X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

বুয়েট শিক্ষকেরও আছে ‘দুর্নীতি করার অধিকার’

ডা. জাহেদ উর রহমান
২৬ নভেম্বর ২০২১, ১৬:০০আপডেট : ২৬ নভেম্বর ২০২১, ১৬:০০

ডা. জাহেদ উর রহমান

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) শিক্ষক অধ্যাপক নিখিল রঞ্জন ধর কত টাকার মালিক, সেটা আমরা জানি না। পত্রিকায় যে ১০ কোটি টাকার কথা এসেছে, তিনি সেটার মালিক নন, তার অ্যাকাউন্টে এই পরিমাণ টাকার লেনদেন হয়েছে। তিনি মাত্র ১০ কোটি টাকার মালিক হলেই বা কী হতো? মাত্র শব্দটি আমি সচেতনভাবেই কোট-আনকোট করে লিখিনি। আক্ষরিক অর্থেই বর্তমান বাংলাদেশে এই টাকাটা আমাদের কাছে একেবারেই মাত্র।

শত কোটি তো বটেই, হাজার কোটি টাকাও আমাদের কাছে এখন ডালভাত, হতেই পারে আমার নিজ পকেটে ফুটো পয়সাও নেই। শত বা হাজার কোটি টাকার এই যে গল্প, সেটা যে কেবল তথাকথিত উন্নয়নের নামে রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের ক্ষেত্রে আমরা শুনি তা নয়, এমনকি প্রতিষ্ঠিত বিরাট ব্যবসায়ীও নয়, আপাতদৃষ্টিতে বড় কোনও ব্যবসা না থাকা ব্যক্তির কাছে এমন পরিমাণ টাকা থাকার কথা শুনি আমরা। 

তথাকথিত শুদ্ধি অভিযানের নামে যখন সম্রাট, জি কে শামীমসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয় তখন আমরা ব্যক্তির কাছে শত/হাজার কোটি টাকার গল্প শুনতে শুরু করি। তারপর করোনার সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী আবজাল-রুবিনা দম্পতি কিংবা ড্রাইভার মালেকের হাজার কোটি টাকা সম্পদের খবর এসেছে। তারপর আমরা জানলাম ফরিদপুর সদর উপজেলার আওয়ামী লীগের সহোদর দুই নেতা বিদেশে পাচারই করেছেন অন্তত দুই হাজার কোটি টাকা।

এই যে ক্ষমতাসীন দলের নন-সিগনিফিক্যান্ট কিছু মানুষের সম্পদের হিসাব আমরা পেলাম সেটা বিরোধী দল দিয়েছে সেটা নয়। এমনকি দেয়নি দেশের কোনও সংবাদপত্র। এসব খবর আমাদের সামনে এনেছে রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী। সম্প্রতি মিডিয়ার সূত্রে শুনছি আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীরের হাজার হাজার কোটি টাকার গল্প। জনাব জাহাঙ্গীর সবকিছু ঠিকঠাক ‘ম্যানেজ’ করে উঠতে না পারলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিশ্চয়ই আমাদের এই খবরও জানাবে। 

বর্তমান বাংলাদেশ আর দুর্নীতি সমার্থক। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে সরকার দুর্নীতিকে আর সব অনিয়মের মতো পুরো অস্বীকার করতে পারছে না। নানা জায়গায় সরকারের মুখপাত্ররা দুর্নীতিকে স্বীকার করে নিচ্ছেন এবং বলতে চাইছেন দুর্নীতি হলেও সরকার তার বিরুদ্ধে ‘শুদ্ধি অভিযান’ চালাচ্ছে।

দুর্নীতির অভিযোগ আবহমানকাল থেকেই আছে এই দেশে। যার হাতে কোনও ধরনের ক্ষমতা আছে সেই মানুষদের কেউ কেউ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়েছেন এবং তার মাধ্যমে ‘উপরি’ উপার্জন করেছেন। কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে একেবারে– তখন কেউ কেউ দুর্নীতির সঙ্গে জড়াতেন, আর এখনকার সময়ে কেউ কেউ ভালো থাকেন, জড়ান প্রায় সবাই।

তো বেশ কয়েক বছরে সমাজের আরেকটি বড় পরিবর্তন ঘটে গেছে। আমরা এখন একজন মানুষের হাতে থাকা টাকা আর তার ভোগ করার ক্ষমতা দিয়েই একজন মানুষকে মাপি। এই ক্ষেত্রে যিনি যত বেশি করতে পারবেন তিনি এই সমাজে ততবেশি সমীহ-প্রতিপত্তি, এমনকি সম্মানও পান। 

দুর্নীতি করা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, তদবিরবাজি-চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি করে বেশুমার টাকা কামানো রাজনৈতিক নেতাকর্মী, ব্যাংক লুট করা বড় ব্যবসায়ী, অপ্রয়োজনীয় ওষুধ, ইনভেস্টিগেশন করতে দেওয়া ডাক্তার, ‘হলুদ’ সাংবাদিক, দুই নম্বরি ব্যালান্সশিট বানিয়ে ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকি দিতে সাহায্য করা অ্যাকাউন্ট্যান্ট, ঘটিবাটি বিক্রি করে মানুষকে নিশ্চিত পরাজয় হবে এমন মামলা করানো উকিল, মিথ্যা স্বপ্ন দেখিয়ে সর্বস্বান্ত করে মানুষকে বিদেশে পাঠানো আদম ব্যাপারী, গরিবকে দেখিয়ে পাওয়া বিদেশি ফান্ড নিজের বিলাসিতায় ব্যবহারকারী এনজিও মালিক, স্কুলের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বাসায় কোচিং ব্যবসা করা শিক্ষক, ওয়াজের নামে সার্কাসের ক্লাউনের মতো যাচ্ছেতাই করা মোল্লা থেকে শুরু করে ভেজাল পণ্য বিক্রি করা, মাপে কম দেওয়া দোকানি, সবার উপার্জন নিয়ে আমাদের বর্তমান সমাজে প্রশ্ন তৈরি হয় কমই। তাই তারা এই সমাজে চলেন মাথা উঁচু করেই। এখন এই সমাজে কোনও লুকোছাপা আর অবশিষ্ট নেই। অথচ ২০-২৫ বছর আগেও সমাজ এমন ছিল না, এসব মানুষ সমাজে ছিলেন ধিক্কার-ঘৃণার পাত্র। 

প্রশ্নফাঁসের সিন্ডিকেটের সঙ্গে বুয়েট শিক্ষকের জড়িত থাকার খবর দেখে আমরা অনেকে খুব স্তম্ভিত হয়েছি; সামাজিক মাধ্যমে প্রতিক্রিয়ায় এটা খুব স্পষ্ট। শুধু সামাজিক মাধ্যম কেন, মূল ধারার মিডিয়াতেও এই ব্যাপারে বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে। অনেক সংবাদপত্র এবং নিউজ পোর্টালের অনলাইন ভার্সনে আমি দেখেছি এই সংবাদের শিরোনামের সঙ্গে আশ্চর্যবোধক চিহ্ন (!) যুক্ত করা হয়েছে। আচ্ছা, বুয়েট শিক্ষকের একটা দুর্নীতির অভিযোগে আমরা এত অবাক হচ্ছি কেন? আমরা কী প্রত্যাশা করেছিলাম?

একটা কথা আগে বলে রাখা ভালো, প্রশ্নফাঁসে জড়িত সন্দেহে কিছু মানুষের কাছ থেকে উক্ত বুয়েট শিক্ষকের নাম পাওয়া গেছে। বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। এমনকি পুলিশি তদন্তে তাকে অপরাধী পেয়ে চার্জশিট দেওয়া হলেও তাকে শেষ পর্যন্ত অপরাধী আমরা বলে ফেলতে পারি না। কারণ, এরপর বিচার শুরু হবে। নিম্ন আদালত আছে, উচ্চ আদালত আছে, সব প্রক্রিয়া শেষ হবার আগে কাউকে অপরাধী বলা ঘোরতর অন্যায়। তবে এই কলামের আলোচনার খাতিরে আমরা ধরে নেই বুয়েট শিক্ষক সত্যিই এই কাণ্ড ঘটিয়েছেন।

একটা সমাজে যখন প্রতিটি সেক্টর মোটাদাগে দুর্নীতি-অনিয়মে জড়িত হয়ে পড়ে, যখন  দুর্নীতি-অনিয়মের একটা সামাজিক স্বীকৃতিও তৈরি হয়, তখন কীভাবে আমরা প্রত্যাশা করি, সেই সমাজের কোনও একটি প্রতিষ্ঠান বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়ে থাকবে? যাবতীয় নোংরামির মধ্যে সেই প্রতিষ্ঠানটি মাথা উঁচু করে নৈতিকতার জয়গান গাইবে? 

দুর্নীতি করা এই দেশে নানাভাবে ক্ষমতা থাকা মানুষের এক ধরনের অধিকারে পরিণত হয়েছে। তাহলে সেই অধিকার বুয়েটের একজন শিক্ষকের কেন থাকবে না? এই সমাজের আর দশ জন মানুষের মতো দেশে বাড়ি-গাড়ি, বিদেশে সেকেন্ড হোম, থার্ড হোম বানানোতে তিনি কেন পেছনে পড়ে থাকবেন? 

একটা রাষ্ট্রের কোনও সেক্টর বা প্রতিষ্ঠান বিচ্ছিন্নভাবে ভালো বা খারাপ হয় না। যে সমাজে সবকিছু দুর্নীতিমুক্ত এবং নিয়মতান্ত্রিকতার মধ্যে চলে সেখানে সব প্রতিষ্ঠানে সেভাবে চলে। এমনকি সেরকম সিস্টেমে কোনও একজন দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষও দুর্নীতি করার ক্ষেত্রে ভাবে বারবার। আবার উল্টো পাশেই চরম দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজে একজন মানুষ চাইলেও এসবের বাইরে থাকতে পারেন না। বহু রাষ্ট্রীয় সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে যদি কেউ ঘুষ না দিতে চায়, তাহলে তার পক্ষে এই দেশে বসবাস করাই প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।

দুঃখিত, দুর্নীতি-অনিয়মে আকণ্ঠ নিমজ্জিত রাষ্ট্র-সমাজে বুয়েট কিংবা আর কোনও প্রতিষ্ঠান বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়ে থাকার কথা নয়, থাকেনি।

/এসএএস/জেএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
দুই বলের ম্যাচে জিতলো বৃষ্টি!
পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড প্রথম টি-টোয়েন্টিদুই বলের ম্যাচে জিতলো বৃষ্টি!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ