X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

এক ভিন্নরকম তারকা ডা. কামরুল ইসলামকে কয়জন চেনেন?

ডা. জাহেদ উর রহমান
১১ নভেম্বর ২০২১, ১৮:২২আপডেট : ১১ নভেম্বর ২০২১, ১৮:২২
ডা. জাহেদ উর রহমান স্রেফ চামড়া দিয়ে তৈরি একটা হার্মেস বারকিন ব্যাগের মূল্য শুরু হয় ৩৫-৪০ লক্ষ টাকা থেকে। আর সঙ্গে যদি কিছু গোল্ড বা ডায়মন্ড যুক্ত থাকে তাহলে সেটার মূল্য কোটি থেকে কয়েক কোটি টাকা হতে পারে। এই মূল্যের একটা ব্যাগের কিছু ব্যবহারিক উপযোগিতা তো আছে নিশ্চয়ই। কয়েকশ’ টাকার ব্যাগে যা যা রাখা যায়, কোটি টাকার ব্যাগে অন্তত সেটুকু রাখা তো যায়ই। এদিক থেকে আরও অদ্ভুত জিনিস হচ্ছে লাক্সারি ঘড়ি।

প্যাটেক ফিলিপ, ভ্যাসেরন কনস্ট্যান্টিন, অওদিমার পিগে ব্র্যান্ডের একটা হাই অ্যান্ড মেকানিক্যাল ঘড়ি এক কোটি থেকে শুরু করে কয়েক কোটি টাকা হতে পারে। একেবারে স্টেইনলেস স্টিলের, হীরা বা সোনা থাকতে হবে, এমন নয় একেবারেই। আকাশচুম্বী দামের ক্ষেত্রে ব্র্যান্ড ভ্যালুর সঙ্গে এসব কোম্পানি যুক্তি দেয় এভাবে। সময় দেখানোর সঙ্গে এসব ঘড়ি কতগুলো অন্য কাজ করতে পারে (তাদের ভাষায় কমপ্লেক্সিটি) সেসবের হিসাব দেয়।

যেমন, মেকানিক্যাল একটি ঘড়িতে পার্পেচুয়াল ক্যালেন্ডার থাকতে পারে অর্থাৎ ঘড়িটি কোন মাস কত দিনের সেটা বুঝে সে নিজেই সেটা দেখাবে। এমনকি লিপিয়ারও বুঝতে পেরে সেই বছরের ফেব্রুয়ারিকে ২৯ দিন দেখাবে। এছাড়াও আছে মিনিট রিপিটারসহ নানা ফাংশন। শুধু মেকানিক্যাল প্রযুক্তি দিয়ে এই কাজগুলো করা বৈজ্ঞানিকভাবে নিশ্চয়ই অসাধারণ ব্যাপার। কিন্তু এসব তথাকথিত কমপ্লেক্সিটির প্রায় কোনোটিই নেই যেটি সারাক্ষণ আমাদের হাতে থাকা স্মার্টফোনটিতে নেই। অর্থাৎ কোটি বা তার বেশি টাকা দিয়ে কেনা একটি ঘড়ি এমন কোনও ব্যবহারিক উপযোগিতা আমাদের দেয় না, যেটি চার হাজার টাকা মূল্যের স্মার্টফোন দিতে পারে না।

বর্তমান আর্থসামাজিক ব্যবস্থা টিকে থাকে কিছু ন্যারেটিভের ওপর ভিত্তি করে। সিস্টেম আমাদের জানায় কোনও জিনিসের মূল্য বেশি কিংবা কোনটার কম। সে কারণেই একেবারে ব্যবহারিক মূল্যহীন জিনিসও ন্যারেটিভের কারণে অকল্পনীয় মূল্য ধারণ করতে পারে।

একই ঘটনা ঘটে ‘তারকা’দের নিয়ে। বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় তারকা তৈরি করতে হয়। নানাভাবে আমাদের সামনে কাউকে প্রেজেন্ট করে বলা হয় ইনি তারকা। তারপর এই তারকাকে পণ্যদূত বানিয়ে দারুণ বিক্রির উৎসব করা যায়। আর আমাদের মতো দেশে এসব তারকাকে ব্যবহার করে রীতিমতো অন্যায়ভাবে লুট করা যায় মানুষদের।

সম্প্রতি ইভ্যালি, ইঅরেঞ্জসহ বেশ কয়েকটি ই-কমার্স সাইটের মুখোশে থাকা পঞ্জি স্কিম যখন লাখ লাখ মানুষের পকেট কাটছিল তখনও এসব প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন করেছেন, ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হয়েছেন দেশের নানা সেক্টরের তারকারা। এসব পণ্যদূতকে দেখেই সেসব কোম্পানির প্রতি আস্থা রেখেছিলেন অসংখ্য ক্রেতা।

বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় তারকা হন মূলত বিনোদনকারীরা। সংগীতশিল্পী, অভিনয়শিল্পী, খেলোয়াড়রা কিংবা কখনও কখনও সাহিত্যিকরা যে মাপের তারকা হন তার কাছাকাছি পৌঁছতে পারেন না আর কেউ। এর পেছনে বড় কারণ হলো, আমরা বিনোদিত হতে পছন্দ করি, কিন্তু তার চাইতেও বড় কারণ এদেরই আমাদের সামনে তারকা হিসেবে বারবার উপস্থিত করা হয়। আমাদের জানানো হয় তারা কত কী করছেন আমাদের জন্য। এতে তাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাকে ধাপে ধাপে ভক্তির পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া গেলে কেল্লাফতে। তাদের দিয়ে কনজুমারকে পণ্য গেলানো যায় আকণ্ঠ।

এদের ভিড়ে কখনও কখনও একজন পালান সরকার, কার্তিক প্রামাণিক কিংবা হরিপদ কাপালী কালেভদ্রে আমাদের সামনে আসেন। তারা ঠিক তারকা হয়ে ওঠেন না প্রচলিত ব্যবস্থার মানদণ্ডে। কোনও কোনও পত্রিকায় কখনও কখনও রিপোর্ট হয়েছে তাদের নিয়ে। কিন্তু তারা পণ্যদূত হতে চাইতেন কিনা সেই প্রশ্ন সরিয়ে রেখেই বলতে চাই, তাদের কাউকে পণ্যদূত বানিয়ে পণ্যের প্রচারণা করা যাবে, সেটা বেশিরভাগ করপোরেট নিশ্চয়ই ভাবে না।

ডা. কামরুল ইসলাম এক হাজার কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করেছেন, যা এই দেশে হওয়া সব কিডনি ট্রান্সপ্লান্টে এক-তৃতীয়াংশ। এটা বড় খবর নিঃসন্দেহে। বাংলাদেশে এমন অসাধারণ দক্ষ একজন ইউরোলজিস্ট আছেন, এটা জাতির সক্ষমতার নির্দেশক নিশ্চয়ই। কিন্তু মূল ঘটনা সেটা নয়।

ডা. কামরুল ইসলামকে নিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থার বাংলা ভার্সন থেকে শুরু করে দেশের সব মূল ধারার প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া সংবাদ প্রকাশ করেছে। আমরা জানতে পারি অতি সামান্য টাকায় (২ লাখ) তিনি কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করেন। এই টাকার মধ্যে দাতা, গ্রহীতা দুই জনের অপারেশন, প্রয়োজনীয় ওষুধ, আইসিইউ, হাসপাতালে থাকা সবকিছু করা হয়। ভারতে এই একই অপারেশন করার খরচ ৮ থেকে ১০ গুণ।

আমাদের বিস্ময় আরও বেড়ে যায় কয়েকগুণ, যখন আমরা জানতে পারি প্রতিটি রোগী তার বাকি জীবনে যতবার রুটিন চেকআপের জন্য আসবেন তার ফি কখনও দেওয়া লাগবে না। গাড়ি না কিনে প্রাথমিকভাবে নিজের প্রতিষ্ঠান, যন্ত্রপাতি কেনার গল্প থেকে শুরু করে আর কী কী করেছেন তিনি তার বিস্তারিত পাঠকরা এখন কম বেশি জানেন। তাই তার বিস্তারিতে আর যাচ্ছি না।

ডা. কামরুল অসংখ্য সার্জারি করে ব্যবসা করতেই পারতেন। এতে অন্যায্যতার কিছু ছিল না। তার একটা দক্ষতা আছে, সেই দক্ষতা বিক্রি করে তিনি অনেক টাকা উপার্জন করতেই পারেন। কিন্তু তখন এই মানুষটি আর আমাদের শ্রদ্ধার এই জায়গাটিতে থাকতে পারতেন না।

আমাদের প্রথাগত তারকার কিন্তু আবার এই ‘বালাই’ থেকে মুক্ত। যেসব মানুষ আমাদের সমাজে তারকা হন তাদের প্রত্যেকে তার তারকা খ্যাতির সঙ্গে সঙ্গে মালিক হন প্রচুর অর্থের। সহজ ভাষায় যদি বলি তবে বলতেই হয়, তারা কেউ ‘নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ান’ না। তাই বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়ে তারা গাছেরটা যেমন খান আবার মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা পেয়ে তলারটাও কুড়ান।

হয়তো একসময় ছিল এই সমাজে বহু মানুষ পাওয়া যেত, যারা রাজনীতি বা সামাজিক নানা কাজে যুক্ত থেকে নিজের সময়, শ্রম এমনকি অর্থ ব্যয় করে মানুষের জন্য কাজ করতেন। তখনও তারা খুব বড় তারকা হয়ে উঠতেন সমাজে, তা নয়, কিন্তু শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। আর এমন একটা সমাজে এখন আমাদের বাস যখন, এসবের থোড়াই কেয়ার করি আমরা।

নানা সেক্টরের বড় বড় বিনোদনকারীরা আমাদের চোখে তারকা হয়ে ওঠেন। তাদের নানা ভোগ করার খবর আমাদের সামনে আসে। কোন তারকা জন্মদিনে কাকে কত দামি উপহার দিলেন, কোন অনুষ্ঠানে কত দামি পোশাক পরলেন, কত দামি গাড়িটা কিনলেন, কোন স্বপ্নের মতো সাজানো বাড়িতে থাকেন, এসবই আমাদের কাছে বড় খবর হয়ে ওঠে। আমাদের মধ্যবিত্তদের মনের গোপনে লালন করা এই স্বপ্নগুলোই এই তথাকথিত তারকাদের দিক থেকে আমরা দেখি। মনের কোণে খানিক ঈর্ষা থাকলেও এগুলোই আমাদের আগ্রহের জায়গা।

এই ভীষণ ডামাডোলের মধ্যে কালেভদ্রে কিছু মানুষ আছেন যাদের কাছে আমাদের প্রথাগত সব তারকাকে নিতান্ত বামন বলে মনে হয়।

একটি আন্তর্জাতিক মিডিয়ার বাংলা ভার্সনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ডা. কামরুল বলেন, ‘কোনও কাজের জন্য যদি আমি টাকা না নিই, যে সোসাইটিতে আপনি থাকেন সেই সোসাইটি আপনাকে পে করবেই একসময়। আমি এখন যে অনার পাচ্ছি, তা কি ৫ কোটি, ১০ কোটি বা ২০ কোটি টাকা দিয়ে কিনতে পারতাম। তাহলে কি আমি রিওয়ার্ডেড না?’

স্রেফ সম্মান-শ্রদ্ধা-ভালোবাসাকে রিওয়ার্ড মনে করা এই দেশের মানুষের কাছে এখন স্রেফ ‘আহাম্মকি’। এটা টাকার সমাজ, টাকাওয়ালাদের সমাজ। এর মধ্য থেকেও যখন একজন ডা. কামরুলকে আমরা খুঁজে পাই, তখন সেই মানুষটাকে যেন আমরা লালন করি শ্রদ্ধা ভালোবাসায়। খুঁজে দেখি আরও কোথায় কোথায় রয়ে গেছেন এমন সব ‘নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’ মানুষ। তাদের এনে নিজেদের, অন্যদের যেন বলি, এরাও তারকা, অন্যরকম তারকা, কিংবা একেবারে সরাসরি বলি- এরাই সত্যিকারের তারকা।

প্র্যাকটিস না করলেও আমি নিজে একজন ডাক্তার এবং ঘটনাচক্রে ডা. কামরুল ইসলাম যে প্রতিষ্ঠানে এমবিবিএস পড়েছেন, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ আমারও প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এসব মিল না থাকলেও আমি লিখতাম তাকে নিয়ে। তাদের মতো মানুষরাই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় মানুষ হিসেবে আমাদের ক্ষুদ্রতা। সঙ্গে তার মতো মানুষরা কোথাও একটা উদ্দীপনাও তৈরি করে দেন মানুষ হয়ে ওঠার।

লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইউনূস সেন্টার মিথ্যাচার করেছে, অভিযোগ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর
ইউনূস সেন্টার মিথ্যাচার করেছে, অভিযোগ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর
সীমান্তে কোনও ধরনের হত্যাকাণ্ড চায় না বাংলাদেশ
সীমান্তে কোনও ধরনের হত্যাকাণ্ড চায় না বাংলাদেশ
দুর্নীতির মামলায় মেজর মান্নান কারাগারে
দুর্নীতির মামলায় মেজর মান্নান কারাগারে
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আমাদের অবশ্যই জেতা উচিত: সাকিব
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আমাদের অবশ্যই জেতা উচিত: সাকিব
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ