X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

জয় কৃষাণ আন্দোলনে মোদির পরাজয়

আনিস আলমগীর
২৩ নভেম্বর ২০২১, ১৩:১৬আপডেট : ২৩ নভেম্বর ২০২১, ১৫:৩৬

আনিস আলমগীর ভারতে বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা কৃষক আন্দোলন বিজয়ের মুখ দেখেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছেন যে আগামী সংসদ অধিবেশনে তিনটি খামার আইন বাতিল করা হবে। এই কৃষক আন্দোলন পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম দীর্ঘ আন্দোলন। প্রশ্ন উঠেছে, এটি কি একটি সংগ্রামের বিজয়ী সমাপ্তি, নাকি এটি বিপদ থেকে রক্ষা এবং একটি নতুন কৃষি বিপ্লবের সূচনা?

১৯ নভেম্বর ২০২১ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘আজ আমি আপনাদের, গোটা দেশকে এটাই বলতে এসেছি যে আমরা তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ মাসের শেষের দিকে সংসদ অধিবেশনে তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নেওয়ার সাংবিধানিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবো।’

মোদির ঘোষণা কৃষকদের মধ্যে আনন্দের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে ভারতের নিউজ চ্যানেলগুলোর মুখে কালি লেপে দিয়েছে। কারণ, শুরু থেকে দেশের শীর্ষ মিডিয়াগুলো, বিশেষ করে জিটিভি, আজতক, রিপাবলিকসহ ‘গদি মিডিয়া’ বলে পরিচিত সরকারের দালাল সাংবাদিকরা মুখ লুকানোর জায়গা পাচ্ছে না, যারা দিনের পর দিন এই কৃষক আন্দোলনে জড়িতদের খালিস্তানি, সন্ত্রাসী, দেশদ্রোহী- নানা নামে আখ্যায়িত করেছিল। এই নিউজ চ্যানেলগুলো সারা বছর জনগণকে বোঝাতে চেষ্টা করেছে যে তিনটি বিল কত কল্যাণকর হবে কৃষকের জন্য। অবশ্য এই বেশরমদের পক্ষ পরিবর্তন করতেও সময় লাগে না। এখন তারা প্রচারে নেমেছে মোদি কত মহান। এই তিনটি বিল প্রত্যাহার করছেন তিনি দেশকে বাঁচানোর জন্য। তিনি নিজে হেরে গেছেন কিন্তু দেশকে জিতিয়ে দিয়েছেন।

কৃষি আইন তিনটি আনা হয়েছিল ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। যেভাবে এগুলো লোকসভায় পাস করা হয়েছিল তা ছিল ভারতের সংসদীয় ইতিহাসে চরম অসংসদীয় এবং অগণতান্ত্রিক নজির। বিল পাসের সময় বিরোধীরা কেউই সংসদে উপস্থিত ছিলেন না। ওই বিতর্কিত তিনটি আইনের বিরুদ্ধে রাজধানী দিল্লির প্রবেশপথে কয়েক লাখ কৃষক অবস্থান নেয় গত বছরের নভেম্বর মাস থেকে। বিরোধী দলগুলো, বুদ্ধিজীবী মহল তাদের সমর্থনে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। তবে মূল আন্দোলনটি কৃষকরা একাই চালিয়ে নেয় বছর ধরে।

সংক্ষেপে নতুন আইন তিনটি নিয়ে যদি বলি, কৃষকদের অভিযোগ ছিল এগুলো কৃষকের স্বার্থে নয়, করপোরেট প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে। আইনে কৃষি ব্যবস্থাপনা আর রাজ্যের হাতে নেই। আইন অনুযায়ী কৃষকের সঙ্গে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের যে চুক্তি হবে, তাতে ফসলের পরিমাণ, গুণগতমান দাম ইত্যাদি আগেই নির্ধারিত থাকবে। নতুন আইনের সুযোগে করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও ফড়িয়ারা নিজেদের ইচ্ছেমতো ফসলের দাম নির্ধারণ করতে ও ইচ্ছেমতো গুদামজাত করতে পারবে। আগে প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষিক্ষেত্রে কোনও বিপর্যয় নেমে এলে রাজ্য সরকার কৃষকের পাশে থাকতো। এখন তাতে রাজ্য সরকারের কোনও দায়-দায়িত্ব থাকছে না। বরং কেন্দ্রীয় সরকার বহুদূর থেকে সবকিছু তদারকি করবে। আইনে ব্যবসায়ীর সঙ্গে কৃষকের বিরোধকে আদালতে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

দেখতে মনে হতে পারে আইনে কৃষকের জন্য স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। তাদের ফসল তারা যেখানে খুশি বিক্রি করতে পারবে আর ব্যবসায়ীদের অধিকার দেওয়া হয়েছে তারা যে কারও কাছ থেকে কৃষিপণ্য কিনতে পারবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, গ্রামের কৃষকদেরকে ঠকানোর জন্য এটা সহজ ছিল, কারণ কৃষকদের কাছে শস্য সংগ্রহে রাখার জন্য কোনও বড় গুদাম নেই, যেখানে সঠিক তাপমাত্রায় তা সংগ্রহে রেখে তারা বিক্রি করতে পারবেন।

সরকারে আন্দোলন প্রতিবাদ প্রতিরোধ করার জন্য নানা কায়দা-কানুন করেছিল। রাস্তা কেটে, রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে, রাস্তায় মেটাল স্পাইক বসিয়ে দিল্লি বর্ডারের চারপাশে ব্যারিকেড লাগানো হয়েছিল। কৃষকের ওপর জলকামান, লাঠি, টিয়ারগ্যাস- হেন কোনও নির্যাতন বাকি রাখা হয়নি। এই আন্দোলনে ৭০০-এর বেশি কৃষক নিহত হয়েছে। ২৬ জানুয়ারি ২০২১ আন্দোলনরত কৃষকদের একাংশ রাজধানী নতুন দিল্লির রাস্তায় চলে এলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছিল ব্যাপক। সেটি বড় করে প্রচার করা হয় কিন্তু কৃষকদের ওপর পুলিশের নির্যাতন বেশিরভাগ মিডিয়া আড়াল করে রাখে। কৃষক আন্দোলন ওইদিনই শেষ বলে প্রচার চালায় সরকার সমর্থক মিডিয়াগুলো। কৃষকরা শহর ছেড়ে আবারও দিল্লির সীমান্তে চলে যান, আবারও সংগঠিত হয়ে আন্দোলনে নামেন তারা।

কৃষকের বিরুদ্ধে নানা প্রচারণাও শুরু করা হয়েছিল। রাজনীতিবিদরাও এদের মদখোর, রাস্তা বন্ধ করে বিরানি খাচ্ছে বলে টিটকারি করে। আমজনতার পক্ষেও এদের আন্দোলনকে সমর্থন করা খুব কঠিন ছিল। কারণ, সার্বক্ষণিকভাবে এদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চলছে মিডিয়ায়। এমনকি কৃষক পিৎজা খাচ্ছে এই ছবি প্রচার করে টিটকারি করা হয়েছে, যেন পিৎজা শুধু নিউজরুমে সাংবাদিকরা খাওয়ার অধিকার রাখেন। কিন্তু কৃষকরা থেমে ছিলেন না। নিজেরা নিজেদের খবর প্রচারের জন্য ‘ট্রলি টাইমস’ নামে অর্ধ সাপ্তাহিক বুলেটিন বের করেছেন। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউবসহ সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজস্ব অ্যাকাউন্ট চালিয়েছে ‘কিষান একতা মোর্চা’ নামে। পাঞ্জাব-হরিয়ানার কৃষকের সঙ্গে উত্তর প্রদেশ এবং অন্যান্য প্রদেশের কৃষকরা যোগ দিয়েছেন।

কৃষকরা বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। প্রবাসী পাঞ্জাবিরা দেশে দেশে তাদের সমর্থনে রাস্তায় নেমেছে। বিদেশি তারকারা সোশ্যাল মিডিয়ায় কৃষকের পক্ষ নেওয়ায় মহাখেপেছিল দিল্লি সরকার। এত হাস্যকর যে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এর বিরুদ্ধে বিবৃতি পর্যন্ত দিয়েছে, যা ছিল নজিরবিহীন ঘটনা। মার্কিন পপ তারকা রিহানা টুইটারে কৃষক আন্দোলন নিয়ে সিএনএন-এর একটি রিপোর্ট শেয়ার করেন আর লিখেন ‘আমরা কেন এ বিষয়ে কথা বলছি না (why aren’t we talking about this?)? হ্যাসট্যাগ ফার্মার্সপ্রটেস্ট (#FarmersProtest)।

সঙ্গে সঙ্গে রিহানার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলিউডের বিজেপি সরকার সমর্থক তারকা কঙ্গনা রানাওয়াত, অক্ষয় কুমার, অজয় দেবগন, করণ জোহরসহ অনেক তারকা। তাদের দেখাদেখি বিরাট কোহলি, শচীন টেন্ডুলকার, লতা মঙ্গেশকরসহ অনেকে রিহানার বিরুদ্ধে এবং আন্দোলনের বিপক্ষে টুইট করেন।

বলিউড সেলিব্রিটিরা এটিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ মনে করে প্রশ্ন তুলেছে- রিহানা কৃষকদের সম্পর্কে কী জানেন!

রিহানা অবশ্য প্রশ্ন তোলেননি, ‘ব্ল্যাক লাইফ মেটার’-এর পক্ষে সারা বিশ্বের মানুষের সঙ্গে এই বলিউডের তারকারা যখন টুইট করেছিল সেটা যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয় ছিল কিনা?

যাহোক, নরেন্দ্র মোদি কেন এতদিন পরে এসে আইন বাতিল করতে চাইছেন আর কৃষকের কাছে ক্ষমা চাচ্ছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন তিনি ‘ধূর্ত শিয়াল’। এর আগে জম্মু কাশ্মিরের বিশেষ সাংবিধানিক রক্ষাকবচ প্রত্যাহার বা সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন প্রণয়নের মতো বিতর্কিত ইস্যুগুলো নিয়ে ব্যাপক বিক্ষোভ হলেও ওইসব সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসেননি তিনি। এখন উত্তর প্রদেশ আর পাঞ্জাবে আসন্ন বিধানসভা ভোটে জিততেই এ কৌশল নিয়েছেন তিনি। এই বিক্ষোভে সবচেয়ে বড় সংখ্যায় অংশ নিচ্ছেন পাঞ্জাব আর উত্তর প্রদেশের কৃষকরা। ওই দুটি রাজ্যে কৃষকদের ভোট বিরুদ্ধে চলে গেলে বিজেপির জয় অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা। এছাড়াও এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর ছেলে উত্তর প্রদেশের লখিমপুরে চলা কৃষক বিক্ষোভের ওপর দিয়েই গাড়ি চালিয়ে কয়েকজন কৃষক ও এক সাংবাদিককে হত্যা করেছে, যেটির ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।

রাহুল গান্ধী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বড় মাপের বিরোধী নেতারা বলছেন, এটি কৃষক আন্দোলনের জয়। অবশ্য কৃষক বিক্ষোভের নেতারা বলছেন, এখনই তাদের অবস্থান বিক্ষোভ শেষ হয়ে যাচ্ছে না। তারা অপেক্ষা করবেন সংসদে সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় আইন তিনটি প্রত্যাহার পর্যন্ত।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।

[email protected]

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ