X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

এ মৃত্যুর জন্য আমরা সবাই দায়ী

জোবাইদা নাসরীন
০৬ ডিসেম্বর ২০২১, ১৭:০০আপডেট : ০৬ ডিসেম্বর ২০২১, ১৭:০০
জোবাইদা নাসরীন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সেলিম হোসেনের মৃত্যু এবং তাঁর সঙ্গে ঘটে যাওয়া নিপীড়ন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উঠেছে প্রতিবাদ এবং নিন্দার ঝড়। এরইমধ্যে কুয়েটের ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাসহ ৯ জনকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট।

প্রাথমিকভাবে এই বহিষ্কারের মূল দলিল সিসিটিভির ফুটেজ এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য। ইতোমধ্যে বন্ধ হয়েছে কুয়েট। অধ্যাপক সেলিমের বাবা এবং স্ত্রী স্পষ্ট করেই বলছেন এটি হত্যাকাণ্ড। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সূত্র অনুযায়ী, সেদিন অধ্যাপক সেলিম হোসেন বাসায় ফিরে বিমর্ষ ছিলেন এবং ছাত্ররা যে তাঁকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল তা স্ত্রীকে জানিয়েছিলেন। এর পাশাপাশি এমনকি হলের দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন বলেও জানান। এর আগে ফোন করেও এই শিক্ষককে হুমকি দেওয়ার কথাও গণমাধ্যমে তাঁর স্ত্রী জানান।

জানা যায়, ১১ মাস আগেই কুয়েটের লালন শাহ হলের প্রাধ্যক্ষের দায়িত্ব পান অধ্যাপক ড. সেলিম। কুয়েটের ছাত্র ও শিক্ষকরা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন যে, কুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তাদের মনোনীত ছাত্রকে লালন শাহ হলের ডিসেম্বর মাসের ডাইনিং ম্যানেজার করার জন্য বেশ কিছু দিন ধরেই প্রভোস্ট ড. সেলিমকে চাপ দিয়ে আসছিলেন। তবে ড. সেলিমের মৃ্ত্যুর পর ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক সেসব অস্বীকার করেছে। কিন্তু ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদকের এই অস্বীকারের বিপরীতে বাদ সেধেছে  সিসিটিভি ক্যামেরা।  ফুটেজে দেখা যায়, নিজের বিভাগ থেকে বের হচ্ছিলেন অধ্যাপক ড. সেলিম হোসেন। রাস্তায় কুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সিজান এবং বেশ কয়েকজন  শিক্ষার্থী তার পথরোধ করে এবং ড. সেলিমকে বিভাগের ভেতরে নিয়ে যায়। সেখানে ৪২ জন শিক্ষার্থী একে একে প্রবেশ করে এবং বাগবিতণ্ডা হয়।

প্রথম প্রশ্ন- কেন একজন ছাত্রনেতা তার দলবল নিয়ে একজন শিক্ষককে রাস্তায় আটকাবেন এবং বাধ্য করবেন মিটিংয়ে বসতে? দ্বিতীয়ত, হলকেন্দ্রিক কোনও ইস্যু থাকলে সেটির জন্য এভাবে কেন? হলে কোনও সমস্যাকে কেন্দ্র করে সভা ডাকতে হলে সেটি সাধারণত সেই হলের হলরুম কিংবা টিভি রুমেই হয়ে থাকে। কিন্তু কাউকে রাস্তা থেকে গতিরোধ করে মিটিংয়ে বাধ্য করা হলো কেন? যখন ইস্যুই হয় ডাইনিং ম্যানেজমেন্ট এবং টেন্ডার ইস্যু এবং সেটির জন্য ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক একজন শিক্ষককে এভাবে নিয়ে আসলেন তখন বোঝাই যায় সেখানে কী ঘটতে পারে? ৪২ জন শিক্ষার্থী কীভাবে এই করোনার সময়ে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে শিক্ষকের রুমে গেলেন? এসময় সেই রুমের আশপাশে যারা যাওয়া আসা করেছে তারা অনেক তর্কবিতর্কের আওয়াজ শুনেছে।

অনেকেই অনেক ধরনের প্রশ্ন রেখেছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, কী হয়েছিল সেখানে? সেখানে যে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি হয়েছিল সেটা সহজেই অনুমেয়। কী ঘটতে পারে? যখন ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের একজন সাধারণ সম্পাদক দলবল নিয়ে শিক্ষককে তার রুমে গিয়ে মিটিং করতে বাধ্য করেন তখন নিশ্চয়ই সেখানে খোশগল্প হয়নি। আর এমন নয় যে এই ধরনের পীড়ন আমরা এই প্রথম জানতে পারলাম। তবে অপমান, অসম্মান সবাই একভাবে হজম করত পারে না, মানতে পারে না। অধ্যাপক সেলিমও  হয়তো সেটি পারেননি।

এখন একটা প্রশ্ন করতে চাই সবাইকে। এই ধরনের ঘটনা কী এই প্রথম জেনেছেন? হয়তো অধ্যাপক সেলিমের মৃত্যু আপনাদের হা -পিত্যেশ অনেকটাই বাড়িয়েছে। কিন্তু গত তিরিশ বছরে বাংলাদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে হলগুলোতে কী হয় আমরা তা জেনে গেছি। বিশেষ করে ছেলেদের হলগুলোতে হল প্রশাসন বলে কিছু থাকে না। ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতারাই হয়ে পড়ে হলের প্রশাসক। তাই হয়তো সেটাই বুঝানো হয়েছিল সেই মিটিংয়ে। এখন এই ধরনের অপমান-অসম্মানের ঘটনা হয়তো এতটাই গা সওয়া হয়ে গেছে যে মনে হয় এটাই হয়তো এখনকার সংস্কৃতি এবং এটি নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয় না।

অধ্যাপক সেলিমের মৃত্যু বিষয়টিকে আবারও সামনে নিয়ে এসেছে। এই ধরনের পরিস্থিতির জন্য আসলে আমরা কাকে দোষারোপ করবো? কীভাবে আমরা আসলে পরিস্থিতিকে এই পর্যায়ে নিয়ে গেছি? একজন শিক্ষার্থী যখন তার ছাত্র পরিচয়ের বাইরে গিয়ে প্রথমেই পরিচয় দেয় আমি এই হলের অমুক সংগঠনের অমুক, তখন স্পষ্টই তার এই পরিচয়ের মধ্যে এক ধরনের ক্ষমতা চর্চাকে ইঙ্গিত করে নিজেকে ক্ষমতাসীন বলে পরিচয় দেয়। কিন্তু তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, সেটিই হওয়া উচিত প্রথম পরিচয়।

আমরা নানাভাবে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতানেত্রীদের নানা ক্ষমতা চর্চাকে অনুমোদন দিই। আমরাও তো ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতাদের তোয়াজ করে চলছি। এর আগে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সেখানকার ক্ষমতাসীন সংগঠনের নেতাকে ‘স্যার’ বলে ডেকে আলোচনায় এসেছেন। আমরা ছাত্রনেতাদের দিয়ে বিভিন্ন পদ পদবির নানা তদবির করাই। শিক্ষার্থীদের ন্যায্য আন্দোলন রুখতে তাদের ‘হামলা’মুখী সমর্থন চাই। বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে তাদের সমর্থন এবং পরামর্শ গ্রহণ করি। হলগুলোতে গেস্টরুমের নির্যাতনকে পাশ কাটিয়ে যাই। আমরা যে ভয়ে করি তা নয়, আমরা তাদের শাসন এবং নির্যাতনকে নিজেদের স্বার্থের জন্য অনুমোদন দেই। কারণ তাদের ওপরও আমাদের অনেক শিক্ষকের ক্ষমতাই যে টিকে থাকে।

এর পাশাপাশি আমরা কী চিত্র দেখি? হল বা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনও অনুষ্ঠানে, খেলার মাঠে  উপাচার্যদের পাশে কারা বসেন? একটু চোখ খুললেই দেখতে পারেন, জানতে পারেন। অনেক উপাচার্য নিজেরাই ছাত্রনেতাদের ডেকে তাদের পাশে বসান। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতেও দেখা যায় ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতারাই যে শুধু যে উপাচার্য বা হল প্রাধ্যক্ষের সঙ্গে বসেন তা নয়, প্রথম দিকের চেয়ারগুলোতেও তারা বসে থাকেন। অন্যদিকে শিক্ষকরা দাঁড়িয়ে থাকেন কিংবা পেছনে বসেন।

হলগুলোতে ‘বহিরাগত থাকতে পারবে না’ বলে লোক দেখানো চিঠি দেওয়া হয়। কারণ, সবাই জানে এই বহিরাগত কারা? এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর তলার কর্তাব্যক্তিরা তাদেরই সবসময় খোঁজ করে। এই ক্ষমতাচর্চা যে শুধু হলগুলোতে হয় তা নয়, বিভিন্ন বিভাগেও এটি দেখা যায়।

সুতরাং অধ্যাপক সেলিমের মৃত্যুতে হায় হায় গায়েবি আওয়াজ না তুলে তাঁর পিতা এবং স্ত্রী যেন ন্যায়বিচার পান এবং এই ক্ষমতা প্রয়োগের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে একজোট হতে হবে এখনই।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ইমেইল: [email protected]
 
 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কক্সবাজার-চট্টগ্রাম রেললাইনে ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত
কক্সবাজার-চট্টগ্রাম রেললাইনে ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত
ইউক্রেনের ড্রোন হামলায় রাশিয়ার জ্বালানি স্থাপনায় আগুন
ইউক্রেনের ড্রোন হামলায় রাশিয়ার জ্বালানি স্থাপনায় আগুন
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ