X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

ডিজিটাল থেকে স্টার্ট-আপ: কিছু সতর্কবাণী

গর্গ চট্টোপাধ্যায়
০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ১১:৫৬আপডেট : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ১২:০৮

গর্গ চট্টোপাধ্যায় এই উপমহাদেশে বয়ে যাচ্ছে ডিজিটাল হাওয়া। ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণার পরে ভারত সরকারও ঘোষণা করেছে তাদের ডিজিটাল ইন্ডিয়া। তাতে কী অর্জন হয়েছে, সেটা মাপা যাবে পরে।  তবে, কী অর্জিত হওয়ার ইচ্ছা নিয়ে আমাদের উপমহাদেশে এই ধরনের প্রকল্প হওয়া দরকার, সেইটা আলোচিত হওয়া দরকার। যে কোনও সরকারি প্রকল্প হওয়ার কথা সকলের জন্য, যাতে কিনা মানুষ তার থেকে সুবিধে পায়। তা কোনও এক সামাজিক বা অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর জন্য না হওয়াই শ্রেয়, যদি না সে গোষ্ঠী আর্থ-সামাজিকভাবে খুবই কমজোরি হয়। অর্থাৎ বিশেষ সরকারি সুবিধা যদি দিতেই হয়, তা প্রাপ্য তার যার জীবনে কোনও সুবিধাই নেই। সেদিক থেকে দেখতে গেলে কি হওয়ার কথা আমাদের মতো দেশে ডিজিটাল-এর?
প্রথমত, এর ফলে নাগরিক সুবিধা বাড়তে হবে। অর্থাৎ সহজে যোগাযোগ - মোবাইল, ইন্টারনেট, ইত্যাদি ব্যবস্থার অবকাঠামো।  দুই, এর সহজলভ্যতা।  তিন, তথ্যের অধিকার আইনের সাথে তাল মিলিয়ে সরকারি সকল তথ্য় মানুষের নখদর্পনে এবং মুঠোফোন দর্পনে চলে আশা দরকার। চতুর্থ, সরকারি নানা কাজের হিসেব চাওয়া, কাজের স্বচ্ছতা আনা - যেমন, সরকারি কিছুতে নথি জমা প্রক্রিয়া, টেন্ডার প্রক্রিয়া, কর জমা, নানা ধরনের রসিদ, বা দস্তাবেজ না মানুষের দরকার, তা যেন সহজেই পাওয়া যায়। এর সাথে আছে, চাকরি সৃষ্টি - কম্পিউটার সাইন্সের, অবকাঠামো রক্ষার, নতুন প্রযুক্তি তৈরির - নিজের বাজারের জন্য ও বিশ্ব বাজারের জন্য। এর কোন কোন ক্ষেত্রে ডিজিটাল ইন্ডিয়া বা ডিজিটাল বাংলাদেশ কতটা কি এগিয়েছে, সেটার হিসেব নেওয়া প্রয়োজন।
আমি আসব অন্য এক বিষয়ে, যা আজকাল এই উপমহাদেশে এই ডিজিটাল-এর হাত ধরে চলে এসেছে। একটা হাওয়া, একটা প্রচার, একটা সর্ব দুঃখের মহৌষধ। যাতে কিনা কোটি কোটি চাকরি হবে, অনেক রাজস্ব আসবে, জীবনের সব সমস্যার সমাধান হবে। এই অবতার যখন আবির্ভূত হবে, তার নাম হবে স্টার্ট-আপ। আসলে সে ইতিমধ্যেই আবির্ভূত হচ্ছে, নিজের আবির্ভাবের কথা নানা সরকারি অফিসে, ব্যাঙ্কেট হলে, কর্পোরেট মিটিংয়ে জানান দিচ্ছে। বলছে, তোমরা আমাদেরকে পুঁজি দাও, নানা রকম কর ছাড় দাও, সুবিধে দাও, বদলে আমি তোমাদের লাভ, চাকরি, রাজস্ব, আরামের জীবন সব দেব। যেহেতু চুল এখন পাকতে শুরু করেছে, এমন কল্পতরুর সত্যতা নিয়ে সন্দেহ আছে আমার। তবু সেটা বাদ দেই।

বরং দেখা যাক যে স্টার্ট-আপের নামে আমরা এই এলাকার স্বল্প যে পুঁজি বা ঠিক ভাবে খরচ করছি তো গণস্বার্থে, বিশেষত- সেই সব স্বার্থে যেখানে ডিজিটাল হওয়ার আগেই আমরা বেহাল হয়ে আছি- যেমন খাদ্য, কৃষিপ্রযুক্তি, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, বড় সংখ্যক স্বাবলম্বী তৈরি, শিক্ষা-এনার্জি-ট্রান্সপোর্ট অবকাঠামো, ইত্যাদি। স্টার্ট-আপ নিয়ে ভারতে সাম্প্রতিক মাতামাতি দেখে মনে হতেই পারে যে সে রাষ্ট্রে এই সকল সমস্যার  সমাধান হয়ে গেছে, তাই এক শ্রেণিকে ঝিনচ্যাক পাওয়ারপয়েন্ট দেখানো শ্রেণিকে ইচ্ছে মতো  ভর্তুকি দেওবার মতো উদবৃত্ত রয়েছে এই গরিবের দেশে। এই হওয়া অচিরেই এসে পড়বে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে। চাপ আসবে এখানেও বড় ভর্তুকি দেওয়ার, বলা হবে এইভাবে স্টার্ট না করলে রাষ্ট্র  পিছিয়ে যাবে, ইত্যাদি।

অগ্রগতির সংজ্ঞাকে ছোট করে এনে যে অর্থনৈতিক কল্পনা ও সমাজকল্যাণ সম্পর্কে ধারণার দেউলিয়াপনার হাত ধরে এই স্টার্ট-আপ এ মহামুক্তির মন্ত্র আজ এসেছে বেশ কিছু জায়গায়, আলোচনায়, সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ।  কারণ, তা বিশ্বব্যাপী একটি বড় ঝোঁকের অংশ- তা হলো অর্থনীতিতে বাস্তব জীবনে আসলে কাজে লাগে, একদম মৌলিক জিনিসগুলো, সেই উত্পাদন প্রক্রিয়াগুলো থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে টাকার খেলা, দেনার খেলা, ঋণের খেলা এবং অন্যের দেওয়া পরিষেবা ও করা উত্পাদনের মধ্যে নিজের নাক গলিয়ে বেশি লাভ নিয়ে যাওয়া নাগরিক সুবিধা ও উন্নতিও পরিষেবার নাম চলে ব্যবসাগুলোকেই শিল্পের ভবিষ্যত হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে । অর্থাৎ উত্পাদন প্রক্রিয়া এক ধরনের আড়কাঠির প্রাধান্য বাড়ছে।

গত ১৬ জানুয়ারি, দিল্লিতে ভারত সরকার তাদের স্টার্ট-আপ নীতি ঘোষণা করে। যারা স্টার্ট-আপ বানাবেন, তাদেরকে প্রথম ৩ বছর আয়কর দিতে হবে না, আপনি পরিবেশ আইন বা শ্রম আইন মানলেন কিনা, তাই নিয়ে ৩ বছর কোনও সরকারি নজরদারি করা হবে না, এমনকি ৩ বছরেও পর্যবেক্ষণ করা হবে না যে আপনি শ্রমিকদের প্রাপ্য ভাতাগুলো ঠিক ঠিক দিচ্ছেন কিনা, তাদের পিএফ ইত্যাদি টাকা ঠিকমত জমা দিচ্ছেন কিনা। এই ব্যবসা নাকি এতই লোভনীয় এবং এতে এতই দুনিয়া বদলে যাবে যে সরকার নিজেই পুঁজি জোগাবে ঋণের জন্যে, এবং টাকা জোগাবে কিছু বিনিয়োগকারীকে টাকা ঢালার জন্য।

বুঝে দেখুন! টাকা ঢালার জন্য লোকেদের টাকা দেওয়া হবে, এমন এক জিনিসে যেখানে এত লোভনীয় হলে বেসরকারি পুঁজির তোড়ে সরকারি পুঁজির দরকার না থাকার কথা। আসলে যে বেসরকারি ফাটকা পুঁজিও নিতে চাইছে না, তা সরকার ঘাড়ে করছে, জনগনের টাকা দিয়ে। অত্যন্ত বেশি হারে বিফল হওয়া এই 'স্টার্ট-আপ' গুলোর মুখ থুবড়ে পড়ার দায় ঘরে করবে জনগণ।

তাই বুদ্ধিমানরা ফন্দি করে খোলা মনে স্টার্ট-আপ করে যেতে পারেন। এত কথা হলো অথচ জানায় হলো স্টার্ট-আপ কাকে বলে। সরকারি সংজ্ঞা অনুযায়ী স্টার্ট-আপ হলো গত ৫ বছরের মধ্যে তৈরি এমন একটি কোম্পানি যা কিনা এমন কোনও কিছু করতে ব্যস্ত যা ব্যবসায়িক এবং একই সাথে যার মধ্যে উদ্ভাবনী (ইনোভেটিভ) কোনও একটি চরিত্র রয়েছে। উদ্ভাবন কাকে বলে- এটা কে ঠিক করবে? এটা সরকারের গড়ে দেওয়া একটি কমিটি ঠিক করবে (সেখানে কি হবে, আশা করি বুঝতেই পারছেন - স্টার্ট-আপের পীঠস্থান মার্কিন সিলিকন ভেলিতে কোন সরকার কমিটি করে কোনটা উদ্ভাবন আর কোনটা উদ্ভাবন নয়, এই নিয়ে কাজিগিরি করেনি, যার ফলে সেখানে কল্পনা ও কু-চিন্তার একটা মিশ্রণে বেশ কিছু কোম্পানি তৈরি হয়েছিল সেই সমাজের দরকারের প্রেক্ষিতে- আমাদের প্রেক্ষিত আলাদা )। 

এই সব কমিটিতে বলাই বাহুল্য এমন নানা লোক ঠাসা থাকবে, যাদের কাছে উদ্ভাবন শব্দের মানে খুব সংকুচিত- মূলতঃ টেকনোলজি, App, ওয়েবসাইট, মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তের কিছু সময় কমানো ফুরসত বাড়ানো মার্কা পরিষেবা- এইটুকুর মধ্যেই তাদের চিন্তা মূলতঃ ঘরে ফিরে। ভুতের বাপের শ্রাদ্ধ হবে পাওয়ার-পয়েন্টিদের দাপটে, তাদের স্বার্থে, তাদের তেলা মাথায় আরও তেল দিয়ে। ইংরেজি ভাষায় এটিকে বলে স্ক্যান্ডেল।

সমস্যা আরও গভীরে। স্টার্ট-আপ বা এই ধরনের অর্থনৈতিক ভবিষ্যত কল্পনায় আমাদের দেশগুলোর ছোট-শহর, গ্রাম - কোনও স্থান থাকে না, সেখানকার অর্থনৈতিক পুনরায় জীবন পাওয়ার কোনও ব্যাপারই থাকে না। অথচ আমরা জানি যে কৃষিজাত পণ্যের উদপাদন ও উদ্ভাবনের যে অসীম সম্ভাবনা দুই বাংলাতেই আছে, সেখান লুকিয়ে আছে নানা ভেলু-এডেড জিনিস তৈরি করে বিশ্ব বাজারে এবং নিজ বাজারে বিক্রি করার সুযোগ। রয়েছে অবকাঠামো ঘাটতি এবং আমাদের দেশের জল-হাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তা নিয়ে উদ্ভাবনের সুযোগ।সিলিকন ভ্যালিতে বাংলার সমস্যা সমাধানের উদ্ভাবন হবে না। আমরাও কি আমেরিকার ও আমেরিকার যে অংশ ঢাকায়-কলকাতায় থাকে, তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য আমাদের মেধা ও পুঁজি দেব, উদ্ভাবন আর স্টার্ট-আপের নাম দিয়ে? এইটা কি একটা অর্জন? যারা বাংলায় থাকে না, বা যারা বাংলায় থেকেও মনে মনে থাকে না, তাদের জীবন-কল্পনা বা বঙ্গ-কল্পনাকে আশ্রয় করে যদি বাংলায় শিল্প বিপ্লব ও উদ্ভাবন-বিপ্লব আসে, তাহলে তা হবে জাতির পক্ষে ঘর অমঙ্গলের। তৈরি হবে বাড়ির কাজের বুয়া খুঁজে দেওয়ার app আর বাড়িতে বসে ঘরে সবজি দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার app।

এইগুলোকে উদ্ভাবন, উৎপাদন ও ব্যবসা বলে প্রকৃত উদ্ভাবক, উৎপাদক ও ব্যবসায়ীকে লজ্জা দেবেন না। সরকার যখন এই ধরনের গোঁজামাইল ভরা গণ-সমাজ বিচ্যুত নানা স্বপ্নকে ভবিষ্যত বলে জনগণের সামনে তুলে ধরে, সেটা আসলে স্বপ্ন বেচার সামিল। গুলশানের স্বপ্ন দিয়ে সমগ্র বাংলাদেশ চলতে পারে না, পাওয়ার-পয়েন্টি পাওয়ার-পন্থীদের খেলার মাঠ তৈরি করার দায় জাতির নয়। মোহাম্মদপুরের লেদ মেশিন ফ্যাক্টরির সাথে সে লড়ে নিক ব্যবসার মাঠ। বাংলার লাখ উদ্ভাবকের নিয়ত কোটি উদ্ভাবনের জন্যেই বাংলা তলিয়ে যায়নি। সাহায্য দরকার তাদের, যাদের বড় হওয়ার, অনেক বড় হওয়ার স্বপ্নের মধ্যে বাংলার বাস্তবতা, বাংলার মানুষের, গণ মানুষের চাহিদার একটা স্থান আছে। তাদের বাংলাকে প্রয়োজন। বাংলাকে তাদের প্রয়োজন। অনেকে ডায়েট না করেও ক্ষুধার্থ, ব্যাকপ্যাক না করেই গৃহহীন। দরকার তাদের কল্যানের জন্য, তাদের হাতে কাজ দেবে, এমন স্টার্ট-আপ। সেই সব ব্যবসায় আমাদের স্টার্টআপ করতে হবে, যার ভিত্তি  সিলিকন ভ্যালিতে বা পাওয়ার-পয়েন্টে নয়, বাংলার বাস্তবের জমিতে। 

লেখক: স্থিত মস্তিষ্ক-বিজ্ঞানী 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
করোনার পর মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
করোনার পর মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
দক্ষিণ আফ্রিকায় বাস দুর্ঘটনায় ৪৫ তীর্থযাত্রী নিহত
দক্ষিণ আফ্রিকায় বাস দুর্ঘটনায় ৪৫ তীর্থযাত্রী নিহত
পায়ুপথে ৭০ লাখ টাকা সোনা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল পাচারকারী
পায়ুপথে ৭০ লাখ টাকা সোনা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল পাচারকারী
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ