X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

ড. ওয়েইনবার্গের ‘মলটেন সল্ট রিয়েক্টর’ যেভাবে কমাবে গ্লোবাল ওয়ার্মিং

জিশান হাসান
১৯ নভেম্বর ২০২১, ১২:১৪আপডেট : ১৯ নভেম্বর ২০২১, ১৬:১৭

জিশান হাসান জলবায়ু নিয়ে দশকের পর দশক জাতিসংঘে আলাপ-আলোচনার ফল দেখা যায়নি খুব একটা। জীবাশ্ম জ্বালানির (ফসিল ফুয়েল) ব্যবহার এখনও বাড়ছেই। যা কিনা কার্বন ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণ ঘটিয়ে বিশ্বের তাপমাত্রাকে নিয়ে যাচ্ছে বিপজ্জনক মাত্রায়। এমনটা কিন্তু হওয়ার কথা ছিল না। কারণ, আজ থেকে কয়েক দশক আগেই ড. অ্যালভিন ওয়েইনবার্গের মতো একজন দূরদর্শী পরমাণু বিজ্ঞানী—‘দ্য ফার্স্ট নিউক্লিয়ার এরা’ বইটির লেখক (১৯৯৪ সালে প্রকাশিত)—প্রস্তাব করেছিলেন, বিস্তৃত আকারে নিউক্লিয়ার জ্বালানির মাধ্যমে গ্লোবাল ওয়ার্মিং তথা বৈশ্বিক উষ্ণতার যাবতীয় সমস্যাকে বিদায় জানানো সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রের ‘ওক রিজ ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি’র সাবেক প্রধান ছিলেন ড. ওয়েইনবার্গ। ওটা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রাথমিক পর্যায়ের নিউক্লিয়ার রিয়েক্টর গবেষণা সাইটগুলোর একটি। তিনি ‘লাইট ওয়াটার রিয়েক্টর’ নকশারও একজন সহ-ডিজাইনার ছিলেন—যেটা কিনা পরে সারা বিশ্বের নিউক্লিয়ার পাওয়ারের ভিত গড়ে দিয়েছিল। অবশ্য ড. ওয়েইনবার্গ এটাও অনুমান করেছিলেন যে লাইট ওয়াটার রিয়েক্টরগুলোতে বড় ধরনের নিউক্লিয়ার দুর্ঘটনার ঝুঁকি আছে (যেমনটা ঘটেছিল চেরনোবিল ও ফুকুশিমায়), যেমনটা ঘটলে জনসাধারণ নিউক্লিয়ার পাওয়ারের বিপক্ষে চলে যেতে পারে এবং এতে তারা বিশ্বকে ফসিল ফুয়েলমুক্ত করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেটা থেকেও ক্রমে সরে আসতে পারে।

এমন চিন্তা থেকেই মলটেন সল্ট রিয়েকটর নামের আরেকটি তুলানামূলক নিরাপদ নিউক্লিয়ার রিয়েক্টরের নকশা করেছিলেন ড. ওয়েইনবার্গ। ওটা এখনও নিরাপদ বলেই স্বীকৃত, যাতে নিরবচ্ছিন্নভাবে পাওয়া যাবে ‘জিরো কার্বন পাওয়ার’। সুতরাং চলমান জলবায়ু বিপর্যয় ও ফসিল জ্বালানির বিকল্প অনুসন্ধানের যে তাগাদা এখন দেখা যাচ্ছে, তাতে ওয়েইনবার্গের ওই আবিষ্কারের তাৎপর্য অনেক এবং সবারই এ সম্পর্কে জানা উচিত।

ড. ওয়েইনবার্গ প্রথমে উল্লেখ করেছিলেন, তার লাইট ওয়াটার রিয়েক্টরের নকশাটি (যেটাকে প্রেসারাইজড ওয়াটার রিয়েক্টরও বলা হয়) নিরাপত্তা বা অর্থনীতির কারণে গ্রহণ করা হয়নি। ওটাকে সাদরে গ্রহণ করা হয়েছিল কেননা, মার্কিন নৌবাহিনীর অ্যাডমিরাল হাইম্যান রিকওভার এটাকে নটিলাস নিউক্লিয়ার সাবমেরিন প্রোগ্রামের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত মনে করেছিলেন।

“নিউক্লিয়ার সাবমেরিন রিয়েক্টরের কুল্যান্ট (শীতলীকরণ) ব্যবস্থাটি তখনও সুনির্দিষ্ট করা হয়নি। রিকওভারের নিজের পছন্দের উপকরণটি ছিল হাই-টেমপারেচার সোডিয়াম... আমি স্বাভাবিকভাবেই তখন তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে দেখিয়েছি যে আমরা এ নকশায় প্রেসারাইজড ওয়াটার ব্যবহার করেছি। সাবমেরিন রিয়েক্টরের ক্ষেত্রে এই প্রেসারাইজড ওয়াটার-এর দুটো সুবিধা আছে। প্রথমত, এর ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা রিয়েক্টরটি সহজেই সাবমেরিনের ভেতর রাখা যাবে। দ্বিতীয়ত, সোডিয়ামের মতো পানি এমন কিছু নয় যেটা সম্পর্কে মার্কিন নেভিকে ভালো করে জানতে হবে। এভাবেই তৈরি হলো প্রেসারাইজড ওয়াটার রিয়েক্টর। অর্থাৎ, কম দাম বা অন্যদের চেয়ে বেশি নিরাপদ বলে নয়, বরং রিয়েক্টরটির ছোটখাটো আকার ও সহজবোধ্যতার কারণেই নেভিকে গতি এনে দিয়েছিল এটি। আবার যখন নেভি একবার প্রেসারাইজড ওয়াটার তৈরি করে ফেললো, তখন এই সিস্টেমই রাজত্ব করতে শুরু করলো।” (পৃষ্ঠা ৫৯)।

তথাপি, এই প্রেসারাইজড ওয়াটার রিয়েক্টরটিই কিন্তু পারমাণবিক জ্বালানির একমাত্র বিকল্প নয়। ড. ওয়েইনবার্গ মলটেন সল্ট রিয়েক্টরও তৈরি করেছেন। যেটা আগের চেয়ে বেশি নিরাপদ এ কারণে যে, এটা অতিরিক্ত উত্তপ্ত (ওভারহিট) হবে না ও ‘মেল্টডাউন’-এর শিকার হবে না। প্রেসারাইজড ওয়াটার রিয়েক্টরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে যদি সেটার নিউক্লিয়ার কন্ট্রোল রড সিস্টেমে কোনও ত্রুটি থাকে (চেরনোবিলের মতো) কিংবা যদি এর ওয়াটার-বেজড পাম্পিং সিস্টেম ও কুলিং সিস্টেম বন্ধ হয়ে যায় (ফুকুশিমার মতো)। মলটেন সল্ট রিয়েক্টরটি ‘ওক রিজ’-এ টানা তিন বছর সফলভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে।

“১৯৬৬ সালের শুরুতে মলটেন সল্ট রিয়েক্টর কাজ শুরু করেছিল। ওই বছরের মার্চে এটি তার পূর্ণ ক্ষমতা দেখিয়েছিল। ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বরে রক্ষণাবেক্ষণের আগপর্যন্ত এটি বেশ মসৃণভাবেই কাজ করছিল। ওই সময় এর কার্যক্রম স্থগিত করা হয়, কেননা, তখন এর বরাদ্দ চলে গিয়েছিল আরও উন্নত মলটেন সল্ট রিয়েক্টর সিস্টেম তৈরির কাজে। আমরা তখন এমএসআরই (মলটেন সল্ট রিয়েক্টর এক্সপেরিমেন্ট) নিয়ে বেশ উচ্ছ্বসিত ছিলাম।” (পৃষ্ঠা ১২৬)।

দুর্ভাগ্যবশত, বাণিজ্যিক রিয়েক্টরের নকশায় মলটেন সল্ট রিয়েক্টর প্রভাব ফেলতে দেরি করে ফেলেছিল। বাণিজ্যিক রিয়েক্টরগুলো তখন লাইট ওয়াটার রিয়েক্টরকে কেন্দ্র করে রীতিমতো অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলছিল।

“১৯৫৩ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের রিয়েক্টর তৈরির মূল লাইনটা বলা যায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। ওটা ছিল লাইট ওয়াটার রিয়েক্টর (এলডাব্লিউআর)... এই এলডাব্লিউআর-এর একটা বড় সুবিধা ছিল; এটা নটিলাসের নির্ভরযোগ্য পাওয়ার প্ল্যান্ট হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করে ফেলেছে।” (পৃষ্ঠা ১৩৩)।

বাণিজ্যিক নিউক্লিয়ার শিল্পখাত যে লাইট ওয়াটার রিয়েক্টরটি বেছে নিয়েছিল, তাতে বড় ধরনের বিপর্যয়ের দরজা ছিল উন্মুক্ত। এমনকি যার বিপরীতে প্রথম প্রজন্মের লাইট ওয়াটার রিয়েক্টরের নকশাগুলোর যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ছিল না। 

“থ্রি মাইল আইল্যান্ড (পেনসিলভানিয়ার রিয়েক্টরে আংশিক বিপর্যয়)-এর আগেও আমি নিউক্লিয়ার ইন্ডাস্ট্রি সংশ্লিষ্টদের বলেছিলাম নিউক্লিয়ার জ্বালানিকে টিকে থাকতে হলে আরও কঠিনতর নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হবে। নরম্যান রাসমুসেনের হিসাব অনুযায়ী একটি রিয়েক্টরের দুর্ঘটনায় পড়ার সম্ভাব্যতা—তথা রিয়েক্টর মেল্টডাউনের বিষয়টি কয়েক দশকের মধ্যে যে ঘটবে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। রিয়েক্টর ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে ও এতে করে ওই স্থাপনার মালিক ও পরিচালক দেউলিয়া হবে। একইসঙ্গে নিউক্লিয়ার জ্বালানির ভবিষ্যৎকেও বড় ধরনের বিপদে ফেলবে।” (পৃষ্ঠা ২২৭-৮)।

লাইট ওয়াটার রিয়েক্টরে নিউক্লিয়ার দুর্ঘটনা নিয়ে ড. ওয়েইনবার্গ যে বারবার সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন, সে কারণে তাকে চড়া মূল্যও দিতে হয়েছিল। ওক রিজ ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির পরিচালক পদ থেকে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনক হলো, ওয়েইনবার্গের আশঙ্কাই শেষ পর্যন্ত সত্য হলো চেরনোবিল বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে।

“তারপর ১৯৮৬ সালের এপ্রিলে ঘটলো চেরনোবিল। বিশ্বজুড়ে নিউক্লিয়ার এন্টারপ্রাইজকে তখন সেই স্পষ্ট সম্ভাব্যতার মুখোমুখি দাঁড়াতে হলো—প্রথম নিউক্লিয়ার যুগের পরিসমাপ্তি ঘটাতে চললো।” (পৃষ্ঠা-২৩২)।

২০০৬ সালে মারা যান ওয়েইনবার্গ। লাইট ওয়াটার রিয়েক্টরের নিউক্লিয়ার বিপর্যয় নিয়ে তার ভবিষ্যদ্বাণী এরপরও ফলেছে—২০১১ সালে ফুকুশিমার ঘটনায়। যে ঘটনার পর অনেক পশ্চিমা দেশে নিউক্লিয়ার জ্বালানির প্রতি জনসমর্থন পুরোপুরি উঠে গিয়েছিল। লাইট ওয়াটার রিয়েক্টর ইন্ডাস্ট্রির যবনিকা নিয়ে এমন পূর্বানুমানের সাপেক্ষে ওয়েইনবার্গ নিউক্লিয়ার জ্বালানির প্রাথমিক দশাটির নাম দিয়েছিলেন ‘প্রথম নিউক্লিয়ারের যুগ’ (তার বইয়ের শিরোনাম)। তিনি আগেই ধারণা করেছিলেন যে, নিরাপদ মলটেন সল্ট রিয়েক্টরের নকশাই পরবর্তীতে নিউক্লিয়ার ইন্ডাস্ট্রির অবস্থান দখলে নেবে।

“আমি দেখতে পাচ্ছি যে, সহজাতভাবেই আরও নিরাপদ রিয়েক্টর নিয়ে একটি দ্বিতীয় নিউক্লিয়ার যুগ আসন্ন... যখন জনগণ বুঝতে পারবে একটি মেল্ট-প্রুফ (যাতে মেল্টডাউন ঘটবে না) রিয়েক্টর তৈরি হয়ে যাবে, তখন রিয়েক্টরের প্রতি যাবতীয় অভিযোগও উঠে যাবে।” (পৃষ্ঠা ২৩১)।

দুর্ভাগ্য যে, মলটেন সল্ট রিয়েক্টরের বাণিজ্যিক ব্যবহারটা ড. ওয়েইনবার্গ নিজে দেখে যেতে পারলেন না। এর একটা বড় কারণ ছিল নিউক্লিয়ার-বিরোধী পরিবেশবাদীদের নিউক্লিয়ার জ্বালানিবিরোধী আন্দোলন—যারা কিনা নিউক্লিয়ার জ্বালানির চেয়ে সোলার ও বায়ুকেই বেশি পছন্দ করে। অথচ এটা তাদের জন্য একটা ট্রাজেডি যে, দীর্ঘদিন ধরে বড় পরিসরে জিরো-কার্বন নিঃসরণ ঘটিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে শক্তির যোগান দিয়ে ফসিল ফুয়েলের বিকল্প হিসেবে নিউক্লিয়ার জ্বালানিই টিকে আছে।

“উগ্র পরিবেশবাদীদের কাছে কার্বন ডাই-অক্সাইড একটা বড় ধরনের দ্বিধার নাম। যখন নিউক্লিয়ার রিয়েক্টরগুলো একটুও কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ ঘটাচ্ছে না, সেখানে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিয়ে যারা বেশি চিন্তিত তারা কী করে নিউক্লিয়ার জ্বালানির বিরোধিতা করতে পারে?... আমার একটা ভাবতে খারাপ লাগে যে, ঠিক এমন অবস্থানই ধরে আছে কিছু পরিবেশবাদী। তাদের যুক্তি হলো, চরম সংরক্ষণ নীতি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি- তথা সৌরশক্তিতে যাওয়াটাই হলো পরিবেশ বাঁচিয়ে কার্বন ডাই-অক্সাইড কমানোর একমাত্র পথ। আমি যখন তাদের এটা বললাম যে, এ কাজটা কিছু শিল্পোন্নত দেশের ক্ষেত্রে সম্ভব হতে পারে, কিন্তু চীন বা ভারতের জন্য মোটেও বাস্তবসম্মত নয়—তখন তারা আমার কথাটাকে পাত্তাই দিলো না।” (পৃষ্ঠা ২৩৭)।

সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, বিশ্বের কিছু প্রতিষ্ঠান ও সরকারি এজেন্সি ওয়েইনবার্গের মলটেন সল্ট রিয়েক্টর ডিজাইনটিকে গ্রহণ করেছে এবং এখন সেটাকে বাণিজ্যিকীকরণের চেষ্টাও করছে। এর মধ্যে প্রথম মলটেন সল্ট রিয়েক্টরটির কাজ সম্পন্ন হতে চলেছে চীনের উওয়েইতে। আশা করা হচ্ছে, কয়েক বছরের মধ্যেই নিরাপদ মলটেন সল্ট রিয়েক্টরের মাধ্যমে দ্বিতীয় নিউক্লিয়ার যুগের যে স্বপ্ন ওয়েইনবার্গ দেখেছিলেন, তা পূরণ হতে চলেছে। আশা করা যায়, বিশ্বকে জলবায়ু বিপর্যয় থেকে বাঁচানোর জন্য এটা সময়মতোই কাজ শুরু করবে।

লেখক: পরিচালক,  কাজী মিডিয়া । ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সিসনোভা

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দ্বিতীয় বিয়ের চার দিন পর বৃদ্ধকে হত্যা, দুই ছেলে পলাতক
দ্বিতীয় বিয়ের চার দিন পর বৃদ্ধকে হত্যা, দুই ছেলে পলাতক
বিদ্যুৎস্পৃষ্টে প্রাণ গেলো ইউপি সদস্যের
বিদ্যুৎস্পৃষ্টে প্রাণ গেলো ইউপি সদস্যের
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আট বছর পর জাবিতে ডিন নির্বাচন
আট বছর পর জাবিতে ডিন নির্বাচন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ