X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

মাহফুজ আনাম বিতর্ক থেকে আমরা কী শিখেছি?

জাফর সোবহান
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ২১:২৯আপডেট : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৮:৩১

জাফর সোবহান দ্য ডেইলি স্টারে সহকারী সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মাহফুজ আনাম আমাকে সংবাদপত্রটির মতামত পাতার দায়িত্ব দেন। এ বিষয়ে তার অবস্থান ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। মতামত পাতাগুলো হবে সব রকমের মত প্রকাশের পাটাতন, এমনকি যেসব বিষয়ের সঙ্গে সম্পাদক হিসেবে তিনি বা মতামত পাতার সম্পাদক হিসেবে আমিও একমত নই, সেসব লেখাও প্রকাশিত হবে।
আমরা চেষ্টা করেছি, যত বেশি সম্ভব ভিন্নমত প্রকাশ করতে, যেন আমাদের পাঠকের কাছে বৈচিত্র্যপূর্ণ মতামত পৌঁছাতে পারে।
তবে একটি ব্যতিক্রম বাদে। তা হচ্ছে আমরা এমন কোনও উপ-সম্পাদকীয় প্রকাশ করিনি যাতে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে অথবা কোনও সংকটের অগণতান্ত্রিক সমাধান দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে মাহফুজ ভাই ছিলেন স্ফটিকস্বচ্ছ, এমন কোনও মতামত তিনি ডেইলি স্টারে প্রকাশ করবেন না, যা নীতিবিরুদ্ধ ও অগ্রহণযোগ্য।
এ প্রসঙ্গটি এখন উত্থাপন করার কারণ হচ্ছে গত সপ্তাহে মাহফুজ ভাইয়ের টেলিভিশনে বক্তব্য নিয়ে সাম্প্রতিক হইচই। সেনাবাহিনীর মদদপুষ্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে ২০০৭-২০০৮ সময়কালে ডেইলি স্টার অপ্রমাণিত গোয়েন্দা তথ্যভিত্তিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যে কারণে মাহফুজ ভাইকে সমালোচিত হতে হয়।
শুধু সমালোচনাই নয়, তার বিরুদ্ধে অভিযোগের খড়্গ ওঠে, সংসদে বাদানুবাদ হয় এবং তাকে গণতন্ত্রের শত্রু বলেও অভিহিত করা হয়। এটা মোটেই সত্য নয়।
নিশ্চিতভাবেই ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করা ছিল একটি বড় রকমের ভুল। মাহফুজ ভাই তা বুঝতে পেরেছেন এবং স্বীকারও করেছেন।
কিন্তু এখানে আলোচ্য হচ্ছে, তিনি গণতন্ত্রকে পথভ্রষ্ট করার, বিনষ্ট করার লক্ষ্য নিয়ে এমন কাজ করেছেন- এ ধারণা অত্যন্ত অপমানজনক, বিশেষত এমন একজন মানুষের বিরুদ্ধে যিনি নিজের কর্মজীবনকে উৎসর্গ করেছেন নিজের দেশ ও দেশের মানুষের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য।
এই মুহূর্তে কেউ ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির উত্তেজনাকর সময়ের কথা ভুলে যেতেই পারেন। এমনকি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নিজেও ফখরুদ্দিন ক্যাবিনেটের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন।

তার মতো দেশজুড়ে আরও অনেকেই, মাহফুজ ভাইও, ভেবেছিলেন ওই রকম সময়ে দেশের সামনে বিকল্প কোনও পথ নেই। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষের প্রত্যাশা মতো কাজ করেনি ওই সরকার।

সুশীল সমাজের সদস্য সমর্থকদের ওপর ১/১১ এর সব দায় চাপিয়ে দেওয়া একেবারেই যথার্থ নয়, কোনওভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। বিশেষ করে মাহফুজ ভাইয়ের মতো মানুষের ক্ষেত্রে; যার অবস্থান ছিল এমন যে, পূর্ববর্তী সরকারের ভুল পদক্ষেপের কারণেই সরকার পরিবর্তনের ঘটনা ঘটেছে।
ওই সময়ে প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদন ও সম্পাদকীয়গুলোই সঠিক সাক্ষ্য দিতে পারে। পাঠকেরাও এমন কোনও প্রমাণ দিতে পারবেন না, যাতে মনে হতে পারে, সংবাদপত্রটি অনির্দিষ্টকালের জন্য কোনও অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে সমর্থন করে। সে সময় সরকারের প্রতি সমর্থন দেওয়াটা ছিল বাধ্যতামূলক, জটিল এবং সবসময়ই তাকে হতে হতো গণতন্ত্রমুখী।

সে সময়ে যে দ্য ডেইলি স্টার প্রকাশিত হয়েছে, মাহফুজ ভাই যে স্বনামে উপ-সম্পাদকীয় লিখেছেন, তাতে আমি আনন্দিত। কেননা, ওই বাস্তবতায় তার অবস্থান ও মনোভাব তার লেখার মাধ্যমেই প্রকাশ পেয়েছে।

এখন মাহফুজ ভাইয়ের বিরুদ্ধে যেসব মামলা দায়ের করা হচ্ছে, তা মানহানিকর ও কুৎসা প্রচার করছে, যা এ সময়ের মানদণ্ডে বিবেচনা করা উচিত।

যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ ছাড়া যেসব প্রতিবেদন ডেইলি স্টার ছেপেছে, তাতে কী আছে, আর কী নেই, এ নিয়ে অনেকেই অনেক কিছু ভাবতে পারেন। তবে, একটি কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, তাতে  রাষ্ট্রদ্রোহিতার কিছু ছিল না।

মাহফুজ ভাইয়ের বিরুদ্ধে যে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে কোনও মামলা দায়ের করা হয়নি তা সরকারের কৃতিত্ব। মামলাগুলো ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী যে এ বিষয়টি বিবেচনা করছেন; যা অত্যন্ত সন্তোষজনক। আমরা আশা করব, তিনি এভাবেই দেশ ও সরকারকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। কিন্তু একইসঙ্গে আমরা এ-ও আশা করব যে, তিনি তার দলের সদস্যদের এ ধরনের ব্যক্তিগত মামলা দায়ের করা থেকেও বিরত রাখবেন। 

একটি দলের পক্ষ থেকে কারও বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া এক বিষয় কিন্তু দলের সদস্যদের দিয়ে হয়রানির উদ্দেশ্যে মামলা দায়ের করানো সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়।

মাহফুজ ভাইয়ের ওপর আইনি বা বেআইনিভাবে বলপ্রয়োগ করে তার অবস্থান পরিবর্তন করানোর যে কোনও পদক্ষেপই হবে আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিরোধী।

গণতন্ত্রের পক্ষের কোনও সরকারকে আরও উন্নততর পথ বেছে নিতে হবে, গণমাধ্যম ও তার স্বাধীনতার প্রতি সহিষ্ণুতা দেখাতে হবে। প্রকৃতপক্ষে, বিষয়টি নিয়ে নীরবতা বজায় রাখলেই সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষিত হবে।

মাহফুজ ভাইয়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলাটি চলতে দেওয়া উচিত নয়। আমি ব্যাপকভাবে আশাবাদী যে, এই মামলার তদন্তে নেতিবাচক বিষয় পাওয়া যাবে। এতে সরকারও বিষয়টি সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা পাবে।
একটি প্রসঙ্গ তুলে উপসংহার টানতে পারি, তা হচ্ছে, যারা ডেইলি স্টারের বিরুদ্ধে এহেন পদক্ষেপের সমর্থন জানাচ্ছেন, ওই সময়ে একই কাজ করেছে, এমনসব গণমাধ্যম সম্পর্কে তাদের অবস্থান কী রকম?

না, সবাই একই কাজ করেছেন, এটা কোনও যুক্তি নয়। কিন্তু নির্দিষ্ট একজনকে লক্ষ্যবস্তু করাটাই বা কেমন যুক্তি!

পরিশেষে এটুকু বলতে চাই, অপ্রমাণিত প্রতিবেদন প্রকাশ যদি এত বড় কোনও অপরাধই হয়ে থাকে তবে তার পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে।

গত সপ্তাহে গণমাধ্যমে থেকে যা বুঝতে পারা গেল তা হচ্ছে কৃতকর্মের জন্য অনুতাপ প্রকাশ করা মানে হাস্যোস্পদ হয়ে ওঠা। যদিও এটাও নতুন কিছু নয়। একমাত্র নতুন বিষয় মাহফুজ ভাইয়ের অনুশোচনা প্রকাশ করার অংশটুকু।

সেখান থেকেই আমরা নতুন কিছু শিখতে পারি, আর তা হচ্ছে কখনও কোনও কিছু স্বীকার না করা, অনুতাপ না করা, অনুশোচনা প্রকাশ না করা।

আমি নিশ্চিত, আমরা এই শিক্ষা পেয়ে গেছি।

লেখক: সম্পাদক, ঢাকা ট্রিবিউন

.

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
জেফারকে সিনেমায় নিয়েছে ফারুকীপুত্র ইলহাম!
জেফারকে সিনেমায় নিয়েছে ফারুকীপুত্র ইলহাম!
‘জুনের মধ্যে ১০ হাজার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন হবে’
‘জুনের মধ্যে ১০ হাজার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন হবে’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ