটি বই-খাতা এবং দুটি ক্যারামবোট ছাড়া কিছুই নেই। পাশাপাশি কেনাকাটায় বরাদ্দকৃত জিনিসপত্র স্টোর রুমে পাওয়া যায়নি।

কলেজের দায়িত্বশীল একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ওই স্টক রুমটি নতুন। অধ্যক্ষ নুরুল আমিনের বিরুদ্ধে বরাদ্দ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠার পর স্টোর রুম ও নতুন খাতা কিনে স্টক রেজিস্টার করা হয়েছে। কেনাকাটা কমিটি করে বাসায় বাসায় গিয়ে স্টক রেজিস্টারের জন্য জিনিসপত্র কেনা হয়েছে মর্মে সিল স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে দুই জন শিক্ষকের সিল ছাড়া স্বাক্ষর নেই। এই কাজটি করেছেন সাবেক অধ্যক্ষ নুরুল আমিনের ঘনিষ্ঠজন কলেজের হিসাব সহকারী দীপক কুমার গুহ।

মালামাল কেনার বিল-ভাউচার চাইলে দীপক কুমার গুহ বলেন, ওসব এজিতে জমা আছে, আপনি সেখান থেকে দেখে নেন। কলেজের হিসাব শাখার কপি দেখতে চাইলে তিনি দেখাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

চার অর্থবছরে বইপত্র ও সাময়িকী কেনা বাবদ দুই লাখ ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও গ্রন্থাগারে কোনও বই পাওয়া যায়নি। কলেজের সহকারী গ্রন্থগারিক রওশন আরা মালতী বলেন, গত চার অর্থবছরে কোনও বইপত্র কেনা হয়নি। বইপত্র ক্রয় বাবদ কোথাও আমার স্বাক্ষর নেই।

বিজ্ঞান বিভাগের গবেষণা সরঞ্জামাদি ক্রয় বাবদ ১০ লাখ ৫০ হাজার এবং রাসায়নিক দ্রব্যাদি ক্রয় বাবদ চার অর্থবছরে সাত লাখ ৫০ হাজার সরকারি বরাদ্দ দেওয়া হলেও বিজ্ঞানাগারে ব্যবহারের, পরীক্ষার জন্য কোনও রাসায়নিক দ্রব্য কেনা হয়নি। 

বিজ্ঞানাগারের দায়িত্বে থাকা বেতাগী সরকারি কলেজের পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক (সদ্য অবসরপ্রাপ্ত) রোহিতোষ চন্দ্র দে বলেন, গত চার বছরে বিজ্ঞানাগারের জন্য কোনও মালামাল কেনা হয়নি। বিজ্ঞানাগারের পুরোনো যন্ত্রপাতি দিয়ে ব্যবহারিক পরীক্ষা চালানো হয়েছে। আমি বিজ্ঞানাগারের মালামাল কেনার কোনও বিলে স্বাক্ষর করিনি।

ক্রীড়া সরঞ্জামাদি কেনা বাবদ চার বছরে কলেজে বরাদ্দ দেওয়া হয় দুই লাখ ৩৫ হাজার টাকা। কিন্তু বাস্তবে কলেজে কোনও ক্রীড়াসামগ্রী পাওয়া যায়নি। 

শরীর চর্চা বিষয়ক শিক্ষক মিজানুর রমহান মজনু বলেন, গত চার বছরে কোনও ক্রীড়াসামগ্রী কেনা হয়নি। শিক্ষার্থীরা খেলাধুলার জন্য ক্রীড়াসামগ্রী চাইলেও আমি দিতে পারিনি। তাদের নিজ অর্থায়নে কিনে আনতে বলেছি। অধ্যক্ষের কাছে বরাদ্দের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি ক্রীড়া সংস্থা থেকে ক্রীড়াসামগ্রী এনে চালিয়ে নিতে বলতেন।

ঠিক একইভাবে কম্পিউটার কেনা বাবদ এক লাখ ৫৩ হাজার ও কম্পিউটার মেরামত বাবদ এক লাখ, টেলিফোন বিল বাবদ ৩৫ হাজার, ইন্টারনেট, ফ্যাক্স ও টেলেক্স বাদদ এক লাখ ২০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু কলেজে একটি মাত্র টেলিফোন। তাও চার বছর ধরে অচল অবস্থায় পড়ে আছে। নতুন অধ্যক্ষ সেটিকে মেরামত করে সম্প্রতি চালু করেছেন। 

কলেজের অফিস সহকারী মিজানুর রহমান বলেন, চার বছরে কোনও কম্পিউটার কেনা কিংবা মেরামত করা হয়নি। নিজের প্রয়োজনে ইন্টারনেটের একটি মোডেম কিনে নিজ খরচে ব্যবহার করি। মেইলে তথ্য আদান-প্রদানের কারণে, ডাক, টেলেক্স ও ফ্যাক্স; এসবের কিছুই ব্যবহার করা হয়নি।

এ ছাড়া করোনার কারণে বন্ধ থাকায় কলেজে অনুষ্ঠান ও উৎসব এবং কোনও ভ্রমণ ব্যয় হয়নি। এসব খাতের বরাদ্দের অর্থ পুরোটাই আত্মসাৎ করেছেন সাবেক অধ্যক্ষ নুরুল ইসলাম।

সরকারি বরাদ্দের বাইরেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে চার বছরের মোটা অংকের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে নুরুল আমিনের বিরুদ্ধে। যোগদানের পর থেকেই তার বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সেশন ফি, ভর্তি ও প্রবেশপত্রসহ অভ্যন্তরীণ এবং ব্যবহারিক পরীক্ষার নামে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগ ওঠে। 

২০১৭ সালের ৯ জুলাই অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগে এনে তাকে অপসারণের দাবিতে বেতাগী কলেজের শিক্ষার্থীরা উপজেলা পরিষদের সামনে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন।

কলেজ থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৭-২০১৮ সেশন থেকে ২০২০-২০২১ সেশনে দুই হাজার ৮২১ শিক্ষার্থী শুধুমাত্র উচ্চ মাধ্যমিকে অধ্যয়ন করেছেন। কলেজের বর্তমান ও সাবেক একাধিক শিক্ষার্থী জানান, তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে নবায়ন অধিভুক্তি ফি বাবদ ২০০ টাকা করে নেওয়া হয়েছে। এতে দুই বছরে নেওয়া হয়েছে ১১ লাখ ২৮ হাজার টাকা। 

অফিস সহকারী মিজানুর রহমান জানান, চার বছরের এই বাবদ বোর্ডে জমা দেওয়া হয়েছে ১০ হাজার টাকা। বাকি টাকা কোথায় এ প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি কলেজে সদ্য যোগদান করা অধ্যক্ষসহ কোনও শিক্ষক। 

এ ছাড়া ভর্তি বাবদ বোর্ডের নির্দেশনা অনুসারে এক হাজার টাকা নেওয়ার কথা থাকলে ৪৩টি খাত দেখিয়ে দুই হাজার ৩০০ টাকা করে আদায় করা হয়েছে। এর বাইরে ভর্তি ফরম বাবদ আদায় করা হয় আরও ১৫০ টাকা। সে হিসাবে চার বছরে ৬৯ লাখ ১১ হাজার ৪৫০ টাকা আদায় করা হয়েছে, আর এই থেকে বোর্ডে জমা দেওয়া হয়েছে ২৮ লাখ ২১ হাজার টাকা। বাকি ৪৬ লাখের বেশি টাকা আদায় করা হয়েছে কলেজের বিভিন্ন উন্নয়ন ফান্ডের খাত  দেখিয়ে। কিন্তু ওসব খাতের অনুকূলে উন্নয়ন ব্যয়ের কোনও তথ্য দেখাতে পারেনি কলেজ কর্তৃপক্ষ।

কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ আবদুল ওয়ালিদ বলেন, আমি সদ্য যোগ দিয়েছি। গত চার বছরের বরাদ্দ ও ব্যয়ের হিসাব সম্পর্কে কিছুই বলতে পারবো না। তবে যদি কেউ যদি সরকারি বরাদ্দের অর্থ আত্মসাত করে তা নিরীক্ষায় বের হয়ে আসবে। আমি চেষ্টা করছি, কলেজ সঠিক নিয়মে পরিচালনার জন্য।

অভিযোগের বিষয়ে বেতাগী সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মো. নুরুল আমিন বলেন, ক্রয় কমিটির মাধ্যমে আমি বরাদ্দের অর্থ খরচ করেছি। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে জোর করে টাকা আদায় করা হয়নি। তবে এত বড় প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে গিয়ে একটু এদিক-সেদিক করতে হয়।

এ বিষয়ে বরিশাল শিক্ষাবোর্ডের কলেজ শাখার পরিদর্শক ড. লিয়াকত হোসেন বলেন, অধ্যক্ষ নুরুল আমিনের বিরুদ্ধে যদি অর্থ আত্মসাতের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে তবে বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

/এএম/
সম্পর্কিত
জয়পুরহাটে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও চট্টগ্রামে কাস্টমসে দুদকের অভিযান
‘দুর্নীতিবাজ’ সেই মাদ্রাসা শিক্ষকের বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে
চাঁদপুর ও ময়মনসিংহে দুদকের অভিযান
সর্বশেষ খবর
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অ্যাসেম্বলি বন্ধ
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অ্যাসেম্বলি বন্ধ
দ্বিতীয় বিয়ের চার দিন পর বৃদ্ধকে হত্যা, দুই ছেলে পলাতক
দ্বিতীয় বিয়ের চার দিন পর বৃদ্ধকে হত্যা, দুই ছেলে পলাতক
লখনউ ও চেন্নাইয়ের অধিনায়ককে ১২ লাখ রুপি জরিমানা 
লখনউ ও চেন্নাইয়ের অধিনায়ককে ১২ লাখ রুপি জরিমানা 
বিদ্যুৎস্পৃষ্টে প্রাণ গেলো ইউপি সদস্যের
বিদ্যুৎস্পৃষ্টে প্রাণ গেলো ইউপি সদস্যের
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
দেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
সিনেমা সমালোচনাদেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা