X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

উচ্ছেদ আর ‘উন্নয়নে’র রাজনীতি, সংবাদ-গুরুত্বের পালাবদল

মানস চৌধুরী
২৩ জানুয়ারি ২০১৬, ১১:৩৯আপডেট : ২৩ জানুয়ারি ২০১৬, ১৯:৪৫

মানস চৌধুরী ২০ জানুয়ারি নেহায়েৎ খেয়ালবশে বাংলা ট্রিবিউনের পাতা পড়াকালে দুটো খবর চোখে পড়ল। বা নানান খবর চোখে পড়ল, কিন্তু ওই দুটোর গুরুত্ব বিশেষভাবে টোকা দিল মাথায়। একটা হলো শহীদ আসাদ দিবস। আমি ভুলে গেছিলাম। আসাদ গেইটের পাশ দিয়ে প্রতিবার যাওয়ার সময়, যত গাম্ভীর্যের সঙ্গেই তোরণটির দিকে তাকাই না কেন, যতই না কেন প্রতিবার আসাদ ও তার সহযোদ্ধাদের লড়াইটা মাথায় অনুরণন তৈরি করুক, আলাদা করে দিবসটা মাথায় মুখস্ত রাখি না। অন্য খবরটি হলো মোহাম্মদপুর কলোনি উচ্ছেদ করা হচ্ছে, আচমকা, পরিবারগুলোকে বের করে দিয়ে, গুণ্ডামিসমেত (যদিও পুলিশি হেফাজতে)। উচ্ছেদটি শুরু হয়েছে ঠিক আগের দিন, হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ থাকা সত্ত্বেও। কলোনিটি যে আসাদ গেটের কাছেই, সেটা নেহায়েৎ কাকতাল। 
ঢাকায় চাকরিজীবী হিসেবে আমার বাসা খুঁজতে হয়েছে কম-ভাড়ার এবং অবিবাহিত সন্দেহভাজন ‘ব্যাচেলর’ হিসেবে। সহকর্মীর সহযোগিতায় আর সুপারিশে একখানা গ্যারেজসংলগ্ন বাসা আমি পেয়েছিলাম লালমাটিয়ায়। স্কুলটার পাশ দিয়ে হেঁটে আমি আসাদ গেট বাসস্টপে যেতাম, দমকলের অফিসের সামনে দিয়ে। যাওয়ার পথে এই কলোনির সামনের মাঠখানা আর সমরূপ স্থাপত্যের ৭টি ভবন চোখে পড়তই। সরকারি স্থাপত্যের বাসভবন সবসময়ই আমাকে আকৃষ্ট করে। ঝাঁক বেঁধে সারি সারি বাড়ি বলেই হয়তো। তা সে কলোনি বলা হোক বা কোয়ার্টার। শব্দগুলোর এই রদবদলে যে মানবদল হয়, সেটাও আমার মনে থাকে। শুধু চোখে পড়ত না, আমি নিয়মিতই, কিছু দিন পরপর একজন খালাম্মার বাসায় যেতাম। খেতাম, গল্প করতাম, তবে সেই প্রসঙ্গ বিশদ করব না।
তবে যে বিষয়টা উল্লেখ করা জরুরি, তা হলো সামনের এই মাঠখানা। এই মাঠখানায় সারাক্ষণ ‘কলোনি’র কিংবা লালমাটিয়ার অন্যান্য পরিবারের বাচ্চারা দাবড়ে বেড়াত। সেটা খুব সহজে অনুমানযোগ্য। কিন্তু মাঠখানা মুনাফালোভী লোকজনের চক্ষুশূল ছিল। সেটা বোঝার জন্য গবেষক, তথ্যানুসন্ধানী সাংবাদিক কিছুই হওয়ার প্রয়োজন পড়ত না। আশপাশের ‘অবৈধ’ চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খেতে শুরু করলে, এবং কান পাতলেই, এই মাঠে যে কতগুলো বাড়ি, কত মূল্যের হওয়া সম্ভব সেসব আলাপ কানে আসত। এসব আলাপের কিছু কারিগর ছিলেন একদম আম, হিসাববিলাসী মানুষজন, যাদের এ রকম উদ্যোগ নেওয়ার বা ভাবার কথা নয়। একেবারেই চায়ের কাপের আলাপ: ‘এই মাঠে যদি ফ্ল্যাট বানায় টাকার হিসাব চিন্তা করছস?’

এসব হিসাবে উদ্যমী চায়ের দোকানিও কখনও-কখনও অংশ নিয়ে বসতেন। নিছক নির্বিষ নির্মোহ হিসাব, ‘উন্নয়ন’-এর জোয়ারে থাকতে-থাকতে কল্পনাশক্তির যতটুকু প্রভাবিত হয় আরকি! কিন্তু এর বাইরেও তীক্ষ্ম চোখে তাকাতে-তাকাতে হিসাব করত অন্য কিছু মানুষ। এলাকার মানুষ  তাদের নেতা, বা চায়ের দোকানের আশপাশে যেহেতু, নেতার চ্যালা-চামুণ্ডা হিসেবে চেনেন। ঢাকা শহরের বিরলপ্রায় মাঠের মধ্যে এই একটুকরো মাঠ এসব চ্যালাচামুণ্ডাদের চোখ থেকে কিছুতেই এক মুহূর্তের জন্য অপসৃত হয়নি। একজন পথচারী চা-পানকারী হিসেবে বহুবছর আগেই তা আমি জানি। এমনিতে মাঠটির একটা বৃহত্তর ব্যবহার হতোই। ঈদের মৌসুমে যখন গাড়িওয়ালা ক্রেতায় পার্শ্ববর্তী ‘আড়ং’ সয়লাব হয়ে যেত, তখন এই মাঠ আড়ংয়ের লিজকৃত পার্কিং হিসেবে ব্যবহৃত হতো। আমার কখনও খোঁজ নেওয়া হয়নি যে লিজের টাকাটা কলোনির কোনও তহবিলে যেত, নাকি চ্যালাচামুণ্ডাদের তহবিলে।

১৯ তারিখে উচ্ছেদকৃত পরিবারগুলো স্পষ্ট করেই নির্মম এই উচ্ছেদ-অভিযানের নায়কদের নাম নিচ্ছে। অনেকেই মার খেয়েছেন, অনেকের সংসারের আবশ্যিক জিনিসপত্র ভাঙচুর হয়েছে। খোলা সেই মাঠের মধ্যে, তীব্র শীতে অনেকেই কাঁদছেন। এগুলো পত্রিকার টুকরো রিপোর্ট থেকেই জানা যায়। যারা সরেজমিন সেখানে পরিস্থিতি বুঝতে গিয়েছিলেন, তারা আরও রোমহর্ষক নির্যাতন ও নৃশংসতার কাহিনী জেনে এসেছেন। এরকম রিক্ত-নিঃস্ব পরিস্থিতিতে হয়তো ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর খলনায়কের নাম নেওয়া সহজ। তারা স্থানীয় সংসদ সদস্য আর তার ডেপুটিদের ভূমিকা খোলাখুলিই প্রতিবেদকদের জানিয়েছেন, প্রায়শই বিলাপের মধ্যে। নামগুলো পাবলিক জবানিতে বিশেষ দুর্লভ নয়। বৃহত্তর মোহাম্মদপুর এলাকাতে তো নয়ই। তবে নামোল্লেখের কারণে এসব উচ্ছেদকৃতর নতুন করে কোনও পুরস্কার জুটছে কি না জানা যায়নি। তবে সেসব নায়ক সকল প্রকার শানিস্তর বিধানের জন্য লায়েক। সম্ভবত সরকারের অনুমোদনপ্রাপ্ত। 

হতাশ, সন্ত্রস্ত ও নিরাশ্রয় মানুষজন এলাকার কিছু মানুষের নাম নিচ্ছেন। সেসব মানুষ খুবই দায়িত্বশীল ও অমিত ক্ষমতাধর এবং প্রায় যেকোনও নিয়ম ইচ্ছেমাফিক চটজলদি বানিয়ে ফেলতে এলেমদার। মানুষজন যাই বলুক, যাকেই দেখুক, এই উচ্ছেদ সরকারের দ্বারা স্বীকৃত, গৃহীত ও বাস্তবায়িত উচ্ছেদ। নেতাদের সেখানে সরকারেরই ভক্ত প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য করতে হবে। পত্রিকান্তরে জানা যায়, গত বছরই ভবনগুলো ভাঙার উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। সেখানকার বাসিন্দারা মামলা করায় সরকারকে পিছু হঠতে হয়েছিল। লক্ষ করুন আদালতে শুনানি হয়েছিল এই উচ্ছেদ অভিযানের ঠিক আগের দিন। আর সরকার ঠিকমতো দলিল-দস্তাবেজ হাজির করতে না-পারায় ২১ জানুয়ারি পুনরায় শুনানির তারিখ নির্ধারণ করেন আদালত। তাহলে আদালতের পরবর্তী শুনানি পর্যন্ত যাওয়ার কোনও আগ্রহ সরকারের ছিল না। পরিষ্কার তো! তাহলে এলাকার ‘নেতা’ ও ‘চ্যালা’রা নেহায়েৎ এলাকার নন, তারা সরকারেরই বাস্তবায়ন প্রতিনিধি। বিচ্ছিন্ন নয় যে, আগের রাতেই এলাকার বেশ কিছু তরুণকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যারা উচ্ছেদ অভিযানের প্রতিবাদ করতে পারতেন বলে উচ্ছেদকৃতরা মনে করেছেন।

সরকারের জন্য এসকল ভবন নবায়ন হচ্ছে ‘উন্নয়ন’। কে মানা করছে! প্রশ্নটা হচ্ছে কতটা মনুষ্যসংবেদনশীল এই ‘উন্নয়ন’। সেই আহাজারিই বা কে শুনতে চাইছে! এই ‘উন্নয়ন’ হবেই। আর মুনাফা-ফ্রাংকেনস্টাইনরাই সেখানে উন্নয়ন-প্রতিনিধি, সরকারের প্রতিনিধি। শুধু তাই নয়। নির্বাচন যেহেতু হতেই থাকে, তারা জনগণেরও প্রতিনিধি। মানতেই হবে। পরিসংখ্যানের হিসাব! মেনে নিন!

ক’দিন আগেই চোখে পড়ছিল যে প্রধান বিচারপতি প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন, বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের আওতাধীন করার প্রচেষ্টা চলছে। হুমম, আমার এমনটাই মনে পড়ে। তিনি নির্বাহী বিভাগের কথাই বলেছিলেন। পাড়ায় পাড়ায় ফ্রাংকেনস্টাইনের কথা বলেননি। তিনি হয়তো ওই পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগও পাননি। কিন্তু তার আওয়াজটিতেও কান দেওয়া দরকার মনে হয়।

সংবাদগুরুত্বের বিষয়টা আলটপকা শিরোনামে রাখিনি। সারাক্ষণই মাথায় ঘোরে। আমি সামাজিক বিজ্ঞানের মাস্টারি করে খাই। তথাপি সংবাদ কী—সে বিষয়ে মাথা না-ঘামিয়ে থাকার উপায় আমার নেই। নিউজ-ইমার্জেন্স বলে একটা বস্তু সকল নবীন সাংবাদিককেই শিক্ষানবিসিকালে শুনতে  হয়। কী তুমি খবর ভাবিবে! কী তুমি খবর কহিবে!! কী তুমি খবর করিবে!!! কিন্তু বিষয়টা অত সোজাসাপ্টা সাংবাদিকের এলেম বা তালিমের প্রশ্ন নয়। ন্যূনতম হলেও সম্পাদক-সাংবাদিক মিথষ্ক্রিয়ার প্রশ্ন। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে এমনকি প্রকাশক তথা মালিকের প্রশ্ন আরও বেশি করে।

কোথাও কোনও সার্বভৌম সম্পাদক রয়েছেন বা থেকে থাকবেন, সে সব সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়ার মতো লোকও আমি নই। কিন্তু কিসের সংবাদ-গুরুত্ব রয়েছে, তা ক্রমাগত একটা বদলমান বিষয়। প্রায়শই বিপজ্জনকভাবে বদলমান। বদলটা সবসময় উপরিভাগের স্বার্থবলয় দ্বারাই নির্ধারিত নয়, কখনও-কখনও একদম পেডাগজিক্যাল বা অন্তর্গত উপলব্ধির জগত থেকেই নির্ধারিত।

দু’দশক আগেও একটা বস্তিতে আগুন লাগলে তা দৈনিকের শীর্ষসংবাদ হিসেবে পরিবেশিত হতো। কোনও বস্তির উচ্ছেদ পরিকল্পনা বা অভিযান দুর্দান্ত তথ্যানুসন্ধানী প্রতিবেদন পাওয়া যেত। পরবর্তী সময়ে এসব খবর নেহায়েৎ পেছন পাতার এক চিলতে খবর। অনলাইন সাংবাদিকতার কালে সামান্য গুণগত বদলের হয়তো লক্ষণ রয়েছে। কিন্তু সামান্যই। বদলটা মনোগত একদম।

এই বয়ান লিখতে লিখতেই কল্যাণপুরের পোড়াবস্তিতে নির্মম উচ্ছেদ অভিযান চলেছে। পুলিশি হামলায় মানুষজন আহত হয়েছেন, অন্তত একজন নিহতও হয়েছেন। মোহাম্মদপুর কলোনিতে মুখ্যত থাকতেন ‘মুক্তিযোদ্ধা’ পরিবারের সদস্যরা। আর কল্যাণপুর পোড়াবস্তিসমেত অজস্র ঢাকাই উচ্ছেদকৃত বস্তিতেতে থাকতেন শ্রমিক শ্রেণির মানুষ।

এত ‘উন্নয়ন’ মুখ বুঁজে পত্রিকার পাঠকেরা সহ্য করেন কিভাবে সেটাই এক বিস্ময়!

লেখক: জা.বি.তে নৃবিজ্ঞানের শিক্ষক; আর বিশ্লেষক, গল্পকার. অভিনেতা, সম্পাদক।

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
নোয়াখালীতে সনি স্মার্ট-এর শোরুম উদ্বোধন
নোয়াখালীতে সনি স্মার্ট-এর শোরুম উদ্বোধন
তাইওয়ানে সহায়তা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি যুক্তরাষ্ট্রের
তাইওয়ানে সহায়তা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি যুক্তরাষ্ট্রের
নারীবান্ধব টয়লেট সুবিধা পান না ৯৩ শতাংশ নারী
জরিপের তথ্যনারীবান্ধব টয়লেট সুবিধা পান না ৯৩ শতাংশ নারী
সিলেট নগরীতে অপরাধী শনাক্তে ১১০ সিসি ক্যামেরা
সিলেট নগরীতে অপরাধী শনাক্তে ১১০ সিসি ক্যামেরা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ