X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর

শামারুহ মির্জা
২৩ নভেম্বর ২০২১, ২১:৪৪আপডেট : ২৪ নভেম্বর ২০২১, ১৪:২৪

আমি যখন বড় হবো, তখন একটা ট্রেন ড্রাইভার হবো।  যে ট্রেনটা পুরো চকোলেট দিয়ে বানানো হবে।  দরজা চকোলেটের, সিটগুলো চকোলেটের– এই ছিল আমার জীবনের লক্ষ্য! ৫/৬ বছর বয়সে যখন কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করতো,  ‘শামা, তুমি বড় হয়ে কি হবে?’ এই প্রশ্ন শুনতাম, আর এটাই বলতাম। ট্রেন চালাবো। আরেকটু বড় যখন হলাম, লাইন টানা খাতায় গল্প লেখা শুরু করলাম। সাদা ঘোড়ার গল্প। কেন জানি অসাধারণ লাগতো ঘোড়ার সৌন্দর্য!

এরপরও আরও অনেক কিছু হতে চেয়েছি।  দশ বছর বয়স যখন, ততদিনে আব্বুর লাইব্রেরির পুরনো সব ম্যাগাজিন পড়া শেষ;  বিচিত্রা, রিডার্স ডাইজেস্ট। একদিন বিচিত্রার নিষিদ্ধ বোধহয় কিছু পড়ছি বুকশেলফের পেছনে বসে, আমার ছোট চাচা আমাকে দেখে তাজ্জব!

আরও পরে প্লেন চালাতে চেয়েছি। ট্রেন চালানো হলো না, তবে সাদা ঘোড়া চালানো হয়েছে। চার জনের ছোট্ট একটা প্লেনের স্টিয়ারিংটাও ধরা হয়েছে।

তো আমাকে বলা হলো—স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর নিয়ে কিছু লিখতে। আমি কী লিখবো?

আমার দাদা। আমার আজও দাদার সেই কণ্ঠ কানে বাজে।

‘দাদা, আমাকে দেখতে কেমন লাগছে?’

মুগ্ধ কণ্ঠে বললাম, ‘খুব হ্যান্ডসাম দাদা’।

একটা দারুণ সাফারি স্যুট, চকচকে কালো জুতা পরে দাদা রকিং চেয়ারটাতে বসে। দাদা একটু পরেই সিএমএইচএ যাবেন।  প্রতি সপ্তাহে তার ডায়ালাইসিস করতে হয়।  ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধটাও চলছে। মানুষটা হারেনি কখনও। মৃত্যু তো অবধারিত। এসব নিয়ে চিন্তা করলে চলে? দাদা এমনি ছিলেন।

আমি যেদিন এসএসসির রেজাল্ট পেলাম; দাদা ফোন করলেন, সিএমএইচের কেবিন থেকে।

‘দাদা, তুমি আমার পরিবারের স্টার, আমি ভীষণ খুশি হয়েছি।’ কী উত্তেজনা তার কণ্ঠে!

মানুষটা তখন ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন, তবু তার কী মনোবল, কী আনন্দ।

দাদাবাড়ি যখন যাওয়া হতো, দাদার সেকি আনন্দ, উত্তেজনা! কী খাওয়া হবে, কোথায় বেড়াতে যাওয়া হবে। দাদা আব্বুকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। দাদার সঙ্গে আব্বুর খাবার টেবিলে প্রায়ই তর্ক হতো, রাজনৈতিক তর্ক। তুমুল তর্ক। কে কাকে যুক্তিতে হারায়? দু’জনের রাজনৈতিক আকর্ষণ ছিল দু’রকম, কিন্তু একটি বিষয়ে একমত ছিলেন সবসময়। সুস্থ রাজনীতি, এবং দেশের ভালো। দুজন দুজনের ওপর ভীষণ নির্ভর করতেন।  

সারা জীবন ‘আনারের মা’ বলে ডাকলেন দাদিকে। দাদির শাড়ির আঁচলে আলমারির চাবিটা থাকতো। দাদাবাড়িতে ভোরে আমার ঘুম ভাঙতো দাদির কোরআন তেলাওয়াতে, তারপরে, বারান্দার টেবিলে দুই কাপ চা, বিদেশি বিস্কুট। দাদা তাঁর ট্রানজিস্টারটা চালাতেন। পুরনো বাংলা গান, কখনও মোহাম্মদ রাফি। দুজনে চায়ে চুমুক দিতেন, আর গান শুনতেন।

দুই.

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর উপলক্ষে কিছু লিখতে হবে, তো বসলাম লিখতে। মাথার মধ্যে কেন জানি শুধু ঘুরছে ছোটবেলার কথা। পুজোর সময় আব্বুর হাত ধরে মণ্ডপে যাওয়া, ঢোলের সে কী আওয়াজ! মনোতোষ কাকুর বাসায় ভোজন। কাকুর ছেলেমেয়ে ছিল না। আমাদের ভীষণ আদর করতেন। পরে এক আদিবাসী মেয়েকে দত্তক নেন।  খুব সুন্দর ছিল মেয়েটি। নাম মনে নেই।

একুশে ফেব্রুয়ারি কাকডাকা ভোরে, বাগানে গিয়ে ফুল কুড়োনো, তারপরে আব্বুর হাত ধরে শহীদ মিনারে যাওয়া। ঈদের দিন সকাল বেলা, গোসল করে শুভ্র কামিজ পরে আম্মুর রান্না সেমাই খেয়ে অপেক্ষা করা; আব্বু, চাচু নামাজ পড়ে আসতেন, তাদের সঙ্গে সব দাদা-দাদির বাসায় গিয়ে সালাম করা, আর সালামি নিয়ে সে কী উত্তেজনা!

কিশোরবেলার সে আরেক আনন্দ। বন্ধুদের সঙ্গে। বিতর্ক প্রতিযোগিতা, আবৃত্তি, স্কুলের মিলাদে হামদ-নাত, শাড়ি পরে মাথায় আঁচল টেনে, স্টেজে বসে গাওয়া  ‘সুন্দরও ফুল, সুন্দরও ফল, মিঠা নদীর পানি, খোদা তোমার মেহেরবানি।’

শবে বরাতে বাসার বারান্দার রেলিংয়ে সারি সারি মোমবাতি জ্বালাতাম। পরদিন বিকালে নিচের তলার বারান্দায় বসে ইয়াকুব দাদার সঙ্গে রুটি আর সুজি বিতরণ। মিলাদে গোলাপজল ছিটানোর দায়িত্বটা ছিল আমার। খুব আনন্দ হতো এত বড় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে!

আজ শুনি এসব বলে বিদাত! আচ্ছা!

বাংলা ১৪০০ বরণ করা হবে। বিশাল কমিটি করে উদযাপন। সেকি এলাহি কাণ্ড। কলেজে ‘‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই.. ’’ গানের সঙ্গে অভিনয়। আঃ, ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’।

ঢাকা ইউনিভার্সিটি; কত যে আনন্দ, উত্তেজনা। শামসুন্নাহার হলের সেই ঘটনাটির পরে ছুটে গেলাম আনোয়ার স্যারের বাসায়। কত গল্প। তারপরে দেশছাড়া। পিএইচডি, গবেষণা...। সারাটা জীবন ভেবেছি, এই যাচ্ছি দেশে। একদিন চলেও গেলাম। তারপর? থাক, সে গল্প আরেক দিন।

তিন.

মজার ব্যাপার হলো, এই আমি আজ কোথাও দাঁড়িয়ে নেই। যে মেয়েটি, দেশ ছাড়া একদণ্ড কিছু ভাবতে পারতো না, যে মেয়েটি, কমপ্লিকেটেড প্রেগন্যান্সি নিয়েও দেশে ছুটে গেছি কাশিমপুরের ছোট্ট ঘরটাতে গিয়ে আব্বুর মুখটা দেখবো বলে, যে মেয়েটি  লিখেছে ‘ফ্রিডম’-এর কথা, যে মেয়েটি বারবার স্বপ্ন দেখেছে তার চরম আদরের দেশটাকে নিয়ে। মেয়েটি তার ছোট্ট মেয়েটিকে নিয়ে আবার গেছে কাশিমপুরে..। আজ মনে পড়ে, ছোট্ট মেয়েটি কাশিমপুরের দেয়াল পরিষ্কার করছিল একটা টিস্যু দিয়ে; আর বলছিল-‘নোংরা মাম্মা, ক্লিন করে দিচ্ছি।’ আর নানাভাই বলছেন—‘অনেক বেশি নোংরা নানুভাই।...অনেক সময় লাগবে।’

আমি আজ আসলেই কোথাও দাঁড়িয়ে নেই।

চার.

আমি ছোটবেলা থেকেই ভীষণ, ভীষণ, স্বাধীনচেতা। "ফ্রিডম"-এর কোনও অল্টারনেটিভ নেই আমার কাছে। অবশ্যই, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর শুনলে ভারী ভারী লাগে। সেদিন, একটা ছেলে বললো... ওদের এলাকার বিশেষ ক্ষমতাধর ব্যক্তি তার জমি কেড়ে নিয়েছে, তো সে খুবই অবাক, তার বাবা ছিলেন ক্ষমতাধর ব্যক্তির কাছের লোক। সে ভাবছে, কেন তাদের জমি দখল করবে? তো সে একটু ভেবে বুঝতে পারলো তার বোকামিটা।  এলাকায় তো বিরোধী দলের আর কারও জমি বাকি নেই ! সব শেষ, কিন্তু খিদা তো শেষ হয় না; বরং যত খাওয়া তত খিদা বেড়ে যায়।

পঞ্চাশ বছর স্বাধীনতার।

পাঁচ.

ছেলেটার ফোন নাম্বার নিয়ে কথা বললাম।  কত বছর হয়ে গেলো। বাবা আর ফিরে এলো না। তো এই মা, এদের বড় করলো, পড়াশোনা করালো, বাবাকে খুঁজলো, এমনকি শেষের দিনটায়ও, বাবার জন্যই বের হয়েছিল রাস্তায়। মা-টাও মরে গেলো ট্রাকচাপা পড়ে।

মনে পড়ে গেলো, ছোট্টবেলায় একটা চার লাইনের ছড়া, আমি লিখেছিলাম। ‘ট্রাক ট্রাক ট্রাক, শুয়োর মুখো ট্রাক আসছে, দুয়োর বেঁধে রাখ’!  ‘ঢাকা ঢাকা ঢাকা, টাকা ছাড়া ঘোরে নাকো সে শহরের চাকা’। ছোটবেলার আজব সব কাণ্ড! আবার ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেলো! স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর নিয়ে লিখতে বসে ছোটবেলার কথাই লিখে চলেছি।

ছয়.

রোসা লুক্সেমবার্গকে খুন করা হয়েছিল। তার শেষ কথা ছিল,

“The leadership has failed. Even so, the leadership can and must be recreated from the masses and out of the masses. The masses are the decisive element; they are the rock on which the final victory of the revolution will be built.

‘Order reigns in Berlin!’ You stupid henchmen! Your ‘order’ is built on sand. Tomorrow the revolution will already ‘raise itself with a rattle’ and announce with fanfare, to your terror:

I was, I am, I shall be!”

কত হাজার মানুষ হারিয়ে গেলো পৃথিবী থেকে। স্বাধীনতার জন্য। মুক্তির জন্য। আমি রোসাকে অনুভব করি।  অন্যায়, অবিচার আমি দেখেছি। বিশ্বাসের জন্য কিংবা দ্বিমতের জন্য মানুষকে মরতে দেখেছি, হারিয়ে যেতে দেখেছি, আজীবন লড়ে যেতে দেখেছি। এখানেই আরও বেশি রোসাকে আবার অনুভব করি। ক্ষমতার সামনে দাঁড়িয়ে যে ক্ষমতার বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে কথা বলে, তার মাঝে আমি রোসাকে অনুভব করি।

 আহ! স্বাধীনতা। মুক্তি।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক

/এসএএস/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা