X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১
হাসান আজিজুল হক

মহাপ্রস্থানের পথে

মোস্তফা তারিকুল আহসান
১৬ নভেম্বর ২০২১, ১৫:০৯আপডেট : ১৬ নভেম্বর ২০২১, ১৫:০৯

কবি ও কথাসাহিত্যিক আবুবকর সিদ্দিক হাসান আজিজুল হক সম্পর্কে এক নিবন্ধ লিখেছিলেন—হাসান আজিজুল হক : বর্ধমান থেকে ক্রমবর্ধমান। আমরা জানি তিনি সত্যি সৃজনশীলতা মনন প্রজ্ঞা প্রত্যয় ও বোধে বিবর্ধিত হতে হতে চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছেছিলেন। পরিপূর্ণ বিকশিত আলোকিত মানুষ হতে পেরেছিলেন সব দ্বিধা ও বাঁধা পেরিয়ে। তবে ক্রমবর্ধিত হতে হতে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন সেটি আমরা কখনো চাইনি। মনে হয় তিনি আমাদের মাঝে এখনো আছেন—সদা হাস্যময়, সতত প্রেরণার উৎস, আড্ডাপ্রিয়, জ্ঞানে চেতনায় ঋদ্ধ আমাদের প্রিয় কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। গতকাল রাতে দেখলাম তাঁর নিথর দেহ সাদা কাপড়ে ঢাকা, তাঁর তৈরি করা বাড়ি উজানে, কথার জাদুকর, বাংলা ভাষাকে যিনি দুহাতে শাসন করেছেন, সমৃদ্ধির প্রতিটি পর্ব আবিষ্কার করেছেন তিনি তাঁর বাড়িতে অজস্র মানুষের সমাগম দেখেও কোনো কথা বলছেন না; কাউকে তিনি হাস্যকৌতুকে প্রলুব্ধ করছেন না। আমরা যারা প্রায়শ তাঁর সাথে গল্প করতাম, তাঁর সাথে শেষ আড্ডা দিতেই যেন গেলাম যা একপাক্ষিক এবং মর্মান্তিক।

হাসান আজিজুল হক (১৯৩৯-২০২১) বাংলা ভাষার প্রধান লেখক, সেরা কথাসাহিত্যিক। তিনি কথাসাহিত্যকে এমন উচ্চতায় নিতে পেরেছিলেন যে তাকে চূড়ান্ত শৈল্পিক সফলতা হিসেবে মানেন বাংলা ভাষার পাঠক ও বোদ্ধারা। গল্প-উপন্যাসের বাইরে তাঁর সৃজনশীল ও বিশ্লেষণী গদ্য তাঁকে শক্তিমান গদ্যলেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কথাকোবিদের গদ্য যে কত চমৎকার হতে পারে তা হাসানের গদ্য না পড়লে বোঝা যাবে না। বাংলা ভাষা কত শক্তিশালী হতে পারে সেটি হাসান প্রমাণ করেছেন তাঁর রচনার মধ্যদিয়ে। অনুবাদ, শিশু সাহিত্য, আত্মজীবনীতে তিনি নিজের জাত চিনিয়েছেন। উপন্যাসের সংখ্যা কম হলেও তিনি সেখানে তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য, আত্মজা ও একটি করবী গাছ, জীবন ঘষে আগুন, নামহীন গোত্রহীন, পাতালে হাসপাতালে, আমরা অপেক্ষায় আছি, রোদে যাবো—এসব তাঁর অমর গল্পের বই। এক একটি গল্প আমাদের মর্ম ছুঁয়ে যায়, আমরা নতুন জীবন পাই, নতুন ঋদ্ধ চেতনায় আমাদে প্রভাত হয়; বাংলার মানুষের যাপিত জীবনের গভীর বেদনা সংবেদ দুঃখ আবেগ ও শাশ্বত বোধকে তিনি বেধে ফেলেন তাঁর কথার জাদুতে তীব্র ব্যঞ্জনায়। দুই বাংলার গল্পকে বিবেচনায় নিয়ে খুব স্পষ্ট করে বলা যায় যে গভীরতা ও ব্যঞ্জনায় তিনি জীবনের যে ভাষ্যরূপ আমাদের সামনে হাজির করেছিলেন তা আর কেউ করতে পারেননি। তাঁর নিজস্বতার রং চিনতে হয় না তা হৃদয়ে প্রোথিত হয়, মননের গভীরে স্থায়ী ঠিকানা খুঁজে নেয়। এক একটি চরিত্র তার যাবতীয় খুঁটিনাটি নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়, তারা হাঁটে, দৌড়ায়, কাঁদে, হাসে, বিমর্ষ হয় আর বাংলার জল হাওয়ায় মিশে বাঙালির চিরন্তন আততিকে প্রকাশ করে। মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে বাংলার বা বাংলাদেশের সামূহিক সামাজিক সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক ধর্মীয় জীবনের নানাবিধ পরিবর্তনের ধারা, ক্ষয়, অবনমন, অন্যায়, অসংস্কৃত আচারকে তিনি গল্পের মধ্যে নিখুঁতভাবে আঁকতে পেরেছিলেন; বাঙালির সত্তা ও দর্শন, মানবতা, প্রগতিশীলতা, অসাম্প্রদায়িকতা, সামাজিক সাম্যকে তিনি চরিত্রের মধ্যে চারিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর নিজস্ব প্রয়োগিক কৌশলে। এক অসামান্য প্রতিভার বিচ্ছুরণ পাওয়া যায় তাঁর রচনায়, তার সাথে পাওয়া যায় তাঁর চিন্তার গভীরতা, মননের প্রাখর্য, মানবতার পক্ষে সাধারণ মানুষের পক্ষে সুদৃঢ় অবস্থান।

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনের পক্ষে যাবতীয় আন্দোলন, প্রতিরোধ আন্দোলনে তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি অসীম সাহসী ছিলেন। স্বাধীনতা বিরোধীরা তাঁকে তুলে নিয়ে বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দেবার হুঙ্কার দিয়েছিলেন। তখন এই চক্র ক্ষমতায়, তবু তিনি ভয় পাননি, তাঁর লেখা বন্ধ হয়নি, তাঁর প্রতিরোধী কাজ বন্ধ হয়নি। লেখকের কাজ শুধু লিখে যাওয়া নয়, মানবিক দেশের জন্য লড়াই করা তার প্রধান কাজ, সেই সত্য তিনি মানতেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী শহরের প্রতিটি আন্দোলনে তিনি যোগ দিতেন, প্রতিবাদী বক্তৃতা করতেন। হাসান আজিজুল হক একটি প্রগতিশীল, আধুনিক, গণতান্ত্রিক, উদার সংস্কৃতবান সভ্য রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতেন, তার পক্ষে লড়াই করাকে নিজের কর্তব্য বলে মনে করতেন।

একজন মহান লেখকের যাবতীয় গুণ ছিলো হাসান আজিজুল হকের : আমার তাঁর কাছাকাছি থেকে যা দেখেছি, শুনেছি তা নিয়ে বিস্তারিত বলার সুযোগ রয়েছে। তিনি অনেকের লেখা নিয়ে কথা বলতেন। নিজের লেখা নিয়ে তেমন কিছু বলতেন না, আমরা পড়েছি কি না জিজ্ঞাসা করতেন কখনো কখনো। তাঁর লেখার সমালোচনা করলেও তা সহ্য করতেন। আগুনপাখি বের হবার পর আমি একটা দীর্ঘ সমালোচনা লিখি, স্যারের বাসায় সবার সামনে লেখাটি পাঠ করি। রাঢ়বঙ্গের ভাষা নিয়ে আমি সমালোচনা করেছিলাম, স্যার বিনয়ের সাথে বললেন তোমার কথা তোমার। আমার তো মাতৃভাষা ভুল হবার কথা নয়। জীবনের অনেক কষ্ট তিনি সহ্য করেছেন হাসি মুখে। সদা হাস্য মুখের মানুষ হাসান স্যার পত্নীর বিয়োগে ভেঙে পড়েছিলেন। সেই শোক বোধ হয় তিনি সামলাতে পারেননি। তবে আমাদের সাথে হাসিমুখে কথা বলতেন। নানা বিষয়ে নিয়ে গল্প করতেন। তিনি একা থাকতে পারতেন না। দল দল মানুষ তাঁর বাসায় যাবেন, চা নাশতা খাবেন, গল্প হবে, স্যার হো হো করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়বেন এটাই রীতি হয়ে হয়ে গিয়েছিল। মাঝে মাঝে বলতেন তোমার খালাম্মা তো নেই, কী আর খাওয়াবো, বিস্কুট খাও, চা খাও। দেবী শেঠির কাছে হার্টের চিকিৎসা চলছিল এক সময়। ডাক্তার বলেছিলেন, হার্টে ব্লক আছে, অপারেশন করতে হবে। কিছুদিন পর চেক করে অপারেশন করবেন। চেক বা অপারেশনের জন্য তিনি ডাক্তারের কাছে গেছেন। ফেরার পরে আমি ফোন করলাম, স্যার কি খবর? স্যার হো হো করে হাসেন। আমি বললাম, হাসেন কেন? স্যার বললেন, জান কি হয়েচে? হাসি দিতে দিতে নাকি আমার ব্লক ছুটে গেছে। ডাক্তার বলেছে, মিরাকল, আপনার ব্লক আর নেই।

আনন্দ পুরস্কার পেলেন স্যার আগুনপাখির জন্য। স্যার বললেন, তারিক জানো, অনেক টাকা। আমি বললাম, তাহলে তো আমিও ভাগ পাই। স্যার, হো হো করে হেসে উঠলেন, সে তো বটেই, তুমি তো প্রথম লিখলে আগুনপাখি নিয়ে। অজস্র মজার ঘটনা রয়েছে তাঁকে নিয়ে আমার, পরে কখনো বিস্তারিতভাবে লিখব। দেখা হলেও স্যার বলতেন কি লিখছে হে? আমাদের সৌভাগ্য যে স্যার আমাদের লেখা পড়তেন। কা আ তরুবর নামে একটি গল্প কালি ও কলমে ছাপা হবার কিছুদিন পর স্যারের বাসায় গিয়েছি নিয়মিত আড্ডা দিতে। স্যার দরজা খুলেই বললেন, কি হে কাআ তরুবর।

বাংলা সাহিত্যের কথাসাহিত্যের জাদুকর হাসান আজিজুল হক আমাদের মাঝে নেই। ভাবাও কঠিন মনে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী থেকে বিভিন্ন জন শোক প্রকাশ করেছেন। আমরা কি শোক প্রকাশ করব। আমরা এত কাছাকাছি ছিলাম যে সব সময় তাঁর উচ্চতা হয়তো বুঝতে পারতাম না। তবে তিনি আমাদের হৃদয়ে ছিলেন সতত তা বুঝতাম, এখন বুকের হাহাকার শুনে টের পাচ্ছি তাঁর অস্তিত্ব—কত প্রগাঢ়, কত মহামহিম, কত নিবিড়। সাড়ে ৯টার একটু পরে গিয়ে দেখি উজানে লোকে লোকারণ্য, কাছের লোকজন সবাই এসেছেন, সাংবাদিকেরা লাইভে যাচ্ছেন, সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন, ছবি তুলছেন। ধীরে ধীরে মানুষের ভিড় উজিয়ে মৃত হাসান আজিজুল হকের কাছে গেলাম—কোনো হাসি নেই, গল্প নেই, চায়ের কাঁপের ধোঁয়া নেই। গম্ভীর নিঃস্তব্ধ পাথর চোখে তিনি তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। কারো সাথে কোনো কথা বলার শক্তি পেলাম না। মৌলি আমাকে দেখে কেঁদে ফেলল, আমি ওকে জাপটে ধরে অভয় দেবার বৃথা চেষ্টা করলাম। শুধু সাংবাদিকদের ভিড়, ক্যামেরার ভিড়, মানুষটাকে নিয়ে, লেখক হাসান আজিজুল হককে নিয়ে একটাই খবর—তিনি নেই। সেই খবর দিকে দিকে রটিয়ে দেওয়া হচ্ছে যত দ্রুত পারা যায়। আর কোনো তাড়া কি আছে? যারা কাঁদছে তাদের খবর নেবে না কেউ? বাংলা গল্পের কি হবে সে খবর নেবে নে কেউ? সুমন কোথায় কাঁদছে, সূচি কোথায়? তোতনের কী হবে? সে তো ভালো করে কিছু বলতেই পারে না।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সৌন্দর্যের সংজ্ঞা বদলাতে চান ম্রুনাল
সৌন্দর্যের সংজ্ঞা বদলাতে চান ম্রুনাল
পিএসজির অপেক্ষা বাড়িয়ে দিলো মোনাকো
পিএসজির অপেক্ষা বাড়িয়ে দিলো মোনাকো
অস্ট্রেলিয়ার সৈকতে আটকা পড়েছে শতাধিক পাইলট তিমি
অস্ট্রেলিয়ার সৈকতে আটকা পড়েছে শতাধিক পাইলট তিমি
যুদ্ধ কোনও সমাধান আনতে পারে না: প্রধানমন্ত্রী
যুদ্ধ কোনও সমাধান আনতে পারে না: প্রধানমন্ত্রী
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
২৪ ঘণ্টা পর আবার কমলো সোনার দাম
২৪ ঘণ্টা পর আবার কমলো সোনার দাম
আপিল বিভাগে নিয়োগ পেলেন তিন বিচারপতি
আপিল বিভাগে নিয়োগ পেলেন তিন বিচারপতি