X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রশ্নহীন আনুগত্য এবং মনুষ্যত্ব

গোলাম মোর্তোজা
০২ মার্চ ২০১৬, ১৪:১৮আপডেট : ০২ মার্চ ২০১৬, ১৫:৪১

গোলাম মোর্তোজা ধর্ম-সংস্কৃতি, রাজনীতি, কালচার... প্রখ্যাত মনীষীরা বিষয়গুলো নিয়ে লিখে গেছেন। নতুন করে কিছু লেখার চেষ্টা না করে, মনীষী মোতাহের হোসেন চৌধুরীকে স্মরণ করা যেতে পারে, ‘ধর্ম সাধারণ লোকের কালচার আর কালচার শিক্ষিত মার্জিত লোকের ধর্ম’। একজন সংস্কৃতিবান মানুষ নিজে বিকশিত হয়ে, সমাজ বিকাশে ভূমিকা রাখেন।
ধর্মকে অন্তরে ধারণ করেন। ধর্মকে অন্তরে ধারণ করা মানে, মনুষ্যত্বকে ধারণ করা। ধর্ম তার কাছে বাহ্যিক আচরণে সীমাবদ্ধ নয়, ব্যক্তি ও সমাজ বিকাশের অংশ। মনীষী বার্নার্ড’শ তাদের সম্পর্কে সাবধান থাকতে বলেছেন, ঈশ্বর যাদের আকাশে। মনুষ্যত্বকে ধারণ করার জন্যে, সংস্কৃতি চর্চার প্রয়োজন হয়। সংস্কৃতি চর্চা মানুষের পশু প্রবৃত্তি থেকে মুক্ত রাখে। ভেতরে জানার আগ্রহ তৈরি করে, প্রশ্ন করতে শেখায়। আমাদের সমাজে প্রশ্নহীন আনুগত্য প্রতিষ্ঠার চর্চা চলছে। অযোগ্যরাই প্রশ্নহীন আনুগত্য মেনে নেয়। যোগ্যরা তা মানে না, মানতে চায় না। অযোগ্যরা আনুগত্যের জন্য পুরস্কৃত হয়।
ক্ষমতাসীনরা তাদের অসততা-অনৈতিকতার অবাধ সুযোগ তৈরি করে দেয়। অযোগ্য শাসকদের দুঃশ্চিন্তার কারণ সুস্থ চিন্তার বিকাশ। তারা অনুগতদের পশু প্রবৃত্তিতে উদ্বুদ্ধ করে, পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। সমাজের সুস্থ চিন্তার মানুষদের চরিত্রহনন করে। ভালো মানুষদের খারাপ হিসেবে সাধারণের কাছে পরিচিত করাতে চায়। এ কাজে তারা সুবিধা মতো ধর্মকে ব্যবহার করে। যদিও তাদের জীবনে ধর্ম পালন বা ধারণের কোনও নজির থাকে। যেমন মুহম্মদ আলী জিন্নাহর জীবনের কোথাও ধর্ম ছিলো না। অথচ তিনিই ধর্মকে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছেন। মুখে যাই বলুক, জিন্নাকে তারা অনুসরণ করেন।
ধর্মীয় স্থানে গিয়েও তারা অবলীলায় অসত্য বলেন। আর সুস্থ চিন্তার মানুষেরা ধর্মের কি ক্ষতি করল- সেই প্রপাগান্ডা চালান। এই প্রপাগান্ডা সম্পূর্ণ অসত্য, সম্পূর্ণ মিথ্যা। নিজেরা প্রপাগান্ডা চালায়, পশু প্রবৃত্তি সম্পন্ন অনুগামী ভৃত্য শ্রেণিকে ব্যবহার করে। এই অনুগত ভৃত্য শ্রেণি মূলত শাসকদের লাঠিয়ালের ভূমিকা পালন করে। এরা অসত্য বলায় পারদর্শী। এরা সাদাকে বলে কালো, কালোকে বলে নীল। এরা যুক্তির উর্ধ্বে। যুক্তির জবাব দিতে পারে না, গালি দিতে পারে। শাসকরা তাদের বাহবা দেয়। গালি দিয়ে দমিয়ে দিতে পারাটাই তাদের যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হয়। খুশি হয়ে শাসকরা তাদের দুর্নীতির সুযোগ দেয়।
২.
প্রশ্নহীন আনুগত্য মানুষের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র ধ্বংস করে দেয়। সমাজ অন্ধত্বে পরিণত হয়। এই অন্ধে পরিণত হওয়া অনুগতদের মনুষ্যত্ব মরে যায়। মনুষ্যত্বের পরিবর্তে পশু প্রবৃত্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এরা সমাজ ধ্বংসকারক হিসেবে আবির্ভূত হয়। এরা নিজেদের ভৃত্য ভেবে প্রভু সেবায় ব্যস্ত থাকে। প্রভুদের কোনও অন্যায়-অনিয়ম-দুর্নীতি তাদের চোখে পড়ে না।

রাষ্ট্রের লক্ষ কোটি টাকা পাচার হয়ে যায়, তারা কিছু দেখে না। কিছু বলে না। যার ২৮ একর জমি ছিল ৫ বছরে ২৮০০ একর জমির মালিক হয়ে যাওয়া ব্যক্তিকে তারা প্রভু হিসেবে সেবা করে। কে ভাত খেলো না পানি খেলো- তা নিয়ে বিকারগ্রস্ত হয়ে ওঠে।

অনুগত ভৃত্যেরা তথাকথিত উন্নয়নের নামে জনঅর্থ ধ্বংস দেখে না। সুন্দরবন ধ্বংসও তাদের চোখে পড়ে না। উন্নয়ন-উৎপাদনের নামে জনগণের অর্থ হরিলুটের একটি তথ্য দেই। দেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ৬ থেকে ৭ হাজার মেগাওয়াট। উৎপাদনের সক্ষমতা নাকি ১৪ হাজার মেগাওয়াট। নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সবই রেন্টাল-কুইক রেন্টাল। তেল ভিত্তিক এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর তেল নিয়ে লুটপাট তো আছেই। চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও, বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ থাকলেও, প্রতি মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্যে সরকারকে (জনগণের অর্থ) পরিশোধ করতে হচ্ছে ৭০০ ডলার। প্রতিদিন শত শত কোটি টাকা এভাবে অপচয় হচ্ছে। ভাড়াভিত্তিক এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা আরও বাড়ানো হচ্ছে। আরও অর্থ অপচয়ের ব্যবস্থা। কেন আরও ভাড়া ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র? কেন শত শত কোটি টাকা প্রতিদিন অপচয়?

কোনওদিন এসব প্রশ্ন করতে শুনবেন না ভৃত্যদের। যে উন্নয়ন কাজ ৩০০ কোটি টাকায় করা যায়, তা দেড় হাজার কোটিতেও শেষ হয় না। ৬০০ কোটি টাকার কাজ ২৫০০ কোটি টাকাতেও শেষ হয় না। ৫ বছরের কাজ ১১ বছর ধরে চলছে। বাজেট বাড়ছে তিন গুণ। ব্যাংক লুট হয়ে যায়, তারা দেখে না। পৃথিবী বিখ্যাত একটি প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের জন্যে ভৃত্যদের সে কী আস্ফালন!

ইস্কাটনের জোড়া খুনের আসামী, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের আসামীর আদর আপ্যায়ন তাদের চোখে পড়ে না। ত্বকী হত্যাকারীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়, তাও তারা দেখে না। পাশের দেশের নোবেল বিজয়ী কিছু বললে, লিখলে উদ্ধৃত করার হিড়িক পড়ে যায়। পৃথিবী বিখ্যাত দেশের নোবেল বিজয়ীকে গালি দেয়, আনুগত্য মানে না বলে।

৩.
রাজনৈতিক ভৃত্যদের তোষামোদি -অপকর্ম মানুষ দেখে। তাদের কথা মানুষ শুনতে বাধ্য হয়, কিন্তু বিশ্বাস করে না। মানুষ এদের পছন্দ করে না, শ্রদ্ধা করে না -ঘৃণা করে। যারা সমাজে শ্রদ্ধেয়, যাদের কথা মানুষ শোনে, বিশ্বাস করে -তাদেরকে শত্রু মনে করে ভৃত্যরা।

ভৃত্যরা না জেনে, না বুঝে প্রভু কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে প্রপাগান্ডায় মেতে ওঠে। যাদের নিজেদের জীবনে নৈতিকতার ছিটেফোঁটা নেই, তারা প্রতিনিয়ত নৈতিকতার কথা বলে। পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত অসতেরা, সততার জিকির করে চলে। মানুষ হাসে এসব অনুগত ভৃত্যদের নির্বুদ্ধিতা থেকে। ভৃত্যদের হাস্যকর আচরণ দেখে মানুষ রসিকতা করে, হাত তালি দেয়। তারা ভেবে নেয়, মানুষ খুশি হয়ে উৎসাহিত করছে!

৪.

রাজনৈতিক ভৃত্যরা নিজেদের সেই লেজ কাটা শৃগালের মত ধূর্ত ভাবে। লেজ কাটা ভৃত্য শৃগাল শ্রেণির জয়জয়কার চলছে । ত্যাগী, দায়বদ্ধরা পেছনের কাতারে। তারা নিষ্ক্রিয়। যত দিন ক্ষমতা থাকবে, ততদিন ভৃত্যরা থাকবে। ক্ষমতা না থাকার বিপদের দিনে ভৃত্যরা পালাবে। নিষ্ক্রিয় ত্যাগীরা আক্রান্ত হবেন, মূল্য দেবেন।

দেশ বা সমাজের প্রকৃত অর্থে উন্নয়ন বা এগিয়ে যাওয়ার প্রধানতম অন্তরায় দাস মানসিকতার ভৃত্য শ্রেণি। উন্নয়ন মানে গুটিকতক বিল্ডিং-রাস্তা-সেতু নয়। উন্নয়ন মানে মানুষের উন্নয়ন, সংস্কৃতির উন্নয়ন, জীবনবোধের উন্নয়ন।

উন্নয়ন মানে সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা মানুষকে টেনে নিজের কাতারে নিয়ে আসা নয়। উন্নয়ন মানে তাকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করা। তা না পারলে, প্রতিবন্ধকতা তৈরি না করা। মিথ্যা প্রপাগান্ডায় চরিত্রহনন না করা। তা সেই মানুষের পক্ষেই সম্ভব যিনি নিজের প্রতি, দলের প্রতি কিছুটা সন্দেহ রেখে অগ্রসর হবেন। শেষ করি মোতাহের হোসেন চৌধুরীর কথা দিয়ে ‘... এই সন্দেহটুকুই মানুষকে সুন্দর করে তোলে, আর সৌন্দর্যই সংস্কৃতির লক্ষ্য’।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘ভারত কিংবা অন্য কোনও দেশে এমনটি দেখিনি’
‘ভারত কিংবা অন্য কোনও দেশে এমনটি দেখিনি’
পশ্চিম তীরে ১০ যোদ্ধাকে হত্যার দাবি ইসরায়েলের
পশ্চিম তীরে ১০ যোদ্ধাকে হত্যার দাবি ইসরায়েলের
গরম থেকে বাঁচতে ভ্রাম্যমাণ শরবতের দোকানে ভিড়
গরম থেকে বাঁচতে ভ্রাম্যমাণ শরবতের দোকানে ভিড়
রাজধানীতে মেডিক্যাল শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার অভিযোগ
রাজধানীতে মেডিক্যাল শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার অভিযোগ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ