X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

জ্বালানির জ্বালা, দ্রব্যমূল্য ও পকেটে টান

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
১০ নভেম্বর ২০২১, ১৭:৪১আপডেট : ১০ নভেম্বর ২০২১, ১৭:৪১
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা একটি চ্যানেলের গাড়ি এসেছে তাদের টকশোতে নিয়ে যেতে। গাড়িতে বসতেই চালকের প্রথম কথা ‘স্যার আমরা বাঁচবো তো’? জানতে চাইলেই বলা শুরু করলেন-  বাজারে আগে থেকেই সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ, চাল, ডাল, চালসহ সবকিছুর দাম বেশি ছিল। এখন গাড়ি ভাড়া বাড়লো, কিন্তু আমার আয় তো বাড়লো না। তারপর সেই চিরাচরিত প্রশ্ন -আমাদের কি বাঁচার উপায় আছে? এর কোনও উত্তর নেই।

আগে তবু ভালো-মন্দ মিশিয়ে একরকম চলছিল, কোভিড-১৯ অতিমারি এসে আমাদের জীবন একেবারে তছনছ করে দিয়েছে। সেখান থেকে উত্তরণ না ঘটতেই জিনিসপত্রের দাম বাড়ার সঙ্গে যুক্ত হলো জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রতিক্রিয়ায় পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি, যা প্রকারান্তরে সব জিনিসের দাম আবার বাড়াবে। কয়েক দিন আগেই ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) একটি যৌথ জরিপের ফল প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এই মহামারিকালে বহু মানুষ কর্ম হারিয়েছেন, রুটি-রুজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর প্রভাবে দেশে নতুন করে ৩ কোটি ২৪ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছেন। করোনাকালে অভাব-অনটনে পড়ে বহু মানুষ রাজধানীসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন। গতকাল দৈনিক কালের কণ্ঠের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আরও বহু মানুষকে শহর ছাড়তে হবে।

সরকার জ্বালানি তেলের (ডিজেল ও কেরোসিন) দাম বাড়ানোয় চতুর্মুখী চাপে পড়েছে সাধারণ মানুষ। দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত তো বটেই, সত্যি বলতে কী, মধ্যবিত্ত পড়ে গেছে এক চরম অনিশ্চয়তায়। কারণ, আয়ের ভিতটা এদের মজবুত নয়। কারও চাকরি চলে গেছে, অর্ধেক হয়ে গেছে কারও বেতন, আর যাদের এখনও সেসব হয়নি, তাঁদের মধ্যে অনেকেই আসন্ন সর্বনাশের আশঙ্কায় সিঁটিয়ে রয়েছেন। দেশের সব মানুষের মধ্যে একটা সামান্য অংশ অবশ্য আছেন, যাদের চাকরি চলে যাওয়ার বা মাইনে কমার ভয় নেই। তাদের সিংহভাগই সরকারি চাকুরে। ধাক্কাটা অতি দরিদ্র মানুষ তো পেয়েছেই, মধ্যবিত্তের ওপরও কম পড়েনি।

চিত্ত বিনোদন পরে, আহার, বাসস্থান, পরিবহন, বাচ্চাদের স্কুল সব মিলিয়ে একটা মধ্যবিত্ত জীবনযাপন করতে গেলে কত টাকার দরকার এখন আর সে হিসাব কেউ করতে পারছে না। কারণ, আয়ের পথ প্রশস্ত নয়। কোভিড অতিমারি এমন একটা অঘটন, যার ওপর আমাদের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই দুঃসময়ে সরকার কী করে জ্বালানি ডিজেল এবং কেরোসিনের দাম বাড়ায়? গত পাঁচ বছরে জ্বালানি তেলের দাম যখন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল তখন কমায়নি। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে অযাচিত মুনাফার সুযোগ দিয়েছিল সরকার জনগণের পকেট থেকে টাকা নিয়ে। এই সময়ে বিপিসি লাভ করেছে ৪৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এখন সামান্য ঊর্ধ্বগতি দেখেই দাম বাড়িয়ে দিলো, যার সুযোগ পুরোটাই নিলেন পরিবহন খাতের ব্যবসায়ীরা। তারা তাদের খুশি মতো ভাড়া বাড়িয়ে জনগণ থেকে ইচ্ছেমতো আদায় করছে। পাশের দেশে পাচার হয়ে যায় এমন যুক্তিও কেউ কেউ দিচ্ছেন যে পাচার রোধ করা যাদের দায়িত্ব তাদের ব্যর্থতার দায়ও মানুষেরই।

কোন বিবেচনায়, কেন বাড়ানো হলো ডিজেল ও কেরোসিনের দাম, এর কোনও স্বচ্ছ ব্যাখ্যা নেই কোথাও। বলা হচ্ছে সিএনজি চালিত পরিবহনের ভাড়া বাড়বে না। কিন্তু সেটা তদারকি করবে কে? আমরা জানতাম বেশিরভাগ বাস ও মিনিবাস, টেম্পু চলে সিএনজিতে। এখন বলা হচ্ছে, না সবই নাকি চলে ডিজেলে।  আমি নিশ্চিত, কাল যদি সরকার সিএনজির দাম বাড়ায়, আবার পরিবহন মালিকরা জনগণকে জিম্মি করে বলবেন সব গাড়ি চলে সিএনজিতে এবং সরকারও তাদের দাবি মেনে নেবে। মানবে, কারণ তাদের পেশিশক্তি আছে ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌নৈরাজ্য করার এবং এই নৈরাজ্যর প্রতি সমর্থন আছে ক্ষমতা কাঠামোর।

এই কয়দিন যা ঘটলো, তাতে একটি বিষয় পরিষ্কার, শাসন প্রণালির কোনও স্তরেই মানুষের ভাবনা নেই। স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হয়ে গেলো, এত পরিবর্তন, কিন্তু জ্বালানি তেল দাম বাড়ানোর সেই পুরনো পদ্ধতি – শুক্র ও শনিবার ছুটির দিন সামনে রেখে বৃহস্পতিবার দাম বাড়িয়ে দিলো সরকার। ভাবনায় ছিল না যে শুক্রবার এত চাকরি ও ভর্তি পরীক্ষা আছে। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এই শহরে এসেছিল জীবন বাজি রেখে, সারা মাসের সঞ্চয় শেষ করে। অনেকে আসতেও পারেনি। বৃহস্পতিবার রাতেই যখন গণ ও পণ্য পরিবহন অঘোষিতভাবে পরিবহন বন্ধ করে দিলো, তখনই সরকারের দিক থেকে তাদের সঙ্গে বসা উচিত ছিল। কিন্তু সেতু মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নেতৃত্ব সেই বৈঠক করলেন তিন দিন মানুষকে কষ্টের মধ্যে রেখে, পরিবহন মালিকদের কাছে জিম্মি রেখে। মানুষের বাইরে ব্যবসায়ীরাই সব, যেন তাদের জন্যই সরকার।  

জরুরি খাবারের দাম বেড়ে যাওয়ার জ্বালায় মানুষ বহুদিন যাবৎ এমনিতেই নাজেহাল। কিছু খাবার আছে, যেগুলোর দাম সাময়িকভাবে বেড়ে গেলে তা না খেলেও চলে— একশ’ টাকা কেজি বেগুন আর ক’জনই বা খান। কিন্তু, আলু বা চালের মতো জিনিসের দাম বাড়লে খাদ্য তালিকা থেকে তা সম্পূর্ণ সরিয়ে রাখার উপায় বেশিরভাগ মানুষেরই নেই। তার বড় কারণ হলো, এগুলোই গরিব ও মধ্যবিত্তের একমাত্র খাবার। অন্য জিনিসের দাম আরও বেশি। ফলে, মধ্যবিত্তের পকেটে চাপ পড়ছে, আর গরিবের পেটে টান। এখন পরিবহন ভাড়া এমনভাবে বাড়লো, যার প্রভাব আরও ভয়ংকর হবে।

কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২০ অনুযায়ী, দেশে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬.৮৮ শতাংশ এবং বিভিন্ন পণ্য ও সেবার মূল্য বেড়েছে ৬.৩১ শতাংশ। দেশে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির এই ধারা চলতি বছর আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাজারে এমনিতেই নিত্যপণ্যের দামে আগুন। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এখন দাবানলে পরিণত হচ্ছে। বাসের ভাড়া বাড়ছে, লঞ্চের ভাড়া বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে উৎপাদন ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি পণ্য পরিবহন ব্যয় বাড়ছে। এতে যে যেভাবে পারবে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেবে।
যে হারে জ্বালানি মূল্য বাড়ানো হয়েছে, তার চেয়ে ভাড়া ও অন্যান্য ব্যয় বেশি বেড়েছে। এতে নিম্ন আয়ের মানুষের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের ব্যবধান বাড়বে। ডিজেল যেহেতু এনার্জি সোর্স, কাজেই অনেক জায়গায় খরচ বাড়বে। সামনে বোরো মৌসুম। ডিজেলের কারণে সেচের খরচ বাড়লে কৃষি খাতেও প্রভাব পড়বে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় এর বহুমুখী প্রভাব পড়বে। গণপরিবহন, কৃষি উৎপাদন, পণ্য পরিবহন ব্যয়ের সঙ্গে বাড়ি ভাড়াও বাড়বে। এমনকি রিকশা ভাড়াও বাড়বে। গত কয়েক মাসে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী ছিল। এখন সামগ্রিকভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়ার আশঙ্কা হচ্ছে। মানুষকে বাঁচাতে সরকারকে পথ খুঁজতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
নায়কের জন্মদিনে নায়িকারা...
নায়কের জন্মদিনে নায়িকারা...
মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র আধুনিকায়নে কাজ করবে জাইকা ও বিএফডিসি
মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র আধুনিকায়নে কাজ করবে জাইকা ও বিএফডিসি
ট্রেনের ৪৫ হাজার টিকিট কিনতে দেড় কোটির বেশি হিট
ট্রেনের ৪৫ হাজার টিকিট কিনতে দেড় কোটির বেশি হিট
নোয়াখালীতে সনি স্মার্ট-এর শোরুম উদ্বোধন
নোয়াখালীতে সনি স্মার্ট-এর শোরুম উদ্বোধন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ